ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সর্বস্তরে সংগঠন পুনর্গঠনেরও উদ্যোগ

দল চাঙ্গা করতে জেলা সফরে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

দল চাঙ্গা করতে জেলা সফরে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া

শরীফুল ইসলাম ॥ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। বার বার আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর সদ্যসমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনেও ভরাডুবি হয় দলটির। এ পরিস্থিতিতে দলের দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠতে নানামুখী কৌশল নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। এর অংশ হিসেবেই দলের সিনিয়র নেতারা অতীতের ভুল-ত্রুটি স্বীকার করছেন। সেই সঙ্গে সর্বস্তরে দল পুনর্গঠনের উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে। আর মাঠের রাজনীতি চাঙ্গা করতে শীঘ্রই বিভিন্ন জেলা সফরে যাচ্ছেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। সূত্র মতে, ৩০ ডিসেম্বরের পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোড় ঘুরানোর পথ তৈরি করে দেয়। তাই আগে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন নিয়ে স্বোচ্ছার থাকলেও এখন আন্দোলন থেকে সরে এসে ভিন্ন কৌশলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ জন্যই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে ৫ জানুয়ারির সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে সংলাপ করে দেশের সমস্যা সমাধানের পথ বের করা এবং সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া তিনি প্রতিবেশি দেশ ভারতকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জঙ্গীবাদকে প্রশ্রয় দেব না এবং দেশের মাটি ব্যবহার করে কাউকে অন্য দেশের ওপর হামলা করতে দেয়া হবে না। আর ৫ জানুয়ারির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যেন কোন জটিলতা তৈরি না হয় সে জন্যই জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের কোন শরিক দলকে সেখানে ডাকা হয়নি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের কিছু ভুল-ত্রুটি আছে বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমাদের অনেক ত্রুটি রয়েছে। অনেকদিন ধরে আমরা বিরোধী দলে আছি। আন্দোলনে হয়তো সেভাবে সফলতা অর্জন করতে পারিনি। তবে প্রতিটি আন্দোলনেরই উত্থান-পতন থাকে। এর আগে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজউদ্দিন আহমেদসহ আরও ক’জন নেতা নিজেদের ভুল-ত্রুটি শোধরে নেয়ার কথা বলেছেন। সম্প্রতি আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপির থিঙ্কট্যাংক হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এমাজউদ্দিন আহমেদ তরুণদের প্রাধান্য দিয়ে বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনের আহ্বান জনিয়েছেন। তিনি বলেন, যাদের বয়স চল্লিশের কোটায় তাদের প্রাধান্য দিয়ে কমিটি গঠন এবং প্রবীণ নেতাদের সম্মানিত জায়গায় স্থান দিতে হবে। এদিকে দলের ঝিমিয়ে পড়া নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে শীঘ্রই বিভিন্ন জেলা সফরে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ সফরে গিয়ে তিনি সদ্যসমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনের বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরার পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় সংগঠন পুনর্গঠনের তাগিদ দেবেন। সেইসঙ্গে বর্তমান সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরে জনদৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি দলের নেতাকর্মীদের পরবর্তী নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদারেরও নির্দেশ দেবেন। এভাবে কিছু জেলা সফর কর্মসূচী শেষ করে দলের জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতিও এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবেন তিনি। এবারের কাউন্সিলে দলের তরুণ নেতাদের প্রাধান্য দিয়ে কমিটি করার কথা খালেদা জিয়াও ভাবছেন বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত গতবছর ৬ জানুয়ারি থেকে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবিতে টানা আন্দোলন করতে গিয়ে জ্বালাও-পোড়াওসহ ব্যাপক সহিংস কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে বিএনপি। তবে আন্দোলন ছেড়ে গুলশান কার্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পর কিছুটা নিরব হয়ে যান তিনি। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডন গিয়ে ছেলে তারেক রহমানসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিছুদিন অবস্থান করে ২১ অক্টোবর দেশে ফিরে আসেন তিনি। এরপরই রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এবারের ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে বিএনপি আবার নাশকতামূলক আন্দোলন কর্মসূচীতে যায় কি না বিভিন্ন মহাল থেকে এমন আশঙ্কা করা হয়। কিন্তু এমন আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেন। আর সরকারও বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। ওইদিন একটি সফল সমাবেশ করলেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ওই সমাবেশ থেকে কোন আন্দোলন কর্মসূচী না দিয়ে বেশকিছু ইতিবাচক কথা বলে জনদৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, দলীয় হাইকমান্ড ধরে নিয়েছেন আন্দোলন করে এ সরকারের কাছ থেকে কোন দাবি আদায় করা যাবে না। বরং আন্দোলন করতে গেলে দলের নেতাকর্মীরা সরকারের আরও বেশি রোষানলে পড়বে। তারচেয়ে ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সাংগঠনিকভাবে দলকে এগিয়ে নেয়া গেলে সেটি হবে দলের অর্জন। তাই আপাতত আন্দোলনে না গিয়ে ইতিবাচক কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে দলকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আপাতত জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের কিছু শরিক দলের সঙ্গেও দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করা হবে। আর নিজ দলের সব নেতাকে না ডেকে এখন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ক’জন নেতাকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিয়ে তা সঠিকভাবে করার চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়া। গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করার আগে দলের কিছু নেতার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদসহ কিছু জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীর পরামর্শ নিচ্ছেন। প্রসঙ্গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ২০১৩ সালের শেষের দিকে দেশব্যাপী জ্বালাও-পোড়াওসহ ব্যাপক নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী পালন করে বিএনপি। কিন্তু তাদের আন্দোলন উপেক্ষা করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে বিএনপি তাদের সমমনা দলগুলোকে নিয়ে ওই নির্বাচন বর্জন করে। কিন্তু সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিএনপির আন্দোলন নিয়ন্ত্রণ করে। এ পরিস্থিতিতে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসে। কিন্তু নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ে বিএনপি জোট। গতবছর ৫ জানুয়ারি সরকারের একবছর পূর্তির দিনে সারাদেশের নেতাকর্মীদের ঢাকায় ডেকে এনে বড় ধরনের সমাবেশ করতে চায় বিএনপি জোট। কিন্তু জননিরাপত্তা বিঘœ হওয়ার আশঙ্কায় তাদের সমাবেশ করতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর প্রতিবাদে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বাসা ছেড়ে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থান করে সারাদেশে টানা ৯২ দিন অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচী পালন করেন। এ কর্মসূচী পালনকালে বিএনপি জোটের পিকেটাররা পেট্রোল বোমাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা- চালালে প্রায় দেড়শ’ মানুষ প্রাণ হারায়। পঙ্গু হয় আরও শতাধিক মানুষ। আর যানবাহনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর করায় দেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এক পর্যায়ে এ আন্দোলনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের মানুষ সোচ্চার হয়। এমন পরিস্থিতিতে ওই বছর ৫ এপ্রিল আন্দোলন কর্মসূচী স্থগিত করে নিম্ন আদালতে হাজিরা দিয়ে গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ ফিরে যান খালেদা জিয়া। বাসায় ফেরার পর বেশ ক’দিন তিনি বাসা থেকে বের হননি। এমনকি গুলশান কার্যালয়েও যাননি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেরই নিজস্ব কৌশল থাকে। সে রকম কৌশল বিএনপিরও আছে। আর এ কৌশলেই বিএনপি আপন গতিতে আবারও এগিয়ে যাবে। আর দলের কিছু ভুল-ত্রুটি স্বীকার করে আমরা উদারতার পরিচয় দিয়েছি। এটাকে জনগণ ইতিবাচক হিসেবেই নেবে। আমরা মনে করি, দল গুছিয়ে আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেলে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সরকারকে সংলাপের কথা বলেছেন, দেখা যাক তারা কি করে। আলাপ-আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা না হলে আবারও সুবিধাজনক সময়ে আন্দোলন করা যাবে। এর আগে সারাদেশের সর্বস্তরে দলের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করা গেলে তা হবে বিএনপির জন্য ইতিবাচক।
×