ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাযযাদ কাদির

রবীন্দ্রনাথ ও প্রাকৃত বাংলার বাউলিয়ানা

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

রবীন্দ্রনাথ ও প্রাকৃত বাংলার বাউলিয়ানা

খুব অল্প বয়সে হাতে এসেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ (১৯১০)। তখন আউল বাউল ফকিরদের ব্যাপারে অত জানাশোনা ছিল না, যেটুকু যা ছিল তা অত উচ্চ কিছু নয়; তাই উপন্যাসের শুরুতে এ বর্ণনায় একটু অবাকই হয়েছিলাম মনে পড়ে: “... আলখাল্লা-পরা একটা বাউল নিকটে দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া গান গাহিতে লাগিল- খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়, ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়। বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল বাউলকে ডাকিয়া এই অচিন পাখির গানটা লিখিয়া লয়, কিন্তু ভোর-রাত্রে যেমন শীত-শীত করে অথচ গায়ের কাপড়টা টানিয়া লইতে উদ্যম থাকে না, তেমনি একটা আলস্যের ভাবে বাউলকে ডাকা হইল না, গান লেখাও হইল না, কেবল ঐ অচেনা পাখির সুরটা মনের মধ্যে গুন্ গুন্ করিতে লাগিল।...” পরে বাউল গানের ওই ‘অচিন পাখি’, ‘মনের মানুষ’ প্রভৃতির খোঁজ কিছুটা পাই ‘শিশু ভোলানাথ’ (১৯২২)-এর ‘বাউল’ কবিতায়- “... অনেক দূরের দেশ আমার চোখে লাগায় রেশ, যখন তোমায় দেখি পথে। দেখতে যে পায় মন যেন নাম-না-জানা বন কোন্ পথহারা পর্বতে। হঠাৎ মনে লাগে যেন অনেক দিনের আগে আমি অমনি ছিলেম ছাড়া। সেদিন গেল ছেড়ে, আমার পথ নিল কে কেড়ে, আমার হারাল একতারা।...” ভাবি এ সবই তাঁর শহুরে বাউলিয়ানা। নিজেকে ‘কবি বাউল’, ‘রবি বাউল’, ‘রবীন্দ্র বাউল’ প্রভৃতি পরিচয়ে তুলে ধরার প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন কাব্যগুরু বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)-র কাছে। বস্তুত উনিশ শতকে বিশুদ্ধ গীতিকবিতার ধারাটিকে নতুন খাতে বইয়ে দেয়ার কাজটিতে সংস্রব ছিল ওই শহুরে বাউলিয়ানার। এর প্রমাণ বিহারীলালের ‘বাউল বিংশতি’ (১৮৮৭)। সেখানে তিনি লিখেছেন- “প্রেমের মানুষ চেনা যায়। ... সে জানে না দুনিয়াদারি, ভালবাসে দুনিয়ায়।...” “সবই গেছি ভুলে, আমি সবই গেছি ভুলে! জাগো হে প্রাণের প্রাণ দাও মনের ধাঁধা খুলে!...” এই যে ‘প্রেমের মানুষ’, ‘প্রাণের প্রাণ’- কে সে? কোথায় সে? এই অন্বেষণ এমন শহুরে বাউল-বোধ থেকেই শুধু নয়, পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫)-এর হাফিজ-প্রীতি সূত্রে পাওয়া সুফি-চেতনা থেকেও করেছেন রবীন্দ্রনাথ। উভয়ের সম্মিলনে সৃষ্ট ভাবসম্পদ পরিপুষ্ট করেছে তাঁর সাহিত্যকে, সমৃদ্ধ করেছে জগৎ ও জীবন-সমাজ ও সত্যের উপলব্ধিকে। এজন্য ১৯৩২ সালে পারস্যে হাফিজের সমাধিপাশে দাঁড়িয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, “... মনে হল আমরা দুজনে একই পানশালার বন্ধু, অনেকবার নানা রসের অনেক পেয়ালা ভরতি করেছি। আমিও তো কতবার দেখেছি আচারনিষ্ঠ ধার্মিকদের কুটিল ভ্রুকুটি। তাদের বচনজালে আমাকে বাঁধতে পারেনি; আমি পলাতক, ছুটি নিয়েছি অবাধপ্রবাহিত আনন্দের হাওয়ায়। নিশ্চিত মনে হল আজ, কত-শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন একজন মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক।...” তবে রবি বাউলের জন্ম বিশেষভাবে ১৮৯০ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার শাহজাদপুর, শিলাইদহ ও পতিসরে ঠাকুর এস্টেটের জমিদারি প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনার সূত্রে। এর মধ্যে শিলাইদহে বছর দশেক থাকায় তিনি নিবিড়ভাবে অবগাহন করেন লালন ফকির ও ফিকির চাঁদ (কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার)-এর কবিতা-গানে। শহুরে বাউল পূর্ণতা পায় জীবন বাউলিয়ানায়। তিনি লেখেন, “... প্রাকৃত-বাংলার দুয়োরানীকে যারা সুয়োরানীর অপ্রতিহত প্রভাবে সাহিত্যের গোয়াল-ঘরে বাসা না দিয়ে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে, সেই ‘অশিক্ষিত’-লাঞ্ছনাধারীর