ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ডাকঘর ও পোস্টমাস্টার

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

ডাকঘর ও পোস্টমাস্টার

মানুষের জীবনটা যদি সামগ্রিকভাবে এক কথায় প্রকাশ করতে বলা হয় তাহলে হয়ত বলা যায় আসা এবং যাওয়াই হচ্ছে মানুষের জীবনের মূল দর্শন। এই আসা এবং যাওয়ার ভেতরেই মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে আসে বিভিন্ন আনুষঙ্গিক উপকরণ। তেমনই একটা প্রয়োজনে এসেছিল পোস্টাল সার্ভিস বা ডাকসেবা। পৃথিবীজুড়ে ক্রমেই সৃষ্টি হয়েছিল অসংখ্য ডাকঘর। তখন এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যখন ডাকসেবা ছাড়া মানুষের স্বাভাবিক জীবন ছিল এক রকম অচল। মানুষের জীবনের মতো মানুষের জীবনের একান্ত কাছের অনেক জিনিসই হয়ত চিরস্থায়ী নয়। তাই ডাকবাক্স বা পোস্ট অফিসও আস্তে আস্তে সরে গেছে মানুষের প্রয়োজন থেকে অনেক দূরে। এখন পোস্ট অফিসের প্রয়োজনীয়তা এক রকম নেই বললেই চলে। সেই জায়গাটা পূরণ করে ফেলেছে মোবাইল ফোন আর ই-মেইল। এখন চোখের নিমেষে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যে কোন জরুরী বার্তা। দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও টাকা পৌঁছে যেতে এক মিনিটের বেশি সময় লাগছে না। এই মোবাইল ফোন অথবা ই-মেইলের গতি এত দ্রুত বলেই মানুষ এদের এত সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। এদের ব্যবহারের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ফেলেছে নিজেদের জীবন। জীবনে এদের উপস্থিতি ডাকবাক্সের মতো একান্ত নিভৃত নয়। এদের পদচারণা অনেক সরব, অনেক চঞ্চল এবং অনেক সবল। এদের ছাড়া মানুষের জীবন অর্থহীন সেই বার্তা তারা মানুষের মনে বদ্ধমূল করতে সার্থক হয়েছে। আর এই ডামাডোলের ভেতর নীরবেই নিজেকে গুটিয়ে অনেক দূরে সরে গেছে ডাকবাক্স। টিমটিম করে যেটুকু নিজের অস্তিত্ব এখনও টিকিয়ে রেখেছে সেটা যেন অনেকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেই। যুগ বদলাবে, মানুষ বদলাবে, বদলাবে মানুষের চাহিদা এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি আমাদের চাহিদার বস্তু যদি সঙ্গে সঙ্গে মিলে যায় তাহলে কিসের জন্য থাকবে আমাদের আশা, আমাদের আকাক্সক্ষা, আমাদের কল্পনা, আমাদের স্বপ্ন? সর্বোপরি সাধনা? কল্পনা ছাড়া, স্বপ্ন ছাড়া, সাধনা ছাড়া যে জীবন সে জীবনের সত্যিই কি কোন মূল্য আছে? পৃথিবীতে যত কালজয়ী সাহিত্য, সিনেমা, থিয়েটার, শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয়েছে তার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চিঠি মারফত আদান-প্রদান করা মানুষের মন উজাড় করা আবেগ, ভালবাসা। এই আবেগ, উচ্ছ্বাস মন পাগল করা ভাললাগা পৃথিবী থেকে উঠে যাচ্ছে বলেই কি আজ কমে গেছে ভালবাসা? ভালবাসার স্থান দখল করছে জঙ্গীবাদ? মানি অর্ডার এবং টেলিগ্রামের ভূমিকাও কিন্তু সমাজে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বেশিরভাগ পোস্টম্যানেরই জানা থাকত কখন কার বাসায় কি পরিমাণ মানি অর্ডার আসবে। তাই একগাল হাসি নিয়ে সেটা সে যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিত। বাড়ির লোকের সেই কৃতার্থ করা হাসির সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিত নিজের ভাললাগা। গ্রাম-গঞ্জে তথা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম, মানি অর্ডার পার্সেল ইত্যাদি সময়মতো পৌঁছে দিতে সে কি আপ্রাণ চেষ্টা ছিল পোস্টম্যান তথা ডাক হরকরা তথা রানারের, নিজের কাজের প্রতি সেই একাগ্রতা, সেই নিষ্ঠা, জীবন তুচ্ছ করা সেই আবেগ সাংঘাতিক সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে সুকান্ত ভট্টাচার্যের রচনায় সলিল চৌধুরীর সুরে আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘রানার’ গানটিতে। ই-মেইল, মোবাইলÑ এরা কি পারবে শিল্পী মনের এই