ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার মাসুদ

কবি পল ভালেরি

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

কবি পল ভালেরি

তার সমকালীন ফরাসী কবিদের মধ্যে পল ভালেরি (১৮৭১-১৯৪৫) কেবল প্রকৃত অর্থে আধুনিকই ছিলেন না, ছিলেন বিচিত্রমুখী প্রতিভারও অধিকারী। নানা বিষয়ে কৌতূহল আধুনিক মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সে মানুষটি যদি সৃজনশীল হন, তাহলে তার ওই নানামুখী আগ্রহ অনেক বেশি তাৎপর্যবহ হয়ে ওঠে। ভালেরির বেলায়ও তাই ঘটেছিল। ষাটের দশকের শেষদিক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশে ফরাসী কবিতার বিষয়ে গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। ষাটের প্রজন্মের ২-৩ জন কবি ও গদ্যলেখক যেমন আবদুল মান্নান সৈয়দ, হায়াৎ মামুদ এ বিষয়ে লেখাজোকা করেছেন। বিশেষত মান্নান সৈয়দের অগ্রণী ভূমিকা এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। তিনি শুধু বিশ শতকের কয়েকজন প্রধান ফরাসী লেখক নিয়ে গদ্য রচনা করেননি; ‘পরাবাস্তব কবিতা’, ‘মাছ সিরিজ’-এর মতো কাব্যগন্থও রচনা করেছন। বইগুলোতে ফরাসী প্রতীকবাদ এবং পরাবাস্তববাদের গভীর ছায়া সুস্পষ্ট। অবশ্য মান্নান সৈয়দ ওই প্রভাব সত্ত্বেও প্রকাশরীতির নিজত্ব দেখাতে পেরেছেন। বোদলেয়র, মালার্মে, ব্যাঁবো, আরাঁগ, আপলিনেয়র প্রমুখের প্রসঙ্গ তার গদ্যে বার বার এসেছে। কিন্তু লক্ষ্য করে অবাক হয়েছি যে, পল ভালেরির মতো একজন প্রায় সব্যসাচী তার মনোযোগের বাইরে থেকে গেছেন। হতে পারে মান্নান তার সম্বন্ধে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। যা হোক, পল ভালেরিকে নিয়ে আমাদের এখানে লেখাজোকা হয়নি। পঞ্চাশের প্রজন্মের হাসান হাফিজুর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আব্দুল গণি হাজারী প্রমুখ যারা কাব্যচর্চার পাশাপাশি কবিকতাকেন্দ্রিক গদ্যও লিখেছেন, তারাও আধুনিক ফরাসী কবিতার কথা দু’একটি লেখায় ছিটেফোঁটা বললেও আলাদাভাবে ভালেরিকে নিয়ে কোন গদ্য লেখেননি। অথচ এই উজ্জ্বল লেখকের কাজ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা না রাখা এবং তাকে নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত না হওয়া কেবল অসমীচীনই নয়, আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনকও বটে। এ ধরনের সাহিত্যিক উদাসীনতা এবং হাস্যকর আত্মতৃপ্তি বাংলা সাহিত্যের প্রভূত ক্ষতির কারণ হয়েছে। বিশ শতকে ইউরোপ-আমেরিকা কিংবা পৃথিবীর অন্যত্র যারা বরেণ্য সাহিত্যিকের মুকুট পরার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের কথা না হয় আপাতত তুলে রাখলাম; আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কৃতী স্রষ্টাদের ক’জনকে নিয়ে আমরা