(১৫ জানুয়ারির পর)
তার মতে, এই নামকরণ যদি না হতো তাহলে হয়ত এই গুজব বেশি রটত না। আর বলা হয়ে থাকে, এই গুজব বেশি ছড়িয়েছিল জাসদ বা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। বলা হয়ে থাকে, সেনাবাহিনীতে তারা তাদের এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছে। কর্নেল তাহের ছিলেন এ রকম একজন এজেন্ট। সেনাবাহিনীতে থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন জাসদের একজন সক্রিয় সদস্য।
কর্নেল তাহের ছিলেন এজি বা এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল। সেনাবাহিনীর মানসিক বল উঁচুতে রাখা ছিল তার কাজ। কিন্তু তার কর্মকাণ্ড এই লক্ষ্যে ছিল না। তিনি প্রচলিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিলেন। জিয়া তাহেরকে উৎসাহিত করছিলেন সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য। দুজনই ছিলেন উচ্চাকাক্সক্ষী। পরে তাদের বন্ধুত্ব পরিণত হয় শত্রুতায়। জিয়া তাহেরকে ফাঁসিতে লটকান।
জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বিষয়টি আরও স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে ১৯৭৪ সালে একটি বিল পাস করায়। এর মাধ্যমে ওয়ারেন্ট ছাড়া রক্ষীবাহিনীকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হলো। এর ফলে দুই বাহিনীর সম্পর্ক আরও খারাপ হলো।
অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা যারা আত্মজীবনী লিখেছেন তাদের গ্রন্থেও রক্ষীবাহিনীর বিষয়টি এসেছে। তারাও শফিউল্লাহর মতো বলেছেন, রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে সে সময় যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তার কোনটিরই সত্যতা ছিল না, এগুলো ছিল গুজব। আর এসব পল্লবিত হয়েছিল। ফলে সেনাবাহিনীর কাছে রক্ষীবাহিনী হয়ে উঠেছিল স্পর্শকাতর একটি বিষয়।
৫. এর ওপর যুক্ত হয়েছিল আরেকটি ধারণা। সে ধারণাটি হলো, রাজনৈতিক নেতারা সেনাবাহিনীকে বিশ্বাস করতেন না। তারা দেখেছিল, রাজনৈতিক নেতারা সামরিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন এবং প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।
এখানে দুটি ঘটনার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এ ধরনের প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল কুমিল্লায়। সেনাবাহিনীর কাছে খবর ছিল সেখানকার মহিলা সংসদ সদস্য কিছু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন যা তার করা উচিত ছিল না। সেনাবাহিনী তার বাসায় তল্লাশি চালিয়ে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গুঁড়োদুধ উদ্ধার করে। ত্রাণের জন্য একজন এমপির বাসায় গুঁড়োদুধের মজুদ থাকতে পারে কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র তো থাকার কথা নয়। শফিউল্লাহ নিজে ওই এমপির বাসায় যান এবং তল্লাশি প্রক্রিয়া খুঁটিয়ে দেখেন। তাতে কোন ত্রুটি ছিল না। তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক বিষয়টি পছন্দ করেননি। বিশেষ করে তার এলাকায় সেনাবাহিনী যেভাবে কড়াকড়ি করছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, সেনাবাহিনী অন্যায় কাজ করেছে এবং জনগণের কাছে মহিলা ছোট হয়ে গেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি করেন, সেনাপ্রধানকে যেন সরিয়ে দেয়া হয়।
শফিউল্লাহ পরে পুরো ঘটনা বঙ্গবন্ধুকে বিবৃত করেন। তাজউদ্দীন আহমদও ছিলেন সেখানে। সব শুনে তিনি প্রস্তাব করলেন, একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে দেখা হোক সেনাবাহিনী তাদের সীমা লঙ্ঘন করেছে কিনা। তখন ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আর সেনাবাহিনীর বক্তব্য যদি ঠিক হয় তা হলে ওই মহিলাকে সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। তদন্ত কমিটি আর হয়নি। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ‘খন্দকার মোশতাকের মতো মানুষ ঘটনাটি ভোলেননি। যে কারণে ১৫ আগস্টের পর আমাকে বরখাস্ত করা হয়।’
