খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ ধান চাষের জন্য বিখ্যাত বরিশালের বিভিন্ন উপজেলার আবাদি কৃষিজমি নষ্ট করে এস্কেভেটর মেশিনের সাহায্যে দিনরাত সমানতালে দ্রুত গতিতে মাছের ঘের, পুকুর, পান বরজ ও বাড়ি নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। ফলে ক্রমেই ধানের জমি কমতে শুরু করেছে। বিষয়টি দেখার যেন কেউ নেই। এতে করে সাধারণ কৃষকদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে জেলার গৌরনদী-সরিকল সড়কের পার্শ¦বর্তী বাটাজোর ইউনিয়নের পশ্চিম চন্দ্রহার গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, ওই এলাকার প্রায় দেড় শ’ একরের ইরি ব্লকের ফসলি জমির মধ্যবর্তী স্থানসহ রাস্তার পাশের জমিতে উন্নত প্রযুক্তির এস্কেভেটর মেশিনের সাহায্যে খনন করে মাছের ঘের, পুকুর, পানবরজ, বসতবাড়ি ও এনজিওর অফিস নির্মাণের জন্য মাটি কাটার ধুম পড়েছে। গত ১৫ দিন থেকে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীরা তাদের ক্রয় ও পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ফসলি জমিতে মাটি কাটার কাজ করাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ওই ইরি ব্লকের বিভিন্ন জমিতে প্রায় পাঁচ ফুট উঁচু করে অসংখ্য মাছের ঘের, পানবরজ, বসতবাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের জন্য মাটি কাটা হয়েছে। পাশাপাশি একাধিক জমি বিক্রির জন্য সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তিরা বলেন, যেভাবে জমি খননের কাজ শুরু হয়েছে, তাতে করে আগামী ২/৩ বছরের মধ্যে এ ইরি ব্লকে কোন জমি থাকবে না। তাছাড়া মাছের ঘের, পানবরজ, বসত বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনার আশপাশে বিভিন্ন প্রজাতের গাছ লাগানোর পর পার্শ¦বর্তী জমিগুলোর চাষাবাদ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই আগেভাগেই জমি বিক্রির হিড়িক পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ইরি ব্লকের মাঝখানে ১শ’ শতক জমিতে গত তিন দিন পূর্বে মেশিনের সাহায্যে মাছের ঘের বানিয়েছেন স্থানীয় কালাচাঁদ দাস, একইভাবে অভিলাস নন্দি তার ২০ শতক জমিতে, বাচ্চু মৃধা তার ক্রয়কৃত নয় শতক জমিতে মাছের ঘের নির্মাণ করেছেন। আলমগীর ফকির তার ১৬শতক জমি খনন করেছেন পানবরজ, মজলু মিয়া তার আট শতক জমিতে কলার বাগান, সরিকল এলাকার বাসিন্দা তমাল কাজী তার ক্রয়কৃত ২২শতক জমিতে পুকুর ও এনজিওর ভবন নির্মাণের জন্য মেশিনের সাহায্যে মাটি কাটার কাজ করাচ্ছেন। ইতোমধ্যে রাস্তার পাশের জমিতে মাটি কাটার পর বসতবাড়ি নির্মাণ করেছেন জনৈক তৈয়ব আলী নামের এক ব্যক্তি। সূত্রে আরও জানা গেছে, ওইসব এলাকায় বর্তমানে এক শতক জমির মূল্য প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আর এক শতক জমি মেশিনের সাহায্যে মাটি কেটে ভরাট করতে লাগে মাত্র ৫ হাজার টাকা।
একইভাবে জেলার আগৈলঝাড়া, বাকেরগঞ্জ, উজিরপুর, মুলাদী, মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, বানারীপাড়া, বাবুগঞ্জ ও সদর উপজেলার আবাদি জমিতে প্রকাশ্যেই চলছে মাটি কেটে পুকুর, মাছের ঘের, বসত বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ। গত দু’এক বছর পূর্বেও যেসব জমি ছিল ফসলের মাঠ তা এখন পুকুর, মাছের ঘের ও বসতবাড়িতে পরিণত হয়েছে। এতে করে অর্থনৈতিকভাবে কিছু কৃষক স্বাবলম্বী হলেও পর্যায়ক্রমে আবাদী জমির পরিমাণ কমে ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে ধান উৎপদান কমে যাবে। বিষয়টি যেন দেখার কেউ নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা কৃষি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, উৎপাদনের চেয়ে বাজারে ধানের দাম কম হওয়ায় কতিপয় কৃষক অধিক মুনাফার লোভে আবাদী জমি খনন করে মাছের ঘের ও পুকুর খনন করছেন। এতে করে ওইসব কৃষক লাভবান হলেও অন্যান্য চাষীরা ভবিষ্যতে জলাবদ্ধতা ও মাছের ঘের কিংবা পুকুরের পাশের রোপিত গাছের কারণে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। বরিশাল কৃষি অঞ্চলের বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল আজিজ ফরাজী বলেন, এতে করে ক্রমেই আবাদী জমি কমে যাচ্ছে।
যে কারণে ভবিষ্যতে ধান উৎপাদন কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুকুর, মাছের ঘের ও বসতবাড়ি করতে পূর্ব অনুমতির প্রয়োজন না থাকায় অপরিকল্পিতভাবে পুকুর, মাছের ঘের খনন করে অন্য কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। এজন্য তিনি আবাদী জমি খননকারীসহ কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা কামনা করেছেন। জেলা প্রশাসক ড. গাজী সাইফুজ্জামান বলেন, আবাদী জমিতে মাছের ঘের কিংবা পুকুর খননের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। জরুরী ভিত্তিতে এসব বন্ধের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নির্দেশ দেয়া হবে।