ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যও হতে পারছে না বাংলাদেশ এ কারণে

চিড়িয়াখানা আইন দুই মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতায় আটকা

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

চিড়িয়াখানা আইন দুই মন্ত্রণালয়ের  বিরোধিতায় আটকা

তপন বিশ্বাস ॥ দুই মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতায় আটকে রয়েছে চিড়িয়াখানা আইন। এ নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রীতিমতো বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বন মন্ত্রণালয় বেসরকারী চিড়িয়াখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চিড়িয়াখানা আইনটি করতে দিচ্ছেন না। তবে ভিন্ন কথা বলছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, এ আইনের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ‘বাণিজ্য’ করতে যাচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে চিড়িয়াখানা আইন করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে তারা। আইনটি না হওয়ায় চিড়িয়াখানা ও প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সদস্য হতে পারছে না বাংলাদেশ। কোন সহযোগিতাও পাওয়া যাচ্ছে না ওই সব সংগঠন থেকে। সরকারী দুটি চিড়িয়াখানা (মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুর চিড়িয়াখানা) পরিচালনায় জটিলতা নিরসনসহ ব্যবস্থাপনাকে আইনগত ভিত্তি দিতে আইন করা প্রয়োজন। এছাড়া বেসরকারী ও ব্যক্তিপর্যায়ে গড়ে ওঠা চিড়িয়াখানাগুলোর ওপরও সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ব্যবহৃত হবে এ আইন। এ আইনের বিষয়ে দুটি মন্ত্রণালয় ঐকমত্যে আসতে না পারায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী তথা মন্ত্রিসভার ওপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে শীঘ্রই একটি প্রস্তাব প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সবকিছু তারা (পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়) তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী তো বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালনের জন্য তাদের অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু এ্যালোকেশন অব বিজনেস (মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধি) অনুযায়ী এগুলো তাদের আওতাভুক্ত নয়। এমন একটি আইন হওয়ার সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বাধা দেয়ার প্রয়োজন ছিল, তা কেন দেয়া হয়নি বুঝতে পারছি না। ২০০৮ সাল থেকে চিড়িয়াখানা আইন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, শেষপর্যন্ত ২০১২ সালে মন্ত্রিসভা বৈঠকে খসড়া আইনটি পাঠানো হয়। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আপত্তির মুখে কিছু পর্যবেক্ষণসহ মন্ত্রিসভা খসড়াটি ফেরত দেয়। ২০১২ সালের ২ আগস্ট মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘বাংলাদেশ চিড়িয়াখানা আইন’-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলেও তা ফেরত পাঠানো হয়। তখনকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা জানিয়েছিলেন, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের সঙ্গে কিছু বিষয় সাংঘর্ষিক থাকায় আইনটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। সে সময় তিনি আরও জানান, আইনটি নিয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে আরও সংশোধন ও সংযোজন করে নতুন করে আইনটি মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বহুবার বৈঠক হয়েছে। বহুবার আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং হয়েছে। সেখানে বন মন্ত্রণালয় আপত্তি দিয়েছে, সেই আপত্তি আমরা নিষ্পত্তি করেছি। পরের মিটিংয়ে এসে তারা বলে, না আমরা এটা বলিনি। লিখিত মতামত চাইলে সেটা আবার দেয় না। শেষপর্যন্ত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রী বন সচিব ও মন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন। তারা জবাব দেন। এর মধ্যে মন্ত্রিসভার নির্দেশনা অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া ও রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী দুই মন্ত্রণালয় ঐকমত্য না হওয়ায় আমরা সিদ্ধান্তের জন্য ২০১৪ সালের এপ্রিলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছিলাম। বন মন্ত্রণালয় কোথায় কোথায় দ্বিমত পোষণ করে সেগুলোও বিশেষজ্ঞদের মতামত আলাদা ছকে দেয়ার জন্য বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কয়েক দিনের মধ্যেই এটা মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য পাঠানো হবে। