ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দৃশ্যমান হচ্ছে মীরসরাই ইকোনমিক জোন

সাত লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির টার্গেট

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

সাত লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির টার্গেট

হাসান নাসির, প্রকল্প এলাকা ঘুরে এসে ॥ দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে দেশের বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল ‘মীরসরাই ইকোনমিক জোন’। এ যেন পদ্মা সেতুর মতোই বিশাল আরেক কর্মযজ্ঞ। চরাঞ্চলে সচল হয়েছে এস্কেভেটর, ড্রাম ট্রাক, রোলারসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি। সেখানে চলছে প্রথম পর্যায়ের মাটি ভরাটকাজ। বৃহৎ এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কর্মসংস্থান হবে সাড়ে পাঁচ থেকে সাত লাখ মানুষের। ফলে দারুণ প্রভাব পড়েছে সমুদ্রতীরবর্তী চরাঞ্চলের জনজীবনে। চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের চরাঞ্চলের মানুষ একদা ভাবত, এটা অলীক কল্পনা। শহর থেকে বড় বড় কর্মকর্তা আর বিদেশীরা যখন দামী গাড়ি নিয়ে অজপাড়াগাঁর উঁচু-নিচু সরু পথ মাড়িয়ে ইছাখালীর চর পর্যন্ত যেতেন, তখন এলাকার অনেকেই হাসাহাসি করত। এও কি সম্ভব! কিন্তু তারাই এখন আশায় বুক বেঁধেছে। পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেয়ার সরকারী দৃঢ়তায় বদলে যাবে চরের চেহারা, যার প্রভাব পড়বে পুরো মীরসরাই, চট্টগ্রাম ও দেশের অর্থনীতিতে। ইকোনমিক জোন ঘিরে বেশ ভালভাবেই নড়েচড়ে উঠেছে সেই সমুদ্রপাড়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামের মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল অনুমোদন করেন। এছাড়াও সরকারের পরিকল্পনার এক শ’টি ইকোনমিক জোনের মধ্যে ৪৬টি ইতোমধ্যেই অনুমোদিত হয়েছে। তন্মধ্যে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে মীরসরাই ইকোনমিক জোন। প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের পর থেকেই দৃশ্যমান হতে শুরু করে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি। সেখানে পরিদর্শন বেড়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা ও আগ্রহী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের। এরমধ্যেই কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি হয়েছে একটি চীনা কোম্পানির সঙ্গে। জোন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই একে ঘিরে সচল হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকা-। গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী এবং মীরসরাই এলাকার সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন কাজের অগ্রগতি প্রসঙ্গে বলেন, অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান। বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যে কতটুকু সম্ভবÑ এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি অনেক বিশাল একটি কাজ। মীরসরাইয়ের সমুদ্রতীরে যে পরিমাণ ভূমি রয়েছে তাতে হাজার হাজার শিল্পকারখানা গড়া সম্ভব। তবে উন্নয়নকাজ একটি চলমান প্রক্রিয়া। পুরোপুরি শেষ করা না গেলেও এ সরকারের মেয়াদেই এর অবকাঠামোগত দিক পরিস্ফুটিত হয়ে যাবে। ভূমি বরাদ্দসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ হবে এই মেয়াদের মধ্যে। বেজা সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে সরকারের এই মহাপ্রকল্পের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় রয়েছেÑ বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, ১০০ মেগাওয়াট সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট, কম্পোজিট প্ল্যান্ট, আইটি পার্ক, ট্যুরিজম পার্ক, ফোর লেন সংযোগ সড়ক, বিকল্প পোর্ট কানেকটিং সড়কসহ অনেক কিছু। মীরসরাই অতিক্রম করে এর সীমানা বিস্তৃত হবে পার্শ্ববর্তী ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা পর্যন্ত। