ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে...

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে...

সমুদ্র হক বাঙালীর প্রবাদে আছে ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’। এখন বাঘ পালানো তো দূরে থাক রোদের মধ্যেও আসে না। পৌষের শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল শীত বেশ জেঁকেই বসবে। তা বুঝি আর এলো না। যদিও আবহাওয়া বিভাগ বলেছে জানুয়ারিতেই কয়েকটা শৈত্য প্রবাহ আসবে। এখন সেই মাসের মধ্যভাগ পার হয়ে গেল। শৈত্য বাবুর দেখা নেই। খুব ঘন কুয়াশা আর শিশিরও নেই, যা আছে তা সহনীয়। মাঘ মাসে হিমেল যে বাতাস বয় তাও নেই। তবে হালকা বাতাস আছে। যা শরীরে কাঁটার মতো বিঁধে না। বর্তমানের যে শীত তা ‘শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকির এই ডালে ডালে.....’। কবিগুরুর কবিতার এমন ছন্দ মনে করিয়ে দেয়। হিমালয় পাদদেশীয় উত্তরাঞ্চলে শীতের ছোবলে যে হাড় কাঁপুনি শীতে কাহিল হয়ে পড়ে হাজারো মানুষ এখন তা নেই। গ্রামাঞ্চলে আজও শীতের আরেক নাম জাড়। নদী তীরের মানুষ এখনও বলে ‘কী জাড় লাগিচ্ছে। ঠকঠক করে কাঁপা শুরু হছে। মাঘ মাসত আর বাঘক পালান লাগবি ন্যা, হামরাই পালামো’। তবে এবার এই কথাগুলো নেই। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কথাÑ জলবায়ু পরিবর্তনের পালায় এখন আর শীত বেশিদিন থাকে না। সাধারণের কথাÑ শীত বুঝি মৌসুমী কিস্তির শীতেই পরিণত হলো। নিকট অতীতে শীতের যে রূপ ছিল তার ব্যত্যয় ঘটেছে। এখন শীত আসে দেরিতে। এসেই যাই যাই করে। গানের সুরে যদি বলা হয় ‘..একটু বসো অনেক কথা বলার ছিল যদি গো শোন...’ তবু বেঁধে রাখা যায় না। শীতের সঙ্গে কুয়াশাতেও ধুলোবালি মিশে পরিবেশ দূষণ করছে। গোধূলী বেলা শুরু না হতেই কুয়াশা নেমে রাতভর শিশিরের সঙ্গে মিতালি করে সকাল পর্যন্ত কোন রকমে থেকে পালিয়ে যায়। সূর্যের আলোকে ঢেকে দেয়ার সুযোগই পায় না। বর্তমানের শীত সেদিনের মতো টানা দুই মাস ও তার চেয়ে কিছুটা বেশি সময় ধরে থাকে না। মনে হবে শীত আসছে প্রকৃতির সঙ্গে কিস্তির চুক্তিতে। এই শীত এলো। খানিকটা সময় থেকে চলে গেল। ফের এলো শৈত্য প্রবাহ নিয়ে। দিন কয়েক ঠকঠকিয়ে হাঁড় কাঁপিয়ে চলে গেল। আবহাওয়া বিভাগ অবশ্য শৈত্য প্রবাহের আগাম সূচী জানিয়ে দেয়। কখনও এ সূচী বহাল থাকে। কখনও উল্টো হয়ে যায়। উত্তরে বায়ুর সঙ্গে আসা বর্তমানের কিস্তির শীতে থেমে থাকে না জীবনের পথ চলা। কৃষক ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে ফসলের মাঠে যায়। চলমান জীবনের ধারায় মানুষ কাজের জন্য বের হয়। শহরের মানুষ গায়ে কয়েক প্রস্থ কাপড় চড়িয়ে পথে নামে। গ্রামের মানুষের গায়ে অত কাপড় চড়াতে হয় না। শীতকে সয়ে নিয়েছে। একটা সময় শীত এলেই গ্রামের মানুষ গরম কাপড়ের জন্য অপেক্ষায় থাকতো। এখন দরিদ্রতার হার কমে যাওয়ায় গ্রামে প্রায় সকলের ঘরে শীতের কাপড় আছে। গ্রামের বেশির ভাগ ঘরবাড়ি এখন টিনের চালায় আধা পাকা। খড়ের ঘর নেই। নিকট অতীতে কুঁড়েঘরের ছিদ্র দিয়ে শীতল হাওয়া ঢুকে কাহিল করে দিত। এখন এ দৃশ্য নেই। টিনের ঘর আছে। যেখানে হিমশীতল হাওয়া প্রবেশ করে না। শীতের চিরন্তনের মধ্যে আছেÑ সকালে মিষ্টি রোদে গা এলিয়ে উষ্ণতা নেয়া। রোদে দাঁড়িয়ে ও বসে খেজুর রসের সঙ্গে মুড়ি খাওয়া, বই পড়া। সকালে ও রাতে গ্রামের উঠানে খড় লতাপাতা বিছিয়ে আগুন ধরিয়ে চার ধারে বসে তাপ পোহানো। টিউবওয়েলের পানি কিছুটা ফেলে দিয়ে একটু উষ্ণ পানি এলে গোসল করা। শহুরে জীবনে গ্যাসের চুলা ও সাধারণ চুলায় গোসলের জন্য পানি গরম করে নেয়ার পালা। যাদের ঘরে গিজার আছে তাদের তো কথাই নেই, পানি গরম হয়েই শাওয়ারে ঝরে। উচ্চবিত্তদের ঘরে রুম হিটারও আছে। শীতকে বশ মানাতে কতই না আয়োজন। বাঙালীর জীবনে শীতের সবচেয়ে বড় অনুষঙ্গ পিঠা। শীত আসবে পিঠপুলি হবে না তা কি হয়। পিঠা ছাড়া শীত বেমানান। নিকট অতীতে পাটিসাপটা দুধপিঠা গড়গড়েপিঠা কুলিপিঠা ও তেলপিঠাসহ আরও কত পিঠা বানানো হতো ঘরে ঘরে। এখন এর সঙ্গে শহুরে জীবনে যোগ হয়েছে পিঠা উৎসব। শীতের সাজগোজ আরেক অনুষঙ্গ। বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় এ সাজ সকলের জীবনেই এসেছে। গাঁয়ের বধূও এখন বাহারি শাড়ির ওপর সুন্দর শাল জড়িয়ে নেয়। পুরুষও জ্যাকেট চড়ায় গায়ে। স্যুটের পাশাপাশি নক্সা করা সোয়েটার জ্যাকেট ছাড়া সুন্দর নক্সার শালও গায়ে চড়ায় অনেক পুরুষ। মেয়েরাও কার্ডিগান শাল আর বাহারি থ্রিপিসের ওপর নকশি ডিজাইনের কোট জ্যাকেট আরও কত কী পরে। ঋতু বৈচিত্র্যের এ দেশে শীত নানারূপে ফুটে ওঠে। শীতের সকাল সন্ধ্যা রাত নিসর্গের ছোঁয়ায় ভরে দেয়। শীতের গান ও সুর আছে এভাবেইÑ যতটুকু ভালো লাগবে তার চেয়ে বেশি ভালবাসতে গেলে যদি সুর ও ছন্দ হারিয়ে যায়!
×