ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

থ্রি-হুইলার ও মোটরবাইক মেরামতেও পিছিয়ে নেই

গ্রামের নারী ॥ বাতি ঘরের আলো হাতে

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

গ্রামের নারী ॥ বাতি ঘরের আলো হাতে

গ্রামের যে নারীরা শীত নিবারণের জন্য কাঁথা তৈরি করে, তারাই সুঁই সুতায় নিপুণ হাতে সেলাই করে কাঁথার ওপর বাঙালীর ঐতিহ্য গ্রামীণ জীবনের নকশা বানিয়ে বিদেশে বিভুঁইয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে। দেশ পেয়েছে মর্যাদা। নকশী কাঁথা রফতানি করে নারীরা শুধু স্বাবলম্বী হয়নি, নিজের ও পরিবারের জীবনমান পাল্টে ফেলেছে। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন হয়েছে অটুট। সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলছে। গ্রামকেও করেছে উন্নত। এইসব গ্রামের পথে পা বাড়ালে নকশী কাঁথা তৈরির কারিগর নারীদের জীবনযাপন দেখে সহজেই অনুমান করা যায় কতটা উন্নত হয়েছে। গ্রামের ও শহরের যারা কল্পনাও করেনি নারী মোটরসাইকেল মেরামত করবে, নারী সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার চালাবে। তারা এখন নারীদের এমন শক্ত কাজ দেখে শুধু বিস্মিতই হয় না, আস্থা নিয়ে নারীদের কাছেই মোটরবাইক সারাতে যায়। মোটরসাইকেলের এক মালিক বললেন, নারী মেকানিক্সরা যতেœর সঙ্গে মেরামত করে। বেতের কাজের জন্য পূর্বাঞ্চলের যে সুনাম রয়েছে তা এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন গ্রামে। নদী তীরের এলাকার নারী এখন বাঁশ ও বেতের কাজ এত নিখুঁতভাবে করছে যে এই সামগ্রী রফতানি হচ্ছে বিদেশে। এ তিনটি দৃশ্য বগুড়ার তিনটি অঞ্চলের। তবে তা ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। গ্রামের নারীর হাতে তৈরি নকশী কাঁথা বিদেশে এতটাই প্রশংসিত হয় যে, বিদেশী এক্সপার্ট এসে নারীদের কাজ দেখে যায়। কাঁথাকে আরও উন্নত করতে পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিতে এ দেশে আসে। গত দশ বছর ধরে এই কাজের জন্য তারা আসছে। বিদেশীরা যে ধরনের নকশী কাঁথা পছন্দ করে গ্রামের নারী সেই ধরনের কাঁথা বানিয়ে দেয়। বগুড়ার চকলোকমান এলাকার পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিষ্ঠাতা আবু হাসনাত সাইদ নারীদের নকশী কাঁথার প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত জীবনমানের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নারী উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রাম হচ্ছে উন্নত। খড়ের ঘর পাল্টে টিনের চালার আধাপাকা ঘর হচ্ছে। বিদ্যুতের বাতি ও ফ্যান চলছে। ঘরে ঢুকছে টিভি ফ্রিজ। শিক্ষিত অনেক পরিবারের টেবিলে কম্পিউটারও দেখা যায়। স্মার্ট ফোন তো হাতের মুঠোয়। আবু হাসনাতের এই প্রতিষ্ঠানটি তালের আঁশের হস্তশিল্প, কুশন কভার দিয়ে যাত্রা শুরু করে। গাঁয়ের নারীদের হাতে তুলে দেয় নকশী কাঁথার নকশা ও সুঁই সুতা। যে কিষাণবধূ গৃহস্থালি কাজ ও ধান মাড়াই কাটাইয়ের মৌসুমে ধান সিদ্ধ শুকানোর কাজ করত, নবজাতকের ছোট্ট কাঁথা বানিয়ে দিত, তারাই শুরু করে বড় কাঁথা সেলাই। তার ওপর নকশা। এভাবেই এগিয়ে যায় নকশী কাঁথা তৈরির পালা। প্রথম দিকে উপকরণ সরবরাহ করত ওই প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ডিজাইন দেখিয়ে দিয়ে আগাম অর্থ দেয়। যাতে রফতানির সময় হেরফের না হয়ে সময় মতো বিদেশে পৌঁছে। নব্বই দশকের শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথম নকশী কাঁথা যায় কানাডা ও ব্রিটেনে। লন্ডনসহ ইংল্যান্ডের কয়েকটি শহরে এই নকশী কাঁথা যাওয়ার পরই কয়েকগুণ বেশি অর্ডার আসে। এরপর লন্ডন থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ডিজাইনার সুফি প্যাটেনসন বাংলাদেশে এসে গ্রামের নারী সুঁচিকর্মের শিল্পীদের সঙ্গে নকশী কাঁথা সম্পর্কে জেনে নতুন ধরনের ডিজাইন ও কাঁথার মানোন্নয়নে সহযোগিতা দেন। সুফি প্যাটেনসন ১৯৯৯ সালে প্রথম এই দেশে এসে পরিচিত হন গ্রামের