আবেগের খোরাক যোগাতে? সমাজে পোস্টমাস্টারেরও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল, আর তাই তো পোস্টমাস্টারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী রচনা। পোস্টমাস্টার যার চিত্রটা দিয়েছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। পৃথিবী যত আধুনিক হচ্ছে, যত যান্ত্রিক হচ্ছে, তত কমে যাচ্ছে মানুষের মনের আবেগ, কামনা, বাসনা। আর এর ফলে শারীরিক রসায়নেও ঘটছে নানাবিধ জটিলতা, যার ফলে মানুষ হারিয়ে ফেলছে স্বাভাবিক প্রকৃতিগত সজীবতা, স্বতঃস্ফূর্ততা। এমন দিন হয়ত আসবে যখন মানুষের প্রয়োজনে আর মানুষ এগিয়ে আসবে না। আসবে না ডাক হরকরা, কাগজের হকার, সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা অথবা রকমারি দ্রব্যের ফেরিওয়ালারা। হয়ত মানুষের বাসায় প্রয়োজন পড়বে না রান্নাঘরেরও, তিন বেলা তিনটে ট্যাবলেট খেয়েই মানুষ পূর্ণ করবে খাবারের চাহিদা, কে বলবে, অচিরেই আসবে না তেমন দিন? সেলিনা জাহান মহাখালী, ঢাকা। ভিক্ষাবৃত্তি আর নয় যানজট, জনজট, জলজটের পরেই ভিক্ষুকের যন্ত্রণা। এই জ্বালাতন বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিটি সড়কে, রাস্তায়, হাটে-বাজারে, যানবাহনে, রেলগাড়িতে, টার্মিনালে, মসজিদে ভিক্ষুক জট সৃষ্টি করে যন্ত্রণার ফাঁদে ফেলে সাধারণ পথিকদের হয়রানি করছে। প্রাইভেটকারে যারা যাতায়াত করেন তাঁরাও এই যন্ত্রণা হতে মুক্ত নন । সারাদেশে বর্তমানে কয়েক লাখ ভিক্ষুক আছে। সর্বত্র এদের বিচরণ দেখা যায় একজন সক্ষম নারী বা পুরুষ, বালক বা বালিকা, শিশু-কিশোর বোবার অভিনয় করে ইশারা ইঙ্গিতে ভিক্ষা করছে। একজন ভাল মানুষ খামাখা মুখম-ল বাঁকা করে অভিনয়ের দ্বারা ভিক্ষা করছে। চোখে দেখতে পেলেও অন্ধের অভিনয় করে লোকজনকে বিভ্রান্ত করে ভিক্ষা নিচ্ছে। সচল মানুষ অচল ভিক্ষুক সেজে ভিক্ষা করছে। নিত্য নতুন নিয়ম বের করছে ভিক্ষা বৃত্তিতে। বাস, ট্রেন, লঞ্চে কম বয়সী মেয়েরা টাইপ বা কম্পোজ করা কাগজে নানা সমস্যার কথা বলে একটি কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে টাকা দিতে ইশারা করছে। আবার চকোলেট দিয়ে টাকা নিচ্ছে। মা-বাবার কিডনি নষ্ট হয়েছে, মেয়েকে বিবাহ দিতে হবে সবই ডাহা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করছে। বাসা বাড়িতে দলবদ্ধ হয়ে দরজার কাছে আওয়াজে নক করবে মাগো আমরা এসেছি ভিক্ষা দাও। পাঁচ বা দশ টাকা নেবে না, এক শ’ টাকা দিতে হবে। বলবে বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। আপনাদের বেতন অনেক বেড়েছে, বাড়ি, গাড়ি সম্পত্তির মালিক হয়ে আমাকে দেবেন না কেন? বাধ্য হয়ে বিদায় করতে হয়। হাতে ছেঁড়া কাপড়, যানজটে আচমকা আপনার গাড়ির পরিষ্কার গ্লাস একটু ঘষেই টাকা আদায় করে নিচ্ছে। রাজধানীর ওসমানি উদ্যান , রমনা পার্ক, শিশু পার্ক, চিড়িয়াখানাসহ অসংখ্য উদ্যানে এদের বাস। রাতে এই শ্রেণী অন্ধকার জগতে চলে যায়। এদের নেতা, উপ-নেতা আছে। প্রতিটি টার্মিনাল, বাস স্টেশনে কমিটির লোকজন দেশের দূর দূরান্ত হতে বড় বড় শহরে শ্রম দিতে আসা নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোরদের টার্গেট করে প্রলোভন দেখিয়ে এদের নিয়ে যায়। খাবার অর্থ, যাকাত ব্যবস্থা ও পরে কিছু ট্রেনিং দিয়ে চুক্তির মাধ্যমে পথে ছেড়ে দেয়। অর্জিত অর্থের ২০-২৫ শতাংশ পায় ভিক্ষুকরা, তাতেই পুষিয়ে যায়। বাসা বাড়িতে কাজ করে যে বেতন পাওয়া যায় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অর্থ আয় করে প্রতি মাসে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান ইতোমধ্যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রীকে ভিক্ষুকদের জন্য যথাযথ সম্মানজনক কর্মসংস্থান ও বাসস্থানের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। মেছের আলী শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ।
×