ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৌম্য সালেক

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

(পূর্ব প্রকাশের পর) বিভাজনবাদ অবিমিশ্র একক রংকে একে অন্যের বৈপরীত্যে স্থাপন করে দৃশ্যত একটি নতুন বিশিষ্টার্থক মিশ্রণের ইঙ্গিতময়তা সৃষ্টি করা বিভাজনবাদীদের লক্ষ্য। এভাবে যে অপটিক্যাল মিশ্রণ ঘটে তার ফলে চিত্রকর্মে একটি তাৎপর্য প্রস্ফুটিত হয়। অভিব্যক্তিবাদ বস্তুগত স্বরূপের উপর গুরুত্ব না দিয়ে, অভ্যন্তরীণ উপলব্ধিকে রেখা ও রঙে পর্যবসিত করা অভিব্যক্তিবাদীদের লক্ষ্য। মানব মনের চরমতম অনুভূতিকে বা অবস্থাকে তাঁরা রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন। এ আন্দোলনটি একটি প্রবল শিল্প-আন্দোলন হিসেবে জার্মানিতে ১৯১০ সাল থেকে রূপ পেতে থাকে। এ আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য পথিকৃত হচ্ছেন-ইমিল নল্ড, কোকোশকা ও বেকমান। ফভবাদ বিভাজনবাদের প্রতিবাদস্বরূপ ফভবাদের উদ্ভব হয়। রঙে চূড়ান্ত বিভিন্নকরণের মাধ্যমে বিভাজনবাদীরা যখন ফর্ম এবং কনটুরকে পুরোপুরি ভেঙ্গে ফেলেছিলেন এবং দৃষ্টিগত আপেক্ষিকতার উপর চিত্রকর্মের তাৎপর্য নির্ভরশীল ছিলো, তখনই মাতিস ১৯০৫ সালে স্বতঃস্ফূর্ত রঙে প্রলেপে ‘ফভবাদ’-এর জন্ম দেন। এর মাধ্যমে অবিমিশ্র নীল এবং কমলা রঙের প্রাচুর্যের উন্মাদনায় একটি বিস্ময়কর চিত্রপদ্ধতি নির্মিত হলো। ভবিষ্যবাদ ভবিষ্যবাদের উদ্ভাবক হচ্ছেন ফিলিপ্পু তোমাস্সু মারিনেত্তি নামের একজন ইতালীয় কবি। ১৯০৯ সালে তিনি একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন এবং বলেন, অতীতমুখী শিল্পের দিন শেষ হয়েছে-এখন ভবিষ্যতের শিল্পের জন্ম হবে। ভবিষ্যবাদীরা শিল্পফর্ম এবং রং নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে না। শিল্পীর কর্তব্য হবে পৃথিবীর অনবরত পরিবর্তন ও চলমানতাকে রূপ দেয়া। সুতরাং এঁদের অঙ্কনে একটি ধাবমান অশ্বের পা হবে বিশটি এবং গতি হবে ত্রিকোণাকৃতি, সঞ্চালিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বহুবিধতায় এঁরা গতিকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা করেন। গতিকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এ আন্দোলনটি চলচ্চিত্রের পূর্বসূরি। এছাড়া আধুনিক জীবনের যন্ত্রগত গতিকে এঁরা রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। অবক্ষয় : ডেকাডানস্ শিল্প-সাহিত্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী যুগের পর যে অধোগতি ও নেতিবাচকতা দেখা যায় সে সম্পর্কে এ কথাটি প্রয়োগ করা যায়। আধুনিককালে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ফ্রান্সে কবিতার ক্ষেত্রে যে প্রতীকবাদী আন্দোলন সূচিত হয় তাকে ডেকাডেন্ট রূপে চিহ্নিত করা যায়। এই আন্দোলনে গুরুত্ব পড়েছিল সমাজের উপর নয়, বরং ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব আবেগ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উপর, তা সে যতই বিচিত্র ও উদ্ভট হোক না কেন। অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববাদ ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। আর ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বের মানদণ্ডে সব কিছু বিচার