ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতিকর্মীদের বিক্ষোভ সমাবেশ

বি’বাড়িয়াকে পাকিস্তানের ছিটমহলে পরিণত করা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

বি’বাড়িয়াকে পাকিস্তানের ছিটমহলে পরিণত করা হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মোবাইল কেনার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার সহিংস রূপ নেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর। জ্বালিয়ে দেয়া হয় সুরসুম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনসহ বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রদায়িক শক্তির এই সহিংস হামলার প্রতিবাদে শনিবার বিকেলে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সারাদেশের নাট্যকর্মীদের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। এছাড়াও এদিন বিকেলে একই ঘটনায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। উভয় সংগঠনের পক্ষ থেকে সহিংসতা সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিচার ও তাদের প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়। বিকেলে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় বিক্ষোভ সমাবেশ করে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। ফেডারেশনের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেনÑ নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান, অভিনয়শিল্পী ইনামুল হক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর, পথনাটক পরিষদের সভাপতি মান্নান হীরা, ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ঝুনা চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী রফিকুল ইসলামসহ অনেকে। সমাবেশ সঞ্চালনা করেন ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল আক্তারুজ্জামান। রামেন্দু মজুমদার বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুরো ঘটনা পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, ওই সহিংসতায় শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের দোকানটি আক্রান্ত হতে পারত। অথচ আক্রমণ হয়েছে সুরস্রষ্টা আলাউদ্দিন খাঁর নামাঙ্কিত সঙ্গীতালয়সহ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। এ ধরনের সহিংসতার মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পাকিস্তানের ছিটমহলে পরিণত করা হয়েছে। মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে একটি উপলক্ষ সৃষ্টি করে এই তা-ব চালানো হয়েছে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আক্রমণের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রাজনৈতিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। ভোটের রাজনীতির কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এই সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না। বৃহৎ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ব্যর্থতা ঘোচাতে হবে। আতাউর রহমান বলেন, সহিংসতা ঘটানো অপশক্তির সঙ্গে সম্পৃক্তরা জানে না যে, সংস্কৃতির বিনাশ নেই। এটি সহজাত প্রক্রিয়ায় চলে। কোনভাবেই এর গতিপথ রুদ্ধ করা যায় না। মান্নান হীরা বলেন, মৌলবাদী শক্তির এমন ঝটিকা আক্রমণ অনেক দিন ধরেই হচ্ছে। আর সব সময়ই তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রগতিশীল মানুষ এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ইনামুল হক বলেন, এই অপশক্তি মোকাবেলায় কেবলমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে ভাবলেই চলবে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে না তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। রুখে দিতে হবে এই অপশক্তিকে। গোলাম কুদ্দুছ বলেন, এই ঘটনা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। কোন ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কারণে এমন ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। চক্রান্তের বহির্প্রকাশ হিসেবে তারাই ঘটিয়েছে এ ঘটনা। তবে কার ব্যর্থতায় এমন ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত করে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে এবং দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে এ ঘটনায় আগামীতে বৃহত্তর কর্মসূচী গ্রহণ করবে সংস্কৃতিকর্মীরা। ফকির আলমগীর বলেন, ওই ঘটনার মাধ্যমে সুরের শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে অসুরের শহরে পরিণত করেছে মৌলবাদীরা। লিয়াকত আলী লাকী বলেন, এই ঘটনার যথাযথ বিচার না হলে সংস্কৃতিকর্মীরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। আগামী সাত দিনের মধ্যে ঘটনার সুষ্ঠু বিচার না হলে আন্দোলনে নামবে সারাদেশের নাট্যকর্মীরা। এদিকে বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের দাবি জানিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংস্কৃতির ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক প্রবীর সরদার। বক্তব্য রাখেনÑ সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বংশধর শেখ সাদী খান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. শফিউদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডাঃ ইমরান এইচ সরকার, মঞ্চের অন্যতম সংগঠক মারুফ রসুল, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি অধ্যাপক বদিউর রহমানসসহ বিশিষ্টজনরা। সমাবেশে বক্তারা বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় উন্মত্ত, উগ্র, ধর্মান্ধ মাদ্রাসাছাত্রদের দ্বারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কিংবদন্তি সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামাঙ্কিত সঙ্গীত বিদ্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ, তাঁর ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র এবং স্মৃতিচিহ্ন ধ্বংস করা, জেলা শিল্পকলা একাডেমি কার্যালয়ে ভাংচুর, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্সসহ রেলস্টেশনসহ পুরো শহরে তা-বের ঘটনা কোন স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনা নয়। মোবাইল ফোনের দাম নিয়ে বচসার মতো সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে দিনব্যাপী তা-ব চালানো হলেও মূল লক্ষ্য ছিল প্রগতিশীল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনা বা মাদ্রাসাছাত্র ও দোকানির বচসা কোনটির সঙ্গে ওই সব সংগঠনের কারও সম্পৃক্ততা ছিল না। তাই এর পেছনে হীন উদ্দেশ্য বা মৌলবাদী চক্রান্তেরও উস্কানি রয়েছে সে বিষয়টি পরিষ্কার বলে মন্তব্য করেন বক্তারা। বক্তারা আরও বলেন, সারাদিন তা-ব চললেও তা ঠেকানো বা প্রতিহত করার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তেমন কার্যকর কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই মন্তব্য করে সমাবেশের বক্তারা সাত দিনের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সংস্কৃতির ওপর হামলা এবং তা-বের সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান। সংস্কৃতি রক্ষা তথা অস্তিত্ব রক্ষার এ লড়াইয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয় সমাবেশে। প্রয়োজনে দেশব্যাপী বৃহত্তর কর্মসূচী ঘোষণার কথাও জানান বক্তারা।
×