লিখেছি বা লিখি? পল ভালেরি ছিলে সর্বার্থে আধুনিক এক মানুষ। বৈজ্ঞানিক মানসিকতা ও যুক্তিবাদ তার লেখক চরিত্রের অন্যতম বিশেষত্ব। কোন গোষ্ঠীপরিকল্পিত ভাবনা-চিন্তার নিগঢ়ে আবদ্ধ ছিলেন না তিনি। তার লেখায় আধুনিকতার যে রূপ-রস লক্ষ্য করা যায় তা সভ্যতার বিবর্তনের ভেতর দিয়ে পরিপক্ব হয়ে ওঠা জিনিস। উপরন্তু এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দার্শনিকসুলভ কবিচৈতন্য। সর্বদাই একটি চিন্তাশীল মন সক্রিয় ছিল এই কবির মধ্যে। ফলে শুধু কবি নয় একজন প্রাবন্ধিক ভালেরিকেও, যিনি কবিতার চেয়ে গদ্যই রচনা করেছেন বেশি, আমরা পেয়েছি। ফরাসী সাহিত্যে তার আরেকটি খুব উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। সেটা হচ্ছে, তিনি প্রতœ-আধুকিতাকে নতুন যুগের আধুনিকতার সঙ্গে মেলাতে পেরেছিলেন, যা অন্য কোন ফরাসী লেখক করতে পারেননি। গোটাচারেক কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন ভালেরি। তার মধ্যে বেশি উল্লেখযোগ্য হচ্ছে June parque (১৯১৭) এবং Charmes (১৯২২)। তার কাব্যচর্চার অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা হচ্ছে প্রতীকবাদী আন্দোলনের প্রভাব। এ বিষয়ে তিনি স্তেফান মালার্মের (১৮৪২-১৮৯৮) ভাবশিষ্য। যদিও ক্ল্যাসিক সংহতি এবং সামগ্রিকতা ভালেরির কবিস্বভাবের বিশেষত্ব নয়, তথাপি আঙ্গিকের দিক থেকে ঘনবদ্ধতা এবং ভাবের দিক থেকে বৈদগ্ধ লক্ষ্য করা যায় তার কাব্যে। তিনি জানেন কিভাবে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্যদিকে, মালার্মে চেতনায় বিশ্বাসী নন; কিন্তু ভালেরির কাছে কবিচৈতন্য একটা বিরাট বিষয়। উপরন্তু রোমান্টিক মানসিকতা তার কবিতায় খুঁজে পাওয়া কঠিন। তার মতে, লেখা হওয়া উচিত সুগঠিত স্থাপত্যের মতো। এর প্রতিটি শব্দ হবে যথার্থ, সঠিক অর্থবোধক এবং স্বচ্ছ চেতনাজাত। কবি কী লিখছেন বা লিখবেন এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকলেই কেবল এ কাজ স্বার্থক হয়ে ওঠে। আর ‘Album of old verses’ বইয়ে ভালেরি শব্দের যে পূর্ণ শক্তির কথা উল্লেখ করেছেন (I feel the full strength of every word for having waited for it) সেটাই হচ্ছে কবিতার আসল কথা। কবিতা কখনও কখনও প্রেরণাজাত- এ কথা ভালেরিও মানেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি অবিরাম পরিমার্জনায়ও বিশ্বাসী। লেখক স্বভাবের দিক থেকে স্তেফান মালার্মের সঙ্গে পল ভালেরির পার্থক্য হচ্ছে- মালার্মে আগাগোড়া কবি। কিন্তু ভালেরি প্রথম জীবনে শুধু কবি হলেও পরিণত বয়সে শিল্প, সাহিত্যবিষয়ক গদ্য লেখক, সমালোচক ও বিশ্লেষক। উনিশ থেকে ঊনত্রিশ বছর পর্যন্ত নিয়মিত কবিতা লিখেছেন। গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ঔঁহব ঢ়ধৎয়ঁব বেরোয় ৪৬ বছর বয়সে। ঈযধৎসবং প্রকাশিত হওয়ার পর তার কবিখ্যাতি নতুনমাত্রা অর্জন করে। ভালেরির বয়স তখন বায়ান্ন। মাঝখানের ষোলো/সতেরো বছর কেটেছে মুখ্যত গদ্যচর্চা করে। