ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব এজতেমা শেষ

আখেরি মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

আখেরি মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা

ফিরোজ মান্না/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে ॥ আল্লাহুম্মা আমিন ছুম্মা আমিন ধ্বনিতে টঙ্গীর তুরাগতীর মুখরিত হয়ে ওঠে। এমন এক মোহনীয় সুরের মূর্ছনায় গোটা এজতেমা এলাকার আকাশ-বাতাসে অন্যরকম আবহ তৈরি হয়। এ সময় আল্লাহর দিদার লাভের জন্য লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মানুষ চোখের পানি ফেলে কায়মনে আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে দীন-দুনিয়ার গুনাহ খাতা নাজাত চান। এমন এক পরিবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি এবং দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করেন তারা। আখেরাতে সুখ ও শান্তির আশায় বাসে, ট্রেনে, নৌকাসহ সব পথেই সকাল থেকেই মানুষের স্রোত এসে থেমে যায় এজতেমা ময়দানের চারপাশে। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ পথেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। রবিবার বেলা ১১টা ৪ মিনিট থেকে ১১টা ৩৩ মিনিট পর্যন্ত মোট ২৯ মিনিট স্থায়ী আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লীর হযরত মাওলানা সা’দ আহমেদ। তাৎপর্যপূর্ণ এই আখেরি মোনাজাতে জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তি, আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে ভোর থেকে শুরু হয় এজতেমামুখী ধনী-দরিদ্র, যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে মানুষের ঢল। যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় গাড়ি না পেয়ে হেঁটে মুসল্লিরা ধাবিত হন এজতেমা ময়দানে। অগণিত মুসল্লি এজতেমা এলাকার বিভিন্ন সড়ক, মিলকারখানা ও বাড়ির ছাদে বসে মোনাজাতে অংশ নেন। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মোনাজাতে শরিক হন। এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতেও লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ ও বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের কূটনীতিকবৃন্দ শরিক হন। এছাড়া পদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ দলমত, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। গত ৮ জানুয়ারি শুরু হয় তবলীগের ৫১তম বিশ্ব এজতেমার প্রথম পর্ব। এরপর চার দিন বিরতি দিয়ে ১৫ জানুয়ারি শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। এ দুটি পর্বের মাধ্যমে রবিবার এবারের বিশ্ব এজতেমা শেষ হয়। এদিকে, বিশ্ব এজতেমা ময়দানের পার্শ্ববর্তী (প্রায় ৩ কিলোমিটার) গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের তারগাছ কুনিয়া পাছরের এলাকার বালুর মাঠ হতে রবিবার ভোরে একটি রিমোট কন্ট্রোলসহ পাঁচটি টাইমবোমা সদৃশ বস্তু পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পরবর্তীতে এতে কোন বিস্ফোরক পাওয়া যায়নি। তবে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মুসল্লিদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত চলে হেদায়েতি বয়ান। সকাল ৮টা ৫০ মিনিট থেকে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত তবলীগের গুরুত্ব তুলে ধরে হেদায়েতি (দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি) বয়ান করেন বিশ্ব তবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরব্বি দিল্লীর হযরত মাওলানা সা’দ আহমেদ। এ সময় তাঁর বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের। হেদায়েতি বয়ানে বলা হয়, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় তবলীগের দাওয়াতি কাজে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার পরামর্শ দেন। কারণ হেঁটে বেশি মানুষকে দীনের দাওয়াত দেয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধুলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠা-া করে দেয়। তিনি তবলীগের দাওয়াতি কাজে গিয়ে মানুষের কাছে ইহজগতের জন্য ছওয়াল করতে বারণ করে বলেন, যে জামাত ছওয়াল করে আল্লাহর সাহায্যের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ছওয়াল করলে দিলে শয়তান স্থান পায়। দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নিয়তকে সহি করা এবং অন্যের কাছে ছওয়াল না করা। আখেরি মোনাজাতে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ ॥ বিশ্ব এজতেমার মূল আকর্ষণ হচ্ছে আখেরি মোনাজাত। বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বে আগত লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে এজতেমা ময়দানে স্থানীয় প্রশাসনের কন্ট্রোলরুমে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, গাজীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম ও পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান। আখেরি মোনাজাতে সংসদ সদস্য, বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের কূটনীতিকবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ শরিক হন। এছাড়া পদস্থ সামরিক, বেসামরিক কর্মকর্তাসহ দলমত, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমান আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। এজতেমায় বিদেশী মুসল্লি ॥ এবারের বিশ্ব এজতেমার দুই পর্বে বিশ্বের প্রায় ১৫০টি দেশের তবলীগ জামাতের ১৫ সহস্রাধিক বিদেশী মেহমান অংশগ্রহণ করেছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী ও মহাদেশ অনুসারে এজতেমা ময়দানে নির্মিত মোট তিনটি বিদেশী নিবাসে এসব বিদেশী মেহমান অবস্থান করেন। সেখানে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা হয়। দ্বিতীয় পর্বের শেষ দিনে ৯৫টি দেশের ছয় হাজার ৩০৭ জন বিদেশী মুসল্লি এজতেমায় অংশগ্রহণ করেন। এজতেমায় অংশগ্রহন শেষে এ পর্বের দ্বিতীয় দিন শনিবার অন্তত ২শ’ বিদেশী মুসল্লি নিজ দেশের উদ্দেশে ময়দান ছেড়ে রওনা হয়েছেন। আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তবলীগের কাজে বের হওয়ার জন্য এবার এজতেমাস্থলে দ্বিতীয় পর্বে প্রায় পাঁচ হাজার জামাত তৈরি হয়েছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মোনাজাত ॥ এজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অসংখ্য মানুষ। টঙ্গীর এজতেমাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মসজিদের মাইকে আখেরি মোনাজাত সম্প্রচার করা হয়। এখানে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ ঈদগাহ মাঠে এবং পার্শ্ববর্তী সড়কে ও ভবনে জড়ো হয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। এছাড়াও জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ টেলিভিশন, ওয়্যারলেস সেট ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন। মুসল্লিদের দুর্ভোগ ॥ এজতেমা ময়দানের প্যান্ডেলের বাইরে পর্যাপ্ত মাইক সংযোজন ব্যবস্থা না নেয়ায় অনেক মুসল্লি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিশ্ব এজতেমা মাঠে মহিলাদের কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও মোনাজাতে শরিক হতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মহিলা টঙ্গীর আশপাশে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে অবস্থান নিয়ে মোনাজাতে অংশ নেন। আবার অনেকে নদীর পাড়ে বা আশপাশে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেন। অজু, গোসল, খাওয়া-দাওয়াসহ ভোগান্তির শেষ ছিল না তাদের। মোনাজাত শেষে যানজট ॥ মোনাজাত শেষ হওয়ার পর পরই বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়া মানুষ একযোগে নিজ নিজ গন্তব্যে ফেরার চেষ্টা করেন। এতে টঙ্গীর আশপাশের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে সৃষ্টি হয় জনজট ও যানজট। ফলে আবারও হেঁটে রওনা দেন মুসল্লিরা। আর হাঁটা মুসল্লিদের চাপে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসল্লিদের যানবাহন রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থাকে এজতেমা মাঠের আশপাশের এলাকায়। দ্বিতীয় পর্বে দুই হাজার জামাত তৈরি ॥ বিভিন্ন দেশে তবলীগের কাজে বের হতে এবার এজতেমাস্থলে দ্বিতীয় পর্বে প্রায় দুই হাজার জামাত তৈরি হয়েছে বলে এজতেমা আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। আখেরি মোনাজাত শেষে এসব মুসল্লি জামাতবন্দী হয়ে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে গিয়ে রিপোর্ট করবেন। পরে তবলীগের মুরব্বিদের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী তারা জামাতবন্দী হয়ে দীনের দাওয়াতি মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাতে কেউ কেউ তিন চিল্লা, এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। এছাড়া এক শ’টির মতো বিদেশী জামাত তৈরি হয়েছে। প্রথম পর্বে প্রায় আড়াই হাজার জামাত তৈরি হয়েছে। আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে বলে সূত্র জানায়। শেষদিনে আরও চার মুসল্লির মৃত্যু ॥ এবারের বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বের শেষদিনে আরও চার মুসল্লি ইন্তেকাল করেছেন। এ নিয়ে রবিবার সকাল পর্যন্ত দু’পর্বে এজতেমায় আগত দুই বিদেশীসহ মোট ১৬ মুসল্লি মারা গেছেন। এদের মধ্যে দ্বিতীয় পর্বের শেষদিন রবিবার ভোরে সুনামগঞ্জের আখলাক মিয়া (৬০) ইন্তেকাল করেন। এছাড়াও শনিবার রাত পৌনে এগারোটার দিকে শ্বাসকষ্টে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথের পেটুয়া গ্রামের মৃত সৈয়দ আলীর ছেলে নূরুল আলম ওরফে নূর হোসেন (৭০), একই রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চুয়াডাঙ্গা সদরের বাদুরতলা এলাকার একরামুল হক জোয়ারদারের ছেলে আবদুল মাবুদ জোয়ারদার (৫২) ও জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ির থানারচর আদরা গ্রামের জাবেদ মোল্লার ছেলে আব্দুল কাদের (৬০) নিজ নিজ খিত্তায় মারা যান। এজতেমা ময়দানে জানাজা শেষে নিজ নিজ এলাকায় তাদের মরদেহ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন লাশের জিম্মাদার মোঃ আদম আলী। এ নিয়ে বিশ্ব এজতেমার দ্বিতীয় পর্বে এ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার এক নাগরিকসহ মোট সাত মুসল্লি ইন্তেকাল করেছেন। এর আগে এ বছরের প্রথম পর্বে ইন্দোনেশিয়ার এক নাগরিকসহ মোট নয় মুসল্লি ইন্তেকাল করেন। নজিরবিহীন নিরাপত্তা ॥ এবারের বিশ্ব এজতেমায় নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ১২ হাজারেরও বেশি পুলিশ ও র‌্যাবের পাশাপাশি তিন হাজার সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আকাশ ও নৌপথের পাশাপাশি সড়কপথগুলোতে খালি চোখ ছাড়াও ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে বাইনোকুলার দিয়ে মুসল্লিসহ সকলের চলার পথ ও কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হয়। এজতেমা চলাকালে গত কয়েকদিন ধরে র‌্যাবের নদীপথে স্পীডবোট ও আকাশপথে হেলিকপ্টারে সার্বক্ষণিক টহল অব্যাহত ছিল। এসব কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে এজতেমাস্থলে স্থাপিত পুলিশ ও র‌্যাবের পৃথক নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে মনিটরিং করা হয়েছে।
×