ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এ বছর বন্যা ও খরাও বাড়বে

শক্তিশালী এলনিনোর কবলে আবহাওয়া মাঘেও শীত নেই

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬

শক্তিশালী এলনিনোর কবলে আবহাওয়া মাঘেও শীত নেই

নিখিল মানখিন ॥ মাঘ মাসেও শীত নেই! কনকনে শীত ছাড়াই শুরু হয়েছে মাঘ মাস। ‘মাঘের শীতে বাঘ পালায়’ প্রবাদটি মিথ্যে হতে চলেছে! অবশ্য এবার দেশে কনকনে শীত পড়বে না বলে অনেক আগেই পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছেন আবহাওয়াবিদরা। তাদের পূর্বাভাসই বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। এখন পর্যন্ত ‘স্থিতাবস্থা’ বজায় রেখেছে শীত! কনকনে শীতে কঁভপতে হয়নি দেশবাসীকে। মাঝারি ধরনের শীত পড়লেও স্বাভাবিকের কাছেই ঘোরাফেরা করেছে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এ বছর শীত মৌসুমের গোড়াতেই বারবার হোঁচট খেয়েছে উত্তুরে হাওয়া। ভরা ডিসেম্বরেও শীত-শীত ভাবটা উধাও হওয়ার অবস্থা হয়েছিল। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে শীতের মাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও গত বছরের মতো মানুষের হাড় কাঁপাতে পারেনি। এখন পর্যন্ত পুরো বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে পারেনি শীতকাল! আবহাওয়ার ইতিহাসে পৃথিবী সবচেয়ে শক্তিশালী এল নিনোর কবলে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ২০১৬ সালে পৃথিবীতে বন্যা এবং খরার প্রবণতা বাড়বে। ২০১৫ সাল হলো বিশ্বের ইতিহাসে উষ্ণতম বছর। বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস জানায়, বাংলাদেশে জানুয়ারিতে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে এক থেকে দুটি মাঝারি ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আর দেশের অন্যত্র বয়ে যেতে পারে এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ। জানুয়ারি মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও নদ-নদী অববাহিকায় মাঝারি/ঘনকুয়াশা এবং অন্যত্র হালকা/মাঝারি কুয়াশা পড়তে পারে। তবে সারাদেশে একটানা তিন থেকে চার দিন ঘন/মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস। কিন্তু দেশে এখন পর্যন্ত তীব্র তো দূরের কথা, মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহই বয়ে যায়নি। তাপমাত্রার হ্রাস পাওয়া অবস্থায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যতই হ্রাস পাবে, ততই শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্যও হ্রাস পায়নি। শীত বৃদ্ধিতে সহায়ক বৃষ্টিও হয়নি। ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৬ থেকে ২৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১২ থেকে ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়ামের মধ্যেই অবস্থান করছে। মাঝে মধ্যে কয়েকটি সেন্টারের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড হলেও শীত বৃদ্ধিতে তা ভূমিকা রাখতে পারছে না। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, শীত এবার অনেক খামখেয়ালি আচরণ করছে। তার জন্য দায়ী করা হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা এল নিনো পরিস্থিতিকে। কারণ প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বঙ্গোপসাগরের আবহাওয়ায় প্রভাব ফেলেছে। ফলে বদলে গেছে ফিরতি পথের মৌসুমি বায়ুর চরিত্র। শীতেও সাগরে নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে এবং তা উত্তুরে হাওয়ার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আবহাওয়াবিদরা আরও বলছেন, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে আসা উত্তুরে হাওয়ার ওপর ভারত ও বাংলাদেশে শীতের মাত্রা হ্রাস ও বৃদ্ধির বিষয়টি নির্ভর করে। এ বছর ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে ঠা-া হাওয়া বা পশ্চিমী ঝঞ্ঝা কাশ্মীরে আছড়ে পড়ে। তার জেরে সেখানে বৃষ্টি ও তুষারপাত হয়। সেখান থেকে ঠা-া হাওয়া বয়ে আসে পশ্চিবঙ্গের পাশাপাশি পূর্ব ভারতের দিকেও। এ পর্যায়ে যদি সাগরে কোন নিম্নচাপ তৈরি হয়, তাহলে তা উত্তুরে হাওয়ার পথে বাধা তৈরি করে। শুধু তা-ই নয়, সাগর থেকে জলীয়বাষ্প ঢোকার ফলে আকাশে মেঘ তৈরি হয়, দিনের তাপমাত্রা কমলেও রাতের তাপমাত্রা নামতে পারে না। অথচ রাতে কনকনে শীত পড়তে গেলে মেঘমুক্ত আকাশ থাকতে হবে। আর চড়া রোদে দিনেরবেলা মাটি গরম হওয়াও জরুরী। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি। উষ্ণ এল নিনোর কবলে পৃথিবী : আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আবহাওয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী এল নিনোর কবলে পৃথিবী। এত উষ্ণ এল নিনো আগে দেখেনি এই গ্রহ। প্রশান্ত মহাসাগরের এই খামখেয়ালিপনা এত দীর্ঘস্থায়ী কয়েক বার হয়েছেÑ তাও হাতেগোনা যায়। ফলে ২০১৬ সালে ব্যাপক খরা এবং খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি হতে চলেছে বিশ্ব। শুধু আফ্রিকা মহাদেশেই ৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ অনাহারের মুখে পড়বেন। সতর্কবার্তা দেয়া শুরু করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ওই সব সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল নিনো আবহাওয়ার একটি বিশেষ পর্যায়। ২ বছর থেকে ৭ বছরের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে এল নিনো। প্রশান্ত মহাসাগরের খামখেয়ালিপনাতেই এল নিনোর জন্ম হয়। ওই মহাসাগরের মাঝামাঝি এলাকায় জলভাগ উষ্ণ। সেই উষ্ণ জল যখন বড় এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তখন এল নিনোর জন্ম হয়। মধ্য প্রশান্ত মহাসাগর থেকে প্রসারিত হয়ে উষ্ণ জল উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দিকে অনেকটা এগিয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে গোটা বিশ্বের আবহাওয়ার ওপরেই। ঋতু পরিবর্তনের স্বাভাবিক গতি বাধা পায়। বন্যা এবং খরার প্রবণতা বাড়তে থাকে। ফলে চাষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলোকেই এল নিনোর আঘাত সবচেয়ে বেশি সইতে হয়। কখনও কখনও টানা এক বছর এল নিনো স্থায়ী হয়। ঠিক যেমনটা এবার হয়েছে। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া এল নিনো ২০১৬ সালকেও ভোগাবেÑ পূর্বাভাস আবহাওয়াবিদদের। গোটা বছরের গড় তাপমাত্রার হিসেব কষে দেখা গেছে, ২০১৫ সাল হলো বিশ্বের ইতিহাসে উষ্ণতম বছর। শীতকাল এ বছর অপেক্ষাকৃত অনেকটাই উষ্ণ। ক্রান্তীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতও হয়েছে অনেক কম। ওই অঞ্চলের অনেক দেশেই বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ২০-৩০ শতাংশ কম হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যেই খরার কবলে। ভারতে বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, ব্রাজিল এবং অস্ট্রেলিয়াতেও বৃষ্টিপাত কম হবে। এর জেরে অনেক দেশেই বন্যা এবং খরার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। ভারতেও কোন এলাকা অতিবৃষ্টির শিকার, কোথাও আবার বৃষ্টির অভাবে খরার পরিস্থিতি। ফসল মার খাচ্ছে। তবে এল নিনোর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গ্রাসে আফ্রিকা মহাদেশ। ব্রিটেনের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষা বলছে, খরার জেরে ২০১৬ সালে ভয়াবহ খাদ্যসঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে আফ্রিকা মহাদেশ। ৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ অনাহারের মুখে পড়বে। ইথিওপিয়ার অবস্থা হতে চলেছে সবচেয়ে করুণ। এমনিতেই ইথিওপিয়া খরাক্লিষ্ট। তার মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী এল নিনোর কবলে পড়ায় খাবারের অভাব মারাত্মক আকার নিয়েছে সে দেশে। ২০১৬ সালেও বেশকিছুটা সময়জুড়ে এল নিনোর প্রভাব থাকতে চলেছে। ফলে ইথিওপিয়ার অনাহারের পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হবে।
×