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি যেমন কাব্য নিয়ে ভেবেছেন এবং সেগুলোকে সাকার করে তুলেছেন গদ্যে, তেমনি কাব্যবহির্ভূত বিষয় যেমন দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম প্রভৃতি নিয়েও গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। শিল্প কেমন, কবিতা কী, শিল্পীর বা কবির জীবন কিভাবে সফল হয়ে উঠতে পারে- এগুলোই ছিল তার বিচার্য বিষয়। কেবল কবিতা বা দর্শন নয়, শিল্পকলা নিয়েও তার গভীরতাসন্ধ, সৃষ্টিশীল ভাবনা অব্যাহত ছিল। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ওপর বই লিখেছেন। এ সবই একজন আধুনিক ভাবুকের রুচির বহুমুখিতা ও বিপরীতমুখিতার পরিচয় তুলে ধরে। ভালেরির প্রতিভার বিচিত্রমুখিতার বিষয়টি আগেই বলা হয়েছে। এখন বিপরীতমুখিতা নিয়ে দু’কথা বলা যাক। যেমন- তার রচনায় আমরা একদিকে লক্ষ্য করি তীব্র জীবনাসক্তি, অন্যদিকে পরিপূর্ণ নির্বেদ। এ দুয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বও আমাদের মনোযোগ এড়ায় না। তার নৈর্ব্যক্তিক বিশ্বদর্শন আর তীক্ষè ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিশিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় ‘Monsieur Teste’ নামে গ্রন্থে। ভালেরির অসংখ্য কবিতার উপজীব্য হয়েছে সাহিত্যতত্ত্ব বা জ্ঞানতত্ত্ব। তা সত্ত্বেও সেগুলো অসাধারণ কবিতা, কেননা জ্ঞানের কথা সেসব রচনার রসাস্বাদনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। উদাহরণ হিসেবে ‘ঝবৎঢ়বহঃ’ শিরোনামের কবিতাটির কথা বলব। ঈযধৎসবং কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত এ কবিতায় আছে সুগভীর মন্ময়তা এবং প্রগাঢ় ইন্দ্রিয়ানুভূতি। ভালেরির এমন অনেক কবিতা আছে যেগুলোতে সত্তার সঙ্গে প্রজ্ঞার কিংবা স্বপ্নের সঙ্গে জাগরণের সম্পর্ক অন্বেষণ করা হয়েছে। তার বহু কবিতার ভিত্তি বিমূর্ত ভাবনা। আবার বিমূর্ততা (ঙনংঃৎঁপঃরড়হ) থেকে বাস্তবতাভিক্তিক অনুভবের দিকে অগ্রসর হয়েছে তার অনেক কবিতা। বিষয়বস্তুগত সংশ্লিষ্টতা ও স্বচ্ছতা এবং নিরাসক্তি ভালেরির কবি স্বভাবের অনন্য বৈশিষ্ট্য। চৈতন্য তীব্র যন্ত্রণাপ্রদ এক অস্তিত্বের নাম। তা সত্ত্বেও চৈতন্য শিল্পীর জন্য অপরিহার্য। আর এ চৈতন্যের যতাযথ প্রয়োগের ফলেই অদৃশ্য কিছুও দৃশ্য হয়ে ওঠে। মননশীল পাঠকের কল্পনাপ্রবণতা সেই ‘অদৃশ্য’-এর ছবি এঁকে নিতে সাহায্যও করে। এ বিষয়টি চমৎকারভাবে প্রযুক্ত হয়েছে The Sylph কবিতায়। Neither seen nor Known,/ I am the perfume living and dead come on the wind!