ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওদের কথা অনুযায়ী কাজ না করলে পদ্মা সেতু বন্ধ করে দেবে বলেছিল ॥ পুরস্কার ;###;বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

থ্রেট করা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

থ্রেট করা হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার প্রসারে সমাজের ধনী ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ ধরনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ সমাজে বিরাজমান সকল ধরনের কুসংস্কার, কূপম-ূকতা, ধর্মীয় উগ্র-জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তুলবে; যা উগ্র-ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকারের কার্যক্রমের সাফল্য নিশ্চিত করবে। তাই আমি সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, নিজ নিজ গ্রামের আশপাশের দরিদ্র মানুষকে সাহায্য করতে, মেধাবীদের উচ্চশিক্ষায় সহায়তা করতে, যাতে তারা বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। শনিবার শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালায় বেগম জেবুন্নেছা ও ২৭তম কাজী মাহবুবউল্লাহ পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে নানা চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি সরাসরি থ্রেট (হুমকি) পাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে নানা ভাবে নানা চাপ, দুটো বছর আমাদের ওপর যেন আজাব সৃষ্টি হয়েছিল। বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু বন্ধ করে দেবে, কোন একটি বিশেষ ব্যক্তিত্বের একটি ব্যাংকের এমডি পদে থাকা, না থাকার ওপর। আমাকে সরাসরি থ্রেটও করা হয়েছে। আমেরিকার অনেক ঊর্ধতন কর্মকর্তা এসে সরাসরি বলেছেন, এটা না করলে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ হবে। এই কথাও আমাকে সরাসরি শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি মুখের ওপর বলে দিয়েছিলাম, পদ্মা সেতু আমরা নিজেরা করতে পারব। আমরা তা পেরেছি। পদ্মা সেতু আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সে চ্যালেঞ্জকে ওভারকাম করতে সক্ষম হয়েছি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই ব্যাংকের (গ্রামীণ ব্যাংক) এমডির পদ আমার দেয়ার তো সামর্থ্য ছিল না। কারণ যার এই পদ তিনি তো কোর্টে মামলা করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে। সেই ব্যাংকের যে আইন সেই আইন ভঙ্গ করে ১০ বছর চালানোর পরও কোর্ট তার তো আর বয়স কমাতে পারে না। কোর্ট যদি বয়স কমিয়ে দিতে পারত তাহলে হতো। মামলা করে কেউ যদি হেরে যায়- সে দায়-দায়িত্ব তো আমাদের নয়, বাংলাদেশের জনগণেরও নয়। তিনি বলেন, এই পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের ওপর দুর্নাম দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। যার মূল টার্গেট ছিলাম আমি, আমার পরিবার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং সচিব কেউই বাদ যায়নি। ওই সময়ের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এমনভাবে একটি ধোঁয়াশা অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিল, যেন আমরা দুর্নীতি করে সব টাকা লোপাট করে দিয়েছি। একটি পয়সাও তারা দেয়নি, তার আগেই ধুয়া তোলা হলো। সেটা কেন এবং কার প্ররোচনায় করা হয়েছে, সেটা আমি বলতে চাই না। আপনারা তা ভাল করেই জানেন। কিন্তু এটাকে আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে একটা দেশ স্বাধীন করতে পারি তবে একটা সেতু নির্মাণ করতে পারব না, এটা হতে পারে না। আজকে আমাদের রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার। কাজেই আমরা নিজেরাই যে কোন বড় প্রজেক্ট করতে পারি। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু করব। কেউ টাকা দিলে দেবে, না দিলে না দেবে। কিন্তু আমরা যে নিজের টাকায় পদ্মা সেতু করতে পারিÑ সেটা আমরা দেখিয়ে দিয়েছি। ‘সততাই শক্তি’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে অনেক কথা বলে আমাদের মানসিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করেছেন। তবে আমি সব সময় বিশ্বাস করি সততাই শক্তি। যদি আমার সততা থাকে, ন্যায় আর সৎ পথে চলি তাহলে আমাকে কেউ টলাতে পারবে না। এই আত্মবিশ্বাস আছে বলেই আমরা আজ পদ্মা সেতু নির্মাণ করাতে পারছি। আর যেদিন থেকে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করেছি সেদিন থেকে বিশ্বের কাছেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও পরিবর্তন হয়ে গেছে, ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশকে আর অবহেলার চোখে দেখা যাবে না, বাংলাদেশ পারেÑ বিশ্বের কাছে এটা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে নিয়ে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনা করছি। এখানে নিজেদের কি হবে, নিজেরা অর্থ-সম্পদ বাড়াব এই চিন্তা তো কখনও করি না এবং করবও না। নিজের রাজনৈতিক লড়াইয়ে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনকে প্রেরণা দেয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সেখানে এত বড় বদনাম দেবেÑ এটা আমার কাছে কখনও গ্রহণযোগ্য ছিল না। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ১৬ কোটি মানুষ। এই ১৬ কোটি মানুষের শক্তিই তো বড় শক্তি। আমরা এই দেশকে নিয়ে গর্ব করি। কিছু রাজাকার স্বাধীনতাবিরোধী একটা অংশ থাকতে পারে, সেটা বাদ দিয়ে বাকি যে মানুষগুলো আছে প্রত্যেকে আমরা এক হয়ে এ দেশকে একটা সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই বাংলাদেশকে অনেকেই হেয়প্রতিপন্ন করত। কিন্তু এখন সেই জায়গায় বাংলাদেশ নেই। তিনি বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যথেষ্ট সক্ষমতা অর্জন করেছে। আমরা বাজেট ৫ গুণ বৃদ্ধি করেছি। ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা বাজেট বাংলাদেশ করবে এটা কখনও কেউ চিন্তা করতে পারেনি। আমাদের বার্ষিক কর্মসূচীর ৯০ ভাগ আমরা নিজস্ব অর্থায়নে করছি। তিনি বলেন, এসব সম্ভব হয়েছে কারণ আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি। যে সংগঠন গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ করে বিজয় এনেছে, আজ সেই সংগঠন সরকারে আছে বলেই উন্নয়নের ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছি। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেবল শিক্ষাই পারে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে। নিরক্ষরতা দূরীকরণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ৪৫ ভাগ। আমরা ক্ষমতা নেয়ার পর তা দ্রুত বেড়ে যায়। প্রতিটি জেলাকে নিরক্ষরমুক্ত করার জন্য কাজ করতে থাকি। ১৯৯৮ সালে অল্প সময়ের মধ্যেই সাক্ষরতার হার বাড়াতে পেরেছি। দেশের গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে পূর্ববর্তী সরকারগুলোর অবহেলার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর দেখি গবেষণার জন্য কোন বরাদ্দ ছিল না। কিন্তু গবেষণা ছাড়া কোন দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা তাই গবেষণায় বরাদ্দ বাড়িয়েছিলাম। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। কেউ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময় স্বাধীনতার ইতিহাস মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর কথা বলা তো তারা নিষিদ্ধই করে দিয়েছিল। কিন্তু সত্যকে কেউ কখনও চাপা দিয়ে রাখতে পারে না। সত্য উদ্ভাস হবেই, মানুষের সামনে আসবেই। আজ সে সত্য উদ্ভাস হয়েছে। সারা বিশ্বে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল জানিয়ে তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধিও অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫টি দেশের মধ্যে একটি, অচিরেই আমরা এটি তিনটিকে নামিয়ে আনব। বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান জোবায়দা এম লতিফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি, শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন, এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন এবং সংসদ সদস্য বেগম নিলুফার জাফরউল্লাহ বক্তব্য রাখেন। এবারের কাজী মাহবুব উল্লাহ স্মৃতিপদক প্রাপ্তরা হচ্ছেন- সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদানের জন্য আনিসুল হক, বিজ্ঞানে পাটের মলিকিউলার বায়োলজি নিয়ে বিশেষ গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাসিনা খান, খেলাধুলায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা এবং বিশেষ পুরস্কার হিসেবে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও এমিরেটাস অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী তাদের হাতে একটি করে ক্রেস্ট, সনদপত্র, এক লাখ টাকার চেক এবং উত্তরীয় তুলে দেন। উল্লেখ্য, শনিবার ছিল বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ জনকল্যাণ স্ট্রাস্টের ২৭তম পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। ১৯৭৮ সাল থেকে এই ট্রাস্ট পদক প্রদান করে আসছে।
×