দল যথার্থ বাংলাভাষার সম্পদ নিয়ে আনন্দ করতে বাধা পায় না। তাদের প্রাণের গভীর কথা তাদের প্রাণের সহজ ভাষায় উদ্ধৃত করে দিই। আছে যার মনের মানুষ আপন মনে সে কি আর জপে মালা। নির্জনে সে বসে-বসে দেখছে খেলা।... এই ছন্দের ভঙ্গি একঘেয়ে নয়। ছোটো বড়ো নানা ভাগে বাঁকে বাঁকে চলেছে। সাধুপ্রসাধনে মেজে-ঘষে এর শোভা বাড়ানো চলে, আশা করি এমন কথা বলবার সাহস হবে না কারও।... (‘ছন্দ’, ১৯৩৭) ‘বাউলের গান’ শীর্ষক সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ আরও স্পষ্ট করে লিখেছেন- “... সংস্কৃত ব্যাকরণেও বাংলা নাই, আর ইংরাজি ব্যাকরণেও বাংলা নাই, বাংলা ভাষা বাঙালিদের হৃদয়ের মধ্যে আছে।... তোমরা বাংলা বাংলা করিয়া সর্বত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছ, সংস্কৃত ইংরাজি সমস্ত ওলট্-পালট্ করিতেছ, কেবল একবার হৃদয়টার মধ্যে অনুসন্ধান করিয়া দেখ নাই।... আমাদের ভাব, ভাষা আমরা যদি আয়ত্ত করিতে চাই, তবে বাঙালি যেখানে হৃদয়ের কথা বলিয়াছে, সেইখানে সন্ধান করিতে হয়।...” বস্তুত বাঙালির প্রাণের গভীর কথা প্রাণের সহজ ভাষায় বলার প্রেরণা বাউলিয়ানা থেকেই পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এখান থেকেই গড়ে উঠেছিল তাঁর ভাবসম্পদ, তাঁর কবি-মানস। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, “... রবীন্দ্রনাথের সকল প্রকার চিন্তা ও কর্মপ্রচেষ্টা তাঁহার অন্তর্নিহিত সত্তার আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা ছাড়া আর কিছু বলিয়া মনে করিতে পারি না। কাব্যে সংগীতে গল্পে নাট্যে উপন্যাসে তিনি যেমন করিয়া আপনার অভিজ্ঞতার আবেগকে প্রকাশ করিয়াছেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মপ্রচেষ্টায়, শিক্ষাদান ও প্রচারে, তত্ত্ব জিজ্ঞাসা ও ব্যাখ্যায়, অধ্যাত্মবোধ এবং তাহার প্রকাশও তিনি তেমন করিয়াই নিজেকে ব্যক্ত করিয়াছেন।... বিশ্বজীবনের বিচিত্র বিকাশের সঙ্গে মানুষের একটা নিবিড় যোগ আছে;... মানুষ চায় এই সম্বন্ধটিকে, এই নিবিড় সংযোগের রসটিকে ভোগ করিতে, জানিতে নয়- পাইতে, অনুভব করিতে। এই ভোগের ক্ষুধা, অনুভূতির প্রেরণাই কবি ও শিল্পীকে রূপসৃষ্টি, রসসৃষ্টির কাজে প্রবৃত্ত করে, তাঁহার নিদ্রিত চৈতন্যকে প্রকাশের তাড়নায় ব্যাকুল করিয়া তোলে।... তাঁহার (রবীন্দ্রনাথের) এই কবি-মানস, বস্তুত সকল প্রকার রূপ-মানসের মূলে আছে এই রসভোগের ইচ্ছা, অনুভূতির প্রেরণা, প্রকাশের প্রেরণা,- জ্ঞানের প্রেরণা নয়, প্রয়োজনের তাড়না নয়।...” (‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের ভূমিকা’) পরের কথাটি তিনি লেখেননি, লিখেছেন বন্দনা চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে বাউল ভাবনা’ গ্রন্থের উপসংহারে, “... তিনি (রবীন্দ্রনাথ) মানবসত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন বাংলার নিরক্ষর কবিদের মুখে। তাঁদের সুর ও বাণী তাঁকে মুগ্ধ করেছে এবং তাঁর সারা জীবনের সাহিত্যসাধনার মধ্যে তা অনায়াসে প্রতিফলিত হয়েছে। বাউলের ‘বিশ্বপ্রেমতত্ত্ব’ তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। এই সাহিত্যরচনার ধারায় তিনি উপনিষদের তত্ত্ব, বৈষ্ণব ও সুফিদের সহজ সাধনা, বাউলের মনের মানুষ এবং তাঁর আপন হৃদয় গহন দ্বারের গোপনবাসীকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে নিয়েছেন।...” এর আগে গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, “রবীন্দ্র জীবন অনুরাগের মূলে প্রধানত তিনটি ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। এক, উপন্যাসের ঋষি কবিদের বাণী; দুই, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রেম সাধনার ধারা; এবং তিন, বাংলার বাউলদের সহজ সাধনার ধারা। বাউলদের ধর্মমত তাঁর ওপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিশেষত বাউলদের ‘মনের মানুষে’র প্রভাব তাঁর মনে এক গভীর রেখাপাত করে...”। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তো ‘সারা জীবনে কখনও বাউল সাধনা করেন নি, তিনি কেবল দর্শন ও ভাবের দাঁড়ে বসে এই বিশ্বজগৎকে দেখেছেন ভিন্ন এত দৃষ্টিতে, চেনা অচেনার আলো আঁধারিতে।’ তাহলে তাঁর মতো একজন সর্বাধুনিক বিশ্বনাগরিকের কাছে ‘প্রাকৃত বাংলা’র বাউলিয়ানা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল কিভাবে? বন্দনা চট্টোপাধ্যায় বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- বাউলের মধ্যযুগীয় “গুহ্য সাধনাকে নাগরিক সমাজ গ্রহণ না করলেও বাউল গানের মূল্যকে তাঁরা সাদরে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাই ধর্মের দিক থেকে না হলেও অন্য দিক দিয়ে তা লোকমানসে সমাদৃত। কেননা বাউলের আত্মগত ভাবনা আধুনিক ব্যক্তিমানসের মন্ময় ভঙ্গিতে আধুনিক গীতিকবিতার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও তারই প্রভাব পড়েছে। তাই তাঁর জীবন দর্শনের সঙ্গে বাউলতত্ত্ব দর্শনের একটা সহজ মেলবন্ধন লক্ষ করা যায়।...” এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টিকে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ দিয়ে মূল্যায়ন, বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. বন্দনা চট্টোপাধ্যায়। এ পর্যবেক্ষণে আমাদের চেনা ‘রবি বাউল’কে পাই আরও ভেতর থেকে, পাই আরও বহুমাত্রিকতায়। ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে বাউল ভাবনা’ গ্রন্থটির তথ্যনিষ্ঠতা, সার্বিক অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন মত ও বক্তব্যের যুক্তিসিদ্ধ উপস্থাপনা তাই মুগ্ধ করে আমাদের। এর স্বচ্ছ ঋজু ভাষাভঙ্গি ও সুচিন্তিত বিষয়-নির্মাণ থেকে রচয়িতা হিসেবে যে শ্রদ্ধাশীল গবেষক-ব্যক্তিত্বকে দেখতে পাই তাঁকে তাই অভিনন্দন। বন্দনা চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার এক কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপিকা। পড়াশোনা ও গবেষণা সবই করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওখান থেকেই গবেষণা করে পেয়েছেন পিএইচডি ও প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ (মোয়াট মেডেল)। প্রাকৃত বাংলার বাউলদের ভাবসম্পদ কোথায় কিভাবে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যে সমৃদ্ধি এনেছে তা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপে তুলে ধরে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে তিনি বর্ণনা করেছেন গ্রন্থের পাঁচটি অধ্যায়ে- ‘বাউল ভাবনা: রবীন্দ্র অনুরাগ’, ‘রবীন্দ্রকাব্যে প্রেমচেতনায় বাউল ভাবনা’, ‘রবীন্দ্র নাটকে বাউল ভাবনা’, ‘রবীন্দ্র সঙ্গীতে বাউল ভাবনা’। শিরোনাম থেকেই বুঝতে পারি এর আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে। ওই বিষয়গুলো নিয়েই আসলে এতক্ষণ কথা বলেছি আমরা। লালন ফকির, গগন হরকরা ও ফিকির চাঁদ (কাঙ্গাল হরিনাথ) কিভাবে স্থান করে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিবৈচিত্র্যে তা তাঁদের জীবন ও কর্ম থেকে তুলে ধরেছেন বন্দনা। এখানে গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ উদ্ধার করি, এতে বিষয়টি স্পষ্ট হবে আরও: “রবীন্দ্রনাথ অল্প বয়স থেকেই যেখানে যা কিছু ভাল জিনিস দেখতেন বা শুনতেন তা তিনি সহজেই আত্মস্থ করে নিতেন। এভাবেই বাউলের চরিত্র ও গান তাঁর জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে ঢুকে পড়েছিল।... হরিনাথ ছিলেন একজন নির্ভীক ও প্রতিবাদী পুরুষ।... তাঁর মধ্যে সত্যবাদী ও এক দৃঢ় চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটক রচনার ক্ষেত্রে বাউল জাতীয় চরিত্রের আদলে যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যেও এই নির্ভীক সত্যবাদী চরিত্রের বৈশিষ্ট্যই লক্ষ করা যায়। এদের আদলেই তিনি ধনঞ্জয় বৈরাগী ও ঠাকুরদা জাতীয চরিত্রগুলো রচনা করেছিলেন।” এমনি অনেক তীক্ষè গভীর পর্যবেক্ষণে ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে বাউল ভাবনা’ সমৃদ্ধ সমুজ্জ্বল। এ গ্রন্থ সকল রবীন্দ্র-পাঠক,-অনুরাগী,-গবেষকের অবশ্যপাঠ্য।
×