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী দেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, যদি আইন করার প্রস্তাব গ্রহণ করা না হয় তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ্যালোকেশন অব বিজনেস (কার্যপরিধি) পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। তা না হলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে এটা (আইন) ফলো করতে হবে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, মূলত বন অধিদফতরের কর্মকর্তারা চিড়িয়াখানা আইনের বিরোধিতায় নেমেছেন। তারাই পরিবেশমন্ত্রী, সচিবকে ‘ভুল’ বুঝিয়ে এ আইনটি বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের ‘বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২’ একটি সমন্বিত আইন। এর সঙ্গে চিড়িয়াখানা আইনের কিছু ধারা সাংঘর্ষিক। বাঘ যখন বনে থাকে তখন সেটা বন্যপ্রাণী, বাঘ যখন চিড়িয়াখানায় থাকে তখন সেটি প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন। আমরা যদি বন থেকে প্রাণী ধরে চিড়িয়াখানায় রাখি তবে বন থেকে এগুলো হারিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য হলো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ব্যবসা করা নয়। ‘দে ওয়ান্ট মেক সাম ট্রেড এ্যান্ড বিজনেস (প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়)’। তিনি বলেন, চিড়িয়াখানা আইন করতে আমরা বাধা দিচ্ছি না, বরং তারাই (প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়) আমাদের বাধা দিচ্ছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বিধিমালা করেছি ২২টি। তারা প্রত্যেকটি বিধিমালার বিষয়ে আপত্তি দিয়েছে। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, চিড়িয়াখানায় তো কোন রিপ্রোডাকশন হয় না, প্রতিবছরই প্রাণী মারা যায়। ক্যাপটিভ ব্রিডিংয়ের (বন্দী প্রাণীর প্রজনন) যে ক্যাপাসিটি থাকা দরকার তা বাংলাদেশে একেবারেই নেই। আমরা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কাজ করি, বনের প্রাণী বনেই থাকবে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল আমরা আরও উন্নত করব। তিনি বলেন, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ময়মনসিংহের ভালুকায় একজনকে গুঁইসাপের খামারের অনুমোদন দিয়েছে। সে উৎপাদন না করে বন থেকে ধরে রফতানি করত। চিড়িয়াখানা আইন হলে আমাদের বন থেকে সরীসৃপ ধরে রফতানি করবে, কিছু লোকের পকেট ভারি হবে। তাহলে দেশে তো কোন চিড়িয়াখানা করা যাবে নাÑ এমন মন্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, চিড়িয়াখানা থাকবে। কিন্তু জাতীয় চিড়িয়াখানার বাইরে আইন অনুযায়ী যে খামার বা ব্যক্তিপর্যায়ে চিড়িয়াখানা করার জন্য অনুমোদন দেবে সেটাই হলো চ্যালেঞ্জ। আমরা চাচ্ছি ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোন চিড়িয়াখানা বা এ জাতীয় কিছু না হোক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত খসড়াটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খসড়া আইনে চিড়িয়াখানায় জন্ম দেয়া উদ্বৃত্ত প্রাণী বিনিময় ও হস্তান্তরের বিধান রাখা হয়েছে। বেসরকারী চিড়িয়াখানা অনুমোদন দেয়ার বিধানও থাকছে এতে। ব্যক্তিপর্যায়ে চলমান চিড়িয়াখানাগুলোকে নিবন্ধন ও খাঁচায় পাখি ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমোদন দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে খসড়া আইনে। এছাড়া প্রদর্শনের অনুপযুক্ত বয়স্ক প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যুর ব্যবস্থা, প্রতিটি চিড়িয়াখানায় আধুনিক ভেটেরিনারি কেয়ার হাসপাতাল রাখা, ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে খসড়ায়। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আইনী কাঠামো না থাকায় চিড়িয়াখানায় বড় ধরনের উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। ব্যবস্থাপনাকে আইনী কাঠামো দেয়া যাচ্ছে না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে চিড়িয়াখানার জন্য একটি সমন্বিত আইন দরকার।
×