নারীদের সঙ্গে। তিনি বাংলা ভাষা রপ্ত করে কথা বলেন। তারপর টেক্সটাইল ডিজাইনের নানা বিষয় সহজভাবে বুঝিয়ে দেন নারীদের। এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেন, যা দেখে এবং তার সঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে গ্রামের নারীরা নকশী কাঁথার নতুন ধারা তৈরি করে। সুফি প্যাটেনসন বছরে অন্তত দু’বার আসেন বগুড়ায়। বগুড়া সদরের নামুজা ধলমোহনী, জানাপাড়া, লাহিড়ীপাড়া, আটলাশ্যে, মহাস্থান, জাহানাবাদ, বেজোড়া গ্রামে গেলে চোখে পড়ে গৃহস্থালি কাজ করার মধ্যে কিভাবে কিষাণ বধূ ও তাদের মেয়েরা নকশী কাঁথা তৈরি করছে। সুতি কাপড় ছাড়াও সিল্কের কাপড়ের নকশী কাঁথা বানাচ্ছে তারা। বর্তমানে বিদেশে সিল্কের নকশী কাঁথার কদর বেড়েছে। নকশী কাঁথার অভিজ্ঞতা অর্জন করে ধলমোহনী গ্রামের কোহিনুর বেগম অন্যদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। কোহিনুর বেগম বলেন, গ্রামের অনেক মেয়ে এখন নকশী কাঁথা সেলাই করে পড়ার খরচ চালায়। তারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ছে। কোহিনুর বেগম নিজেও অষ্টম শ্রেণীতে পাঠের সময় নকশী সেলাই শিখে ¯œাতক পাশ করেছেন। নিজের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। বগুড়া গ্রামের নকশী কাঁথা বর্তমানে কানাডা ব্রিটেন জার্মানি ডেনমার্ক যাচ্ছে। সেখান থেকে অন্যান্য দেশে। এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। বগুড়ার নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকা সারিয়াকান্দি গ্রামের নারীরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় থ্রি হুইলার এবং মোটরবাইক মেরামতের মতো কঠিন কাজ বেছে নিয়েছে। বর্তমান সরকারের সময়ে সারিয়াকান্দিতে স্থাপিত মা ফাতেমা নারী প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন কমপ্লেক্সে বিভিন্ন ট্রেডের সঙ্গে থ্রি হুইলার মোটর ড্রাইভিং ও মেরামত, মোটরবাইক মেরামত প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছে নারী। ট্রেনিং নিয়ে কেউ চাকরিতে যাচ্ছে কেউ স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণ নিয়ে নিজেরাই গড়ে তুলছে গ্যারেজ। যেখানে তারা মেরামত করছে থ্রি হুইলার ও মোটরবাইক। সোনাতলায় জোড়গাছার জাহিদা সুলতানা ও সারিয়াকান্দির সীমা আক্তার এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে মোটর গাড়ি মেরামত করতে পারবেন। থ্রি হুইলার ও মোটরবাইক স্টার্ট দেয়ার শব্দ শুনে বুঝতে পারেন, কি হয়েছে। তারা মোটর গাড়ি চালানো শিখেছেন এবং আগামীতে তাও মেরামত করতে পারবেন। এই কাজ করে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে বাড়ি পাকা করেছেন। সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারছেন। টিভি ফ্রিজও কিনেছেন। নদী তীরের আরেকটি এলাকা বগুড়ার ধুনট। উপজেলা সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার ভিতরে জোলাগাঁতি পূর্বপাড়া গ্রামে প্রায় একশ’ পরিবার বাঁশ ও বেতের কাজ করে ছোট্ট শিল্প গড়ে তুলেছে। বর্তমানে তারা বেতের পাশাপাশি প্লাস্টিকের ব্যাটনে মোড়া বানাচ্ছে। এই পরিবারের পূর্বসূরিদের পেশা ছিল ডুলি ও পালকি বাহন। পরবর্তী প্রজন্ম জীবিকার প্রয়োজনে বেছে নেয় বেতের মোড়া তৈরির কাজ। প্রথমে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোড়া বেচাকেনা করেছে। এখন দূরের পাইকার এসে কিনে নেয়। গ্রামের নারীই এখন এই কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছে। গ্রামের ভবানী চন্দ্র জানালেন বছর দুয়েক হয় এই মোড়া বিদেশেও যাচ্ছে। ঢাকার মহাজনরা এসে বিদেশ উপযোগী করে মোড়া বানিয়ে নিয়ে যায়। মাঠপর্যায়ের এসব্ চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, নারীরা উন্নয়নের কতটা সহযোগী। নারীদের শিক্ষিত করে তোলার সঙ্গে প্রশিক্ষণ দিলে তারাই পরিবারকে সমৃদ্ধ করবে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×