কুমিল্লায় সেনা অভিযান চলাকালে ডালিম কিছু অঘটন সৃষ্টি করেন। ছাত্রজীবনে ডালিম ছিলেন ‘ডানপন্থী প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের’ সদস্য। শফিউল্লাহ অবশ্য এখানে একটু ভুল করেছেন ডানপন্থী কখনও ‘প্রগ্রেসিভ’ হয় না। খুব সম্ভব শফিউল্লাহ এনএসএফের কথা বলছেন। সেই সংগঠনে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে ছিল। ডালিম সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আগে যুক্ত ছিলেন তাদের সঙ্গে। ওই সময় বিরোধীদলীয় ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে তার কিছু দ্বন্দ্ব ছিল যার মীমাংসা হয়নি। ডালিম সে রকম প্রাক্তন কিছু ছাত্রকে তার দফতরে ডেকে পাঠান এবং নিপীড়ন করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক শফিউল্লাহকে জানালে তিনি তদন্তের নির্দেশ দেন এবং অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে ডালিমকে তিরস্কার করা হয় ও ওই ছাত্রদের মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। খুলনা, বরিশালেও ওই তল্লাশি নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। দুজন সেনা কর্মকর্তাকে শফিউল্লাহ প্রত্যাহার করেন। জিয়া এসব ব্যাপারে তাকে সাহায্য না করে বরং এসব বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেন। শফিউল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে সবই জানিয়েছিলেন। পরে ডালিম, নূর ও আরও কয়েক জনকে চাকরিচ্যুত করা হয় শফিউল্লাহকে না জানিয়ে। ফলে সেনাবাহিনীতে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। শফিউল্লাহ লিখেছেন, ‘ডালিম উচ্ছৃঙ্খল ছিল কিন্তু তারা নয়, সে জন্য তাদের এত বড় শাস্তির প্রয়োজন ছিল না।’ শফিউল্লাহর মনে হয়েছে তারা [ডালিম ব্যতীত] মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। তাদের এই শাস্তি প্রাপ্য ছিল না। এটা অবিচার হয়েছে। সেনাদের আওয়ামী লীগবিরোধী হওয়ার এটি একটি কারণ।
শফিউল্লাহ এরপর ডালিমের সঙ্গে গাজী গোলাম মোস্তফার সংঘাতের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনার নির্যাস সবার জানা। তাই এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করলাম না।
এ ঘটনার পর তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। সঙ্গে ছিলেন জিয়া ও কর্নেল শাফায়াত। সেখানে তিনি পুরো ঘটনা যা তিনি জানতেন তা তুলে ধরেন।
ঘটনার দিন ডালিম ও তার স্ত্রী গাজী গোলাম মোস্তফার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ৩২ নম্বরে আসেন। গাজীও আসেন। কর্নেল শাফায়াত জামিলও ছিলেন। হয়ত তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সামনে ডালিম খুব রূঢ় ব্যবহার করেন যাতে তিনি খুব অসন্তুষ্ট হন। মিলিটারি পুলিশ গাজীর বাসভবন ঘিরে আছে এ কথাও তখন এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল এরশাদকে জানানো হয়েছিল। শফিউল্লাহ এসব কিছুই জানতেন না। কারণ, শাফায়াত জামিল তাকে জানাননি যে, তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলেন, এরশাদ পরের দিন শফিউল্লাহকে জানান।
দু’দিন পর ২৪ জুন সদর দফতরে এ জন্য বেশ উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছিল। তাদের আশা সরকার গাজী গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তারা আরও অপেক্ষা করছিল তাদের সেনাপ্রধান কী করেন তা দেখার জন্য। জিয়াও তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করছিলেন না। এ পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া ও শাফায়াতকে নিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তারা প্রায় এক ঘণ্টা ছিলেন। তাকে খুবই বিরক্ত দেখাচ্ছিল। তিনি জানতে চাইলেন, মিলিটারি পুলিশ কেন বেসামরিক এলাকায় গেল কোন রকম কর্তৃত্ব ছাড়া। শফিউল্লাহ জানালেন, তারা কোন অসৎ উদ্দেশে যায়নি। তারা গিয়েছিল আর্মির একজন অফিসারকে উদ্ধার করতে। বরং গাজী গোলাম মোস্তফা যা করেছেন তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রপতি সে কথা শুনলেন না। তখন শফিউল্লাহ বললেন, ‘স্যার গাজী গোলাম মোস্তফা গুরুতর একটি অপরাধ করেছে এবং তার শাস্তি হওয়া উচিত। না হলে সৈনিকদের ওপর এর অভিঘাত খারাপ হবে।’ এ কথা শুনে রাষ্ট্রপতি আরও বিরক্ত হলেন।
চলবে...