ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শরিফুল ইসলাম সীমান্ত

৪৫ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: ০৭:১০, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

৪৫ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

এক সময় বাড়ি ছেড়ে আসতে কষ্ট হতো। তারপর এমন একটা সময় এলো যখন বাড়িতে গেলে নিজেকে অতিথি মনে হতে শুরু করে। এই সময়টিতে আমার আরেকটি বাড়ি হয়, ঘর হয়। আমার একটি সবুজ সমুদ্রসম আবেগের প্রাসাদ হয়। এখানে আমি জীবনের দীক্ষা নিই। আমার প্রাণপ্রিয় এই দীক্ষালয়ের আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রিয় ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’। শিক্ষা-দীক্ষা, উদ্ভাবন ও দেশসেবায় এগিয়ে যাও সফলতার সোনালি মালা পরে। সবার আগে। একদম শীর্ষে...। ১২ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে এভাবেই নিজের ফেসবুক ওয়ালে নিজের অনুভূতি জানান জাবির সাংবাদিকতা বিভাগের ৪১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মঈনুল রাকিব। শুধু রাকিব নন, এ রকম হাজারো আনন্দ-অনুভূতি হৃঁদয় ছুয়ে যায় জাবির সঙ্গে সম্পর্কিত হাজারো প্রাণে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নামটা কোথাও দেখতে, শুনতে বা পড়লেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় তাদের। কেননা তাদের কাছে এটি শুধুমাত্র ৬৯৭.৫৬ একরের একটি স্থানের নাম নয়, তাদের কাছে যার আরেক নাম ‘জানবিবি’। একটি অনুভূতির নাম। একটি ভালবাসার নাম। মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীরের শাসনামলে তাঁরই নামানুসারে ঢাকার নামকরণ করা হয়েছিল ‘জাহাঙ্গীরনগর’। সেই ঐতিহ্যের হাত ধরেই বর্তমান রাজধানী ঢাকা শহর থেকে ৩২ কি.মি দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পশ্চিম পাশে ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। মাত্র চারটি বিভাগের (অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যান) অধীনে ২১ জন শিক্ষক আর দেড় শ’ শিক্ষার্থী নিয়ে ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি স্নাতক পর্যায়ে প্রথম ক্লাস শুরু হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর রিয়ার এ্যাডমিরাল এসএম আহসান ১২ জানুয়ারি জাবির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। আর তাই তো ২০০১ সাল থেকে অত্যন্ত জমকালোভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে এই দিনটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি হিসেবে যোগদান করেন বিশিষ্ট রসায়নবিদ অধ্যাপক ড. মফিজ উদ্দিন আহমদ। আর বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম, যিনি কি-না এ দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ভিসি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স স্বাধীন বাংলাদেশের সমান। অর্থাৎ কালের পরিক্রমায় ২০১৬-তে এসে ৪৫তম বছরে পদার্পণ করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। একটু একটু করে বেড়ে ওঠা এ ক্যাম্পাসের প্রাপ্তির ঝুলি আজ ধারণ করেছে মহীরুহ আকার। বহু গুণী ব্যক্তিত্বের স্পর্শে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এ ক্যাম্পাসের সুনাম ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এখানকার শিক্ষকরা দেশ-বিদেশের নানা গবেষণায় সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন সম্মানজনক এ্যাওয়ার্ড। শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে চলেছেন সমানতালে। ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহীম, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্লাজমা বিজ্ঞানী ড. এ এ মামুন, অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদী, জাকিয়া বারি মম, সুমাইয়া শিমু, লেখক হুমায়ূন আজাদসহ এমন হাজারো আলোকিত ব্যক্তিত্ব প্রতিনিয়ত বিশ্বের বুকে প্রতিনিধিত্ব করে যাচ্ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের। বর্তমানে ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩৪টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউটে সাত শ’ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ১৫ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে এই কাম্পাসে। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য এখানে রয়েছে ১৩টি মনোমুগ্ধকর ডিজাইনের আবাসিক হল। নির্মাণাধীন রয়েছে আরও দুটি হল। রয়েছে একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। সম্প্রতি বিজ্ঞান গবেষণার জন্য এখানে নির্মিত হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ‘ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র’। ক্যাম্পাসের সবুজ প্রকৃতির মাঝে লাল ইটের তৈরি দৃষ্টিনন্দন এসব ভবন মন ছুঁয়ে যায় সবার। এছাড়া বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যও রয়েছে এই ক্যাম্পাসে। বাঙালী জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ‘অমর একুশে’। রয়েছে ’৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে শত্রুর আঘাতে হাত-পা হারানো বীর সন্তানদের প্রতীক ‘সংশপ্তক’। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বলা হয়ে থাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে। হবেইবা না কেন? প্রকৃতি যে দু’হাত ভরে সাজিয়ে দিয়েছে এর প্রতিটি প্রান্তকে। ষড়ঋতুর সবকটি ঋতুই আপন সৌন্দর্যের ডালি ভরে সাজিয়ে তোলে ক্যাম্পাসের প্রকৃতিকে। ইট, কাঠ আর যানজটের নগরী ঢাকার ভেতর এত নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ পাওয়া যাবে না আর কোথাও। আর তাই তো প্রতি বছর শীতকালে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এখানে ভিড় জমায় হাজার হাজার অতিথি পাখি। পুরো ক্যাম্পাস মুখর হয়ে ওঠে তাদের ওড়াউড়িতে। ছোট বড় মিলিয়ে জাবির ডজনখানেক স্বচ্ছ পানির লেকে তারা মেতে ওঠে জলকেলিতে। তাদের বরণ করে নিতে তখন রক্তকমলে ভরে ওঠে লেকগুলো। প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা থেকে ক্যাম্পাসে আয়োজন করা হয় পাখিমেলা। থাকে প্রজাপতিমেলা। এগুলোই ব্যতিক্রমী করে তুলেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে। প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রাজধানী। ক্যাম্পাসের শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনকে ঘিরে বছরজুড়েই একের পর এক অনুষ্ঠিত হয় নৃত্য, নাট্য পার্বণ, কবিতা আবৃত্তি, পুতুল নাটক, বিতর্ক, চলচিত্র প্রদর্শনী, সঙ্গীতানুষ্ঠানসহ আরও নানা আয়োজন। প্রকৃতি আর বাংলা সংস্কৃতির এমন মেলবন্ধনের কারণে শিক্ষার্থীরাও থাকে সর্বদা স্ফূর্তিতে। তাই তো সেন্ট্রাল ফিল্ড, ক্যাফেটারিয়া, অমর একুশে, মুক্তমঞ্চ, শহীদ মিনারসহ ক্যাম্পাসের প্রতিটি স্থানই মুখরিত হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের আড্ডায়। এ বছর ৪৫তম বর্ষপূর্তিতে আয়োজন করা হয়েছিল চার দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা। লাল-নীল ঝাড়বাতি আর রঙ্গিন আলপনাতে যেন নতুন বউয়ের সাজে সেজেছিল পুরো ক্যাম্পাস। প্রথম দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করার মাধ্যমে উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলাম প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার। পরদিন পুতুল নাটক আর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেন নতুন মাত্রা লাভ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন। তৃতীয় দিনে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে মুক্তমঞ্চে ঝড় তোলে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ। পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয় শীতকালীন পিঠাপুলির মেলা। শেষদিন গত শুক্রবার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় পুরো ক্যাম্পাস। অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই ডে। সাবেকদের মজার মজার স্মৃতিচারণে আবেগাপ্লুত হন অন্যরা। প্রথম ব্যাচে ভর্তি হওয়া সেই দেড় শ’ শিক্ষার্থীকে দেয়া হয় সংবর্ধনা। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ফানুস উড়িয়ে জানান দেয়া হয় আকাশচুম্বী প্রত্যাশার কথা। সন্ধ্যায় নাচে আর গানে আবারও হেসে ওঠে সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চ। এ যেন আরও একটু এগিয়ে যাওয়ার শুরুতে বিজয়ানন্দ। জয়তু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। জয়তু জানবিবি।
×