ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

কান কাটার গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

কান কাটার গল্প

ভিনসেন্ট ভ্যানগগ আর পল গগা ছিলেন বন্ধু। তাদের বন্ধুত্ব ছিল অস্বচ্ছন্দ, অস্বস্তিকর এবং চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁরা ছিলেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ¦ী। ১৮৮৭ সালে প্যারিসের আর্ট গ্যালারিতে ভ্যানগগের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে পল গগার। ভ্যানগগের বয়স তখন ৩৪ আর গগার বয়স ৩৯ বছর। তাদের দুই জনের আঁকা চিত্রকর্ম বিশ শতকের চিত্রশিল্পের উন্নতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। শিল্পী হওয়ার আগে ভ্যানগগ নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এমনকি ধর্মতত্ত্ব নিয়েও এক সময় ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু কোন কিছুই আর হয়ে ওঠা হয়নি। সূচনা পর্বের সেই অস্থির, অনিশ্চিত ক্রান্তিকালের শেষ ধাপে এসে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে রঙ-তুলির সঙ্গে। পল গগাকেও সূচনা পর্বে নানা চড়াই উৎরাই ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ভ্যানগগের চেয়েও গগার শুরু ছিল বেশি বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয়। ২৫ বছর বয়সে গগা ছবি আঁকা শুরু“করেন। ১৮৮৭ সালের শেষের দিকে ভ্যানগগ আর পল গগা পরস্পরের মধ্যে ছবি বিনিময় করেন। ভ্যানগগ তাঁর সূর্যমুখী ফুলের অনুশীলনের দুটি ছবি দিয়েছিল গগাকে আর গগা দিয়েছিল ভ্যানগগকে মার্টিনিকের নদী তীরে এক মহিলার সঙ্গে একটি বালক ও গরুসমেত একটি ল্যান্ডস্কেপের ছবি। এর পর তারা নিজেদের মধ্যে আত্মপ্রতিকৃতি বিনিময় করেন। এ সময় ভ্যানগগের ছবি ছিল আরও তীব্র, উদগ্র কঠিন এবং পুরোদস্তুর নিরাভরণ। ভ্যানগগের আঁকা আত্মপ্রতিকৃতি দেখে বিস্ময়ে চমকে ওঠেন গগা। আর গগার আঁকা আত্ম প্রতিকৃতি দেখে ভ্যানগগ রাগে ভীষণ রকম অস্থির হয়ে ওঠেন। দক্ষিণ ফ্রান্সে একটি হলুদ বাড়িতে বসে ছবি আঁকতেন ভ্যানগগ। একা একা লাগে বলে শিল্পী বন্ধু গগাকে আমন্ত্রণ জানালেন ঐ বাড়িতে। গগা স্টুডিওতে এসে ভীতিকর রকম উত্তেজিত আর বিক্ষুব্ধ এক ভ্যানগগকে আবিষ্কার করলেন। অত্যধিক উত্তেজনায় চরমভাবে ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত অবস্থা তাঁর। তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে গগার ব্যঙ্গবিদ্রƒপ একটুও আমলে নিচ্ছে না ভ্যানগগ বরং উৎসাহ যেন আরও বাড়ছিল। কিন্তু গগা ঠিকই টের পেয়েছিল তাদের মধ্যে বিরোধ অত্যাসন্ন। পল গগা নতুন ছবি আঁকা শুরুর আগে এক ধরনের আবহ বা পরিবেশ তৈরি করতে পছন্দ করতেন কিন্তু ভ্যানগগ প্রথম দিনেই গগা আসতে না আসতেই তাকে ছবি আঁকা শুরুর জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। এমনকি নতুন ক্যানভাস কেনায় সময় নষ্ট হবে মনে করে নিজের ঈষৎ ব্যবহৃত ক্যানভাসই জোর করে ধরিয়ে দেয় গগাকে। দুই বন্ধু মিলে দিন কয়েকের জন্য একত্রে বসবাস করতে লাগলেন। এ সময় ভ্যানগগ আর পল গগা পাশাপাশি বিরতিহীনভাবে ছবি এঁকেছেন আর আলাপ-আলোচনাও চলেছে পরস্পরের মধ্যে। তাদের এ আলোচনার বেশির ভাগ অংশ জুড়ে ছিল শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম ও ইতিহাস। বেশির ভাগ সময় এই তর্ক-বিতর্ক শেষে মাথা এমন ভারি হয়ে যেত, যেন ব্যাটারির সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। আলোচনার শেষ দিকে বেশির ভাগ সময়ই পল গগা অধৈর্য হয়ে ভ্যানগগের যুক্তি-তর্ককে বিশৃঙ্খল মস্তিষ্কের চিন্তা ও যুক্তিহীন প্রলাপ বলেই মন্তব্য করতেন। শিল্পের তর্কে গগা বুঝতে পেরেছিল তাদের কোন দিনই একমত হওয়া সম্ভব হবে না। এক রাতে মদ্য পান করা অবস্থায় ভ্যানগগ ও গগার মধ্যে শিল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মন কষাকষি হয়। রাতের নেশার প্রভাব কেটে যাওয়ার পর পল গগাকে জানাল সে তাঁর সঙ্গে খুব বাজে আচরণ করেছে। শিল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মন কষাকষি হলেও একদিন তাদের ঝগড়া হলো এক রূপবতী তরুণীকে নিয়ে। ভ্যানগগ তাঁর পছন্দের নায়িকাকে নিয়ে কটূ কথা শুনতে না পেরে ক্ষুর দিয়ে তাড়া করল বন্ধু গগাকে। প্রতিরোধের মুখে ভ্যানগগ রাগ সামলাতে না পেরে ধারালো ক্ষুর দিয়ে নিজেই নিজের কান কেটে ফেলল। বন্ধু গগা ততক্ষণে বাড়ির বাইরে দে ছুট। সেই রাতেই পল গগা আর্লে ছেড়ে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা করেন। কিন্তু পরদিন গগা খবর পেলেন, তাঁর আবেগী মাতাল বন্ধু ভ্যানগগ নিজের কান নিজেই ক্ষুর দিয়ে কেটে এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অতিনাটকীয় এক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। কান কেটেছেন কেন ভ্যানগগ যে মেয়েটিকে ভালবাসতেন তিনি ছিলেন অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। সেই মেয়েটি নাকি কৌতুক করে একদিন ভ্যানগগকে বলেছিল, তাঁর কান দুটো খুব সুন্দর। সেই সুন্দরকে উপহার দিয়ে তিনি ভালবাসার পুরাণ তৈরি করেছেন। ডান কানের একটি অংশ নগরের নটি রাসেলকে দিয়ে এসে মৃত্যুশয্যায় কাতরান ভিনসেন্ট ভ্যানগগ। খুব শিগগিরই আরোগ্য লাভ করলেও বিয়ে আর করা হয়ে ওঠেনি স্বপ্নের সেই নায়িকাকে।
×