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন অথরিটির (বেজা) চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানান, মীরসরাইয়ের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় যে পরিমাণ খাস জমি রয়েছে তাতে শিল্প জোন প্রায় ৩০ হাজার একর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা সম্ভব। দেশী-বিদেশী অনেক উদ্যোক্তা এখানে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এলাকা পরিদর্শন করে গেছেন চীন, জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের আগ্রহী উদ্যোক্তারা। তিনি জানান, প্রথম ধাপে ৫৫০ একর ভূমি ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে। সেখানে একটি লেকও হবে। প্রথমপর্বে সব মিলিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে ৬১০ একর ভূমি। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই এই কাজ শেষ হবে। আগামী অর্থবছরে ভরাট করা হবে আরও দেড় হাজার একর। ১৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্র প্রস্তুত হতে সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে এলাকায় যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুত সরবরাহ করবে আরইবি (রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন বোর্ড)। সে কাজ এগিয়ে চলেছে। কবে নাগাদ শিল্প উদ্যোক্তাদের জমি বরাদ্দ দেয়া হতে পারেÑ এ প্রশ্নের জবাবে বেজা চেয়ারম্যান জানান, প্রক্রিয়াটি বিডিং পর্যায়ে রয়েছে, কোন দীর্ঘসূত্রতা হবে না। বেজার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রথমে মুহুরী প্রজেক্টসংলগ্ন চরে ইকোনমিক জোনের বিষয়টি ভাবা হলেও সেখানে সহস্রাধিক মৎস্য প্রকল্প থাকায় দক্ষিণ দিকে প্রায় তিন কিলোমিটার সরিয়ে নেয়া হয় অর্থনৈতিক অঞ্চল। ইছাখালী, সাধুরচর ও নিলক্ষ্মীচর এলাকায় স্থাপিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত এই শিল্প জোন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে মীরসরাই ইকোনমিক জোনে প্রবেশের পথ থাকছে দুটি। তন্মধ্যে একটি বড়তাকিয়া পয়েন্ট দিয়ে আবু তোরাব হয়ে। অপরটি জোরারগঞ্জ দিয়ে মুহুরী প্রকল্প হয়ে। এই দুটি সংযোগ সড়ক ফোর লেন করা হবে। এছাড়া সাগরপাড় ধরে যে মেরিন ড্রাইভ নির্মিত হবে তার সঙ্গেও সংযুক্ত হবে শিল্পাঞ্চল। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র এবং শিল্পকারখানাগুলোর কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য আমদানি-রফতানির সুবিধার্থে সেখানে গড়ে উঠবে বন্দর সুবিধা ও কন্টেনার ডিপো। সব মিলিয়ে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ মীরসরাইয়ে। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ধু ধু চরে যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। সেখানে এখন শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা। তৈরি হচ্ছে নির্মাণ শ্রমিকদের থাকার আবাসন ব্যবস্থা। পানি সরবরাহের জন্য বসানো হচ্ছে বেশকিছু ডিপ টিউবওয়েল। মাটি কেটে তৈরি করা হচ্ছে ইকোনমিক জোনের অভ্যন্তরীণ সড়ক। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিনই অনেকেই দেখতে আসছেন অর্থনৈতিক অঞ্চলের কর্মকা-। মাটি ভরাটের কাজে নিয়োগপ্রাপ্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি জানান, তাদের দায়িত্ব প্রথম ধাপের মাটি ভরাটকাজ শেষ করা। অভ্যন্তরীণ সড়কটি হবে ২৪ ফুট চওড়া ও ১৪ ফুট উচ্চতার। এখন এ কাজে লাগানো হয়েছে ১০টি ড্রাম ট্রাক, পাঁচটি এস্কেভেটর, তিনটি ড্রেজার ও একটি রোলার। তবে যন্ত্রপাতি আরও বাড়ানো হচ্ছে। বেশ দ্রুত এ কাজ শেষ করার জন্য তাদের ওপর চাপ রয়েছে বলে তিনি জানান। এদিকে, অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই এলাকার সাধারণের মধ্যেও ব্যস্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেড়ে গেছে জমির দাম। অনেকেই সেখানে ছুটে যাচ্ছেন সুবিধাজনক জমির সন্ধানে। লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হলে সেখানে চাই শ্রমিকদের জন্য আবাসন ব্যবস্থা। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কয়েক কিলোমিটার এমনকি পুরো মীরসরাই এলাকায় ব্যক্তিপর্যায়ে নতুন বাড়িঘর করার হিড়িক পড়েছে। কেননা, দেশের বৃহত্তম এই ইকোনমিক জোন বাস্তবায়িত হলে এটিই হবে পরিকল্পিতভাবে দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প শহর।
×