ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আঁকিয়ে বুটপালিশওয়ালা

আমার ছবি, বস পছন্দ হইবো না আপনাগো...

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

আমার ছবি, বস পছন্দ হইবো না আপনাগো...

মোরসালিন মিজান ॥ জাত পাতের খেলায় অনেক পিছিয়ে বুটপালিশওয়ালারা। নিচু জাত। নিচু জাত তো বটেই। পায়ের কাছে বসে জুতোর ময়লা সাফ করেন। পুরনো জুতোয় রং করে চকচকে ভাব এনে দেন। তাতে শহুরে সাহেব বাবুদের ভাব বাড়ে বৈকি। এই সুন্দরকে যিনি গড়ে দেন উঁচুতে থাকা মানুষ তাঁর দিকে ফিরেও তাকান না। তাকানোর দরকার পড়ে না। তবে, রঞ্জিত দাসের দিকে তাকাতে হয়। হয়-ই। কারণ তিনি একইসঙ্গে শিল্পী। বুট পালিশের হাত দিয়েই সুন্দর ছবি আঁকেন! যখন কাজ থাকে না নিজের একান্ত জগতে প্রবেশ করেন রঞ্জিত। শত শত মানুষের আসা-যাওয়া, চিৎকার চেঁচামেচি, বিকট হর্ন ইত্যাদির কেন্দ্রে বসেই কেমন যেন একলাটি হয়ে যান। পাশে রাখা সরঞ্জামের বাক্সটিতে উপুর হয়ে শুরু করেন ছবি আঁকার কাজ! হ্যাঁ, এই যান্ত্রিক শহরের একজন বুটপালিশওয়ালা শিল্পকর্ম করেন। যখন আঁকেন তাঁকে ঘার ঘুরিয়ে না দেখে পারা যায় না! প্রফেশনাল শিল্পীর মতো করে আঁকেন না। ঘন ঘন পুরস্কার জেতা শিশু শিল্পীটি যেন ষাট বছর বয়সী রঞ্জিত দাস। শত ভেজালের শহরে এমন খাঁটি দৃশ্য অনেকেই উপভোগ করেন। জায়গাটা ফকিরাপুল। মুন হোটেলের উল্টো দিকে। চৌররাস্তার মোড়ে একটু জায়গা খুঁজে নিয়েছেন রঞ্জিত। গত সপ্তাহে সেখানে গিয়ে দেখায যায়, আশপাশটা যথারীতি ময়লা। কোন এক উৎস থেকে পানি গড়িয়ে নিচে নামছে। এর থেকে সামান্য সরে এসে মেঝেতে পসরা সাজিয়েছেন তিনি। সামনে বুটপালিশওয়ালাদের খুব চেনা বাক্সটি। কিছু স্যান্ডেল এলোমেলো পড়ে আছে। জুতো রং করতে দিয়ে অপেক্ষা করছেন কয়েকজন। রঞ্জিত তাই বিরতিহীন কাজ করে চলেছেন। এভাবে এক ঘণ্টার মতো সময়। যখন বিদায় নেন সব ‘কাস্টমার’, শিল্পী মানসটি দেখার সুযোগ হয়। রঞ্জিত দাস তাঁর ডান পাশে রাখা কাঠের বাক্সটি খুলেন। কিছু কাগজ বের করে বাক্সের উপর রাখেন। একটি চটের ব্যাগ থেকে হাতিয়ে নেন পেন্সিল। কালার পেন বের করেন। শুরু হয় ছবি আঁকা। প্রথমে পেন্সিল দিয়ে সুন্দর আউটলাইন টানেন। তার পর রং করার কাজ। ক্যানভাসে কোন এক নারীমুখ ফুলের মতো ফুটে উঠছিল সবে, বাধা হয়ে দাঁড়ান ‘কাস্টমার’। ছেঁড়া স্যান্ডেল মোটামুটি ছুঁড়ে মারেন রঞ্জিতের দিকেÑ ‘নে, কী সিলাই দিলি বেটা? দুই দিনেই গেলোগ্যা।’ মৃদু চোটপাটে ঘোর কাটে শিল্পীর। ছবি আঁকার সরঞ্জাম দ্রুত বাক্সে ভরে জীবন যুদ্ধে ফিরে আসেন। ছবি আঁকার হাতে তুলে নেন যারপরনাই নোংরা দেখতে স্যান্ডেল। ছেঁড়া জায়গাটুকু দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে টেনে দেখেন। তাঁর পর সেলাই। ছবি আঁকার সরঞ্জাম রাখা বাক্সের উপর বসেছিলেন স্যান্ডেলের মালিক। কাজের তদারকি করছিলেন। স্যান্ডেল নতুনের মতো হওয়ার পর টাকা পরিশোধ করে বিদায় নেন তিনি। সুযোগ বুঝে রঞ্জিত দাসের কাছে যান এই প্রতিবেদক। পরিচয় দিয়ে প্রথম প্রশ্ন- ছবি আঁকেন আপনি? উত্তরে শিশুর মতো হাসিটি। নিষ্পাপ আর যারপরনাই লাজুক হেসে বলেন, ‘এখনও সঠিক পারি না। আমার ছবি, বস, পছন্দ হইবো না আপনাগো।’ কেন পছন্দ হবে না? আপনি তো সুন্দর আঁকেন। একটু দেখাবেন? এবার যেন আরও লজ্জায় পড়ে যান। সঙ্কোচ নিয়েই বাক্সটা খুলেন। সামান্য নুয়ে একটা প্লাস্টিকের ফাইল বের করে আনেন। এটাই তাঁর স্কেচবুক। ভেতরে অনেকগুলো এ-ফোর সাইজের কাগজ। সাদা কাগজে করা কিছু পোর্ট্রটে। প্রতিটির পাশেই লেখা রয়েছে ‘রঞ্জিত আর্ট’। একটি ছবিতে বিপুল সাজে নারী। ফুলের ডালা হাতে দাঁড়িয়ে। কলমের লাল কালিতে তাঁকে ভরিয়ে দিয়েছেন শিল্পী। পাশে অনেকটা ক্যাপশনের মতো করে লিখেছেন- পুজোর সাজ। আরেকটি ছবিতে স্বামীর কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিচ্ছেন স্ত্রী। উজ্জ্বল রঙে উৎসবের আনন্দটা প্রকাশিত। পাশে লেখা রয়েছে- ‘বিজয়া দশমী সিঁদুর খেলার দিন’। ব্যাখ্যা করে শিল্পী বলেন, ‘দুর্গাপুজোর তারিখে উপয় পক্ষ স্বামী স্ত্রীকে ভালবাসে। তাই কপালে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়।’ কিন্তু ছবিগুলো কাদের দেখে আঁকা? জানতে চাইলে ভারতীয় একটি লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন চোখের সামনে মেলে ধরেন তিনি। বলেন, ‘এইখান থেইকা দেইখা দেইখা হার্ট করি।’ এবার বিষয়টি বোঝার পক্ষে সহজ হয়। ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া ছবি দেখে, দেখে দেখেই আঁকার অনুপ্রেরণা। ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে তাঁর আঁকা ছবিগুলো বেশ মিলিয়ে নেয়া যায়। অধিকাংশই বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের মডেলদের ছবি। হুবহু আঁকার চেষ্টা নয় শুধু। প্রায়শই নিজের সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কল্পনার জগৎ থেকে নিয়ে বিচিত্র যোগ বিয়োগ করেছেন। একটি ছবিতে উচ্ছ্বল তরুণীর হাসিমাখা মুখ। মডেল দেখেই আঁকা। তবে শিল্পী নিজ থেকে খুব যতœ করে একটি নাকফুল পরিয়ে দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে এই নারী যেন মোনালিসা হয়ে ওঠেন! বুটপালিশওয়ালারও আছে মোনালিসা! টমক্রুজকে তিনি জানেন ‘বিদেশী নায়ক’ হিসেবে। হলিউডের এই তারকাকেও এঁকেছেন। একটি ছবি ম্যাগাজিনের মডেল দেখে আঁকলেও, ক্যাপশন করেছেন নিজের মতো করে। লোকজ ভাবনা থেকে লিখেছেনÑ ‘আজ পাশা খেলব রে শ্যাম।’ এভাবে শিল্পী মনের যে সরল প্রকাশ, দেখে মুগ্ধ হতে হয়। তো, কবে থেকে এই ছবি আঁকার শুরু? কীভাবে? জানতে চাইলে নিজের মতো করেই বলেন, ‘দুই এক বসসর ধইরা আঁকতেছি। কামকাইজ না থাকলে, কিছু ভাল না লাগলে বইগুলা (ম্যাগাজিন) পড়তাম। ছবি দেখতাম। কলম দিয়া হাত ঘুরাইতাম। দেখতাম বইয়ের ছবিগুলার মতন হাত ওঠাইতে পারি কিনা, পা ওঠাইতে পারি কিনা। এমনি এমনি এখন আমি আঁকাই।’ কেউ কেউ নিজের ছবি দিয়ে যান। সেটি দেখেও দিব্যি এঁকে দেন রঞ্জিত। এ থেকে কখনও সখনও টাকা পান। কেউ কেউ কাগজ কলম কিনে দিয়ে সহায়তা করেন। এভাবেই চলে। আর প্রতিদিন আঁকা ছবি তিনি বিনামূল্যে বাচ্চাদের মধ্যে বিতরণ করেন। উদার মনের পরিচয় দিয়ে শিল্পী বলেন, ‘ইশকুলের মেয়েরা আইসা নিয়া যায়। আপনে যেমন পছন্দ করলেন, কইলেন এই ছবিটা আমারে দিয়া দেও। কী আর করা? দিয়া দেই।’ টাকা পয়সা নেই না। খুশি হইয়া নেয় তো!’ রঞ্জিতের জীবনের গল্পটাও সুন্দর। অভাব আছে। অভিযোগ নেই। কষ্ট নেই কোন। তাঁর নিজের ভাষায়, ‘১৩৬১ বাংলা জর্ম। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাব ডিবিশন। নাসিরনগর থানা।’ ফকিরাপুল এলাকাতে গত ৪০ বছর ধরে বুটপালিশের কাজ করেন। সকালে আসেন। বাড়ি ফেরেন রাত ১০টা নাগাদ। প্রতিদিন ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার। বউ আছে। দুই মেয়ের একজনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে তিনজন। সবাইকে নিয়ে ঋষিপাড়া বস্তিতে থাকেন। তাতে সুখ নষ্ট হয় না। সামান্য লেখাপড়া করেছেন জানিয়ে বলেন, ‘ছেলেরা এই কাজই (বুটপালিশ) করে। ভাল কাজে দিছিলাম, যায় না।’ নাইবা গেল, এ জন্য শিল্পীর মনে কোন বেদনা নেই। দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। মনে মনে সে প্রস্তুতি। আপনার মেয়েরা নিশ্চয়ই বাবার আঁকা ছবি খুব পছন্দ করে? প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপরাধী ভাব। রঞ্জিত বলেন, ‘ওরা পছন্দ করে না। কয়, এখন বয়স হইছে। ছবি আঁকা ভালা না।’ হয়ত তাই বাসায় তিনি ছবি আঁকেন না একদম। কারণ দেখান, ‘বাসায় তো ধরেন সময় থাকে না।’ কথা প্রসঙ্গে জানা যায়, সম্প্রতি রঞ্জিতের জমানো দশ হাজার টাকা কে যেন নিয়ে পালিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই খুব মন খারাপের গল্প? না, এ গল্পটাও হাসিমুখেই করলেন। জানালেন, সিএনজি অটোরিকশা ড্রাইভারদের সঙ্গে সমিতি করেছিলেন। ভেবেছিলেন, সিএনজি ড্রাইভার যেহেতু ঠাকাবে না। হয়েছে তাই। সমিতির নিয়ম মেনে প্রতিমাসে টাকা জমা দিয়েছেন তিনি। শেষ মাসে সব টাকা নিয়ে পালিয়েছে সমিতির নেতা। মাটির দিকে তাকিয়ে রঞ্জিত বলেন, ‘কী আর করা?’ তবে শিল্পীর মতে, সবাই এক নয়। ভাল মানুষও আছে। তাঁরা তাঁর বেশ কদর করেন। উদাহরণ হিসেবে দোকানি ও স্থানীয়দের কথা বললেন। সৈয়দ কামাল উদ্দীন নামের এক দোকানির সঙ্গে খুব ভাব। এই দোকানি জানালেন, খুব সজ্জন ব্যক্তি সনি মিয়া। সনি মিয়া কে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, রঞ্জিত দাস সনি মিয়া নামেও পরিচিত। বুট পালিশ করার পাশাপাশি মন দিয়ে ছবি আঁকেন। গানও গান। কথা শুনে মুখ লুকান রঞ্জিত। কিছুতেই স্বীকার করবেন না, গান করেন। তাঁর মতে, গান গাইলেই তো হবে না। গাওয়ার মতো না গাইতে পারলে গায়ক পরিচয় দেয়া ঠিক না। একই কারণে তিনি নিজেকে চিত্রশিল্পী ভাবতে নারাজ। বলেন, ‘এমনি হার্ট করি। তার মানেই শিল্পী না। শিল্পীগোরে তো চিনি। নাম বলতে পারি না। তারা তো বড়।’ বুটপালিশের কাজ বাদ দিয়ে শুধু ছবি আঁকার সুযোগ পেলে করবেন? জানতে চাইলে জাবাব- ‘না। আমি তো শিল্পী না। মন চায় বইলা আঁকি। আমি এমনেই ভালা আছি।’ তার মানে, কোন স্বপ্ন নেই আপনার? এ ক্ষেত্রেও অভিন্ন সুর। বলেন, ‘স্বপ্ন নাই। কষ্টও নাই কোন।’ সত্যি স্বপ্ন নেই? নাকি স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছে এই শিল্পী মন? দুঃখ নেই? নাকি, এইশিল্পীকে উদ্দেশ করেই মান্না দে গেয়েছিলেন- ‘দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি/ করেছে রাজার রাজা?’ কে দেবে উত্তর?
×