করে বলে, সামগ্রিক মানবসত্তাকে বিবেচনা করে বিশিষ্ট সত্তার অনুগামী হিসেবে। অর্থাৎ এ মতবাদের মূলকথা হচ্ছে ব্যক্তিসত্তা বা ব্যক্তি মানুষ সার্বিক সত্তা বা সারধর্মের পূর্বগামী। আর সার্বিক সত্তার অস্তিত্ব বিচার করতে হবে ব্যক্তিসত্তার অস্তিত্বের প্রশ্নকে প্রথমে বিবেচনা করার ভিত্তিতে। সুস্পষ্ট আন্দোলন হিসেবে অস্তিত্ববাদ ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে। সে ক্ষেত্রে যার অবদান সর্বাধিক, তিনি হলেন ফরাসী সাহিত্যিক ও দার্শনিক জ্যাঁ-পল সার্ত। বুর্জোয়া যুগের জার্মান দার্শনিক হেগেল চরম ভাবকে বলেছেন যথার্থ সত্য বলে। আবার তিনি ব্যক্তি সত্তার অস্তিত্বকে দেখেছেন সামগ্রিক ও সামাজিক সত্তার অংশ বা অধীনস্ত রূপে। দর্শনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সামগ্রিকতা ও সার্বিকতাবাদী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে অস্তিত্ববাদীরা জানালেন তীব্র প্রতিবাদ। তারা প্রয়াসী হলেন চরম ভাববাদী, যুক্তিবাদী ও সামগ্রিক তথা সার্বিকতাবাদী দর্শনের বিপরীতে আপাত সত্য, ভাবাবেগ ও ব্যক্তি সত্তার অস্তিত্বকে আশ্রয় করে দর্শনের জগতে এক নতুন ধারার প্রবর্তনে। তাদের মতে, যুক্তির জাল বুনে দার্শনিকরা শুধু কথামালাই তৈরি করতে পারেন কিন্তু তাতে মানুষের কোনো মঙ্গল সাধিত হয় না, হতে পারে না। এ অলীক ও অবাস্তব তত্ত্বানুসন্ধানের পরিবর্তে দার্শনিকদের দায়িত্ব হওয়া উচিত মানুষকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা, মানুষের বাস্তব সমস্যাবলী সমাধানের কাজে আত্মনিয়োগ করা। আর এক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন-কিয়ের্কেগার্দ, নীটশে, ইয়েসপার্স মার্সেল, কাম্যু, কাফকা, সার্ত প্রমুখ। সার্ত-এর ত্রয়ী উপন্যাস ‘মুক্তির সড়ক’ এবং নাটক ‘মাছি’ অস্তিত্ববাদী চিন্তাসমৃদ্ধ শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর-চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রতিফলন লক্ষণীয়। ইমেসিজম ১৯১২ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে এবং তার চেয়েও প্রবলভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে ওঠা একটি কাব্য আন্দোলন। অংশত টি.ই. হিউমের কাব্যতত্ত্বের প্রভাবে লন্ডনে কয়েকজন ইংরেজ ও মার্কিন কবি এই আন্দোলনে যোগ দেন। ঊনিবংশ শতাব্দীর শেষলগ্নে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে কবিতার ক্ষেত্রে যে অস্পষ্টতা, ধোঁয়াটে আবেগ-উচ্ছ্বাসের প্রাবল্য ও শিথিল ভঙ্গি আসর দখল করে। এঁরা তার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে এ আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। প্রথমে নেতৃত্ব দেন এজরা পাউন্ড, এরপর এমি লাওয়েল। এঁদের বিবেচনায় কবিতা কোনো গতানুগতিক বিষয়বস্তু বা কিছু বাঁধাধরা ছন্দ প্রকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। কবিতা তার নিজস্ব বিষয়বস্তু এবং সুর নির্বাচন করবে স্বাধীনভাবে, উপস্থিত করবে এমন চিত্রকল্প যা সুস্পষ্ট, ঋজু ও সুসংহত। ঋজু ও সুস্পষ্ট চিত্রকল্পের দৃষ্টান্ত হিসেবে এজরা পাউন্ডের চরণ দুটি বিখ্যাত : The apparition of these faces in the crowd/ petals on a wet, black bough. (in a station of the metro) (চলবে)
×