/ Neither seen nor known, chance or genius? Hardly come, the task is ended!/ Neither read nor understood?/ What mistakes destined for the best mind!/ Neither seen nor known,/ the time of a bare breast between two smocks! (BsiwR Abyev` A. Hartley) (আমাকে দেখাও যায়নি চেনাও যায়নি,/ আমি এক আকর্ষণের নাম অস্তিত্বশীল ও অস্তিত্বহীন, বাতাসের সঙ্গে চলে আসি!/ জানা যায়নি আমাকে দেখাও যায়নি, প্রতিভাময়ী না হঠাৎ হয়ে ওঠা? আমার তো কাজ শেষ চলে আসি কদাচিৎ/ আমার বিষয়ে পড়েনি কেউ, বোঝেওনি!/ বড় মানুষের নিয়তি, বড় ভ্রান্তিতে ভোগা! দেখা যায় আমার সম্বন্ধে জানাও যায়নি কিছু/ শেমিজের নিচে স্তন খোলা থাকার সময়টা চমৎকার!) জীবনের জন্য আকুতি অর শূন্যতার অনুভব- এ দুয়ের দ্বন্দ্বে অবশেষে জয়ী হয় জীবনের অপরাজেয়তা। তীব্র জীবনতৃষ্ণার জন্যই নিসর্গের সুষমা শারীর মাধুর্য, ব্যক্তিসত্তা, সন্ধ্যা বা সকালের রং, বালুভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ, আকাশের আলো- এসব আকর্ষণ করেছে লেখককে। তার অনেক কবিতারই সারমর্ম হচ্ছে, এ পৃথিবী শূন্যতা সর্বস্ব, অর্থহীনতায় ঠাসা, অকারণ। সত্তা এক উদ্দেশ্যঅস্পষ্ট স্ফুলিঙ্গের নাম; শিল্পীর চৈতন্য সংশয়, ভীতি আর যন্ত্রণার জন্মদাতা। কোনকিছুরই স্থায়ী মূল্য নেই শেষ পর্যন্ত। কেননা মহাসময় সবকিছুকেই মুছে দেয় একটা পর্যায়ে। সুতরাং অমরতার ধারণাটির হাস্যকর, আর পরম প্রাপ্তি বলে জীবনে কিছু নেই। ভালেরি মনে করতেন, চৈতন্য প্রজ্ঞাপ্রদ। কিন্তু সেই প্রজ্ঞা শিল্পীকে জীবনভর যন্ত্রণায় দগ্ধ করে। সে একই সঙ্গে সুন্দরী যৌবনবতী, আবার ভয়ঙ্কর। সে আমাদের জ্ঞানী করে তুলতে অনেক সাহায্য করেছে; বিনিময়ে কেড়ে নিয়েছে চিত্তের প্রশান্তি। কবি-শিল্পীর মনে তা সত্ত্বেও আশা বেঁচে থাকে। আশা সৃজনের, আশা সুষমা উপভোগের, সর্বোপরি ঘৃণা-ভালবাসার আশ্চর্য ভারসাম্যের ভেতর বেঁচে থাকার! কিন্তু এই আত্মা বা সৃজনীচেতনার পরিণতি কি আমরা জানি না? উল্লেখ্যযোগ্য কবিতা ‘Graveyard by the sea’ (সাগরতীরে সমাধিক্ষেত্র)-এর শেষাংশে ভালেরি বলছেন, ‘And you, vast soul, do you hope for a dream/ which shall no longer have those lying colours/ which the wave and the gold make here for the eyes of flesh?/ will you sing when you are vapour?/ come! Everything passes away!/ My presence is porous;/ holy impatience also dies!’ (A. Hartley কৃত অনুবাদ)। ‘আর তুমি, বিশাল আত্মা হে,/ তোমার স্বপ্ন কি রক্ত-মাংসের শরীরে অস্তিত্বশীল তার বর্ণবিভাসহ?/ এখনও কি স্বপ্ন দেখো তুমি?/ বাষ্পীভূত তুমি এখনও কি গান করো? সবকিছু হারিয়ে যায়!/ আর আমার অবস্থা এখন সছিদ্র, যেন হাওয়া ও তরলের চলাচল উপযোগী; নির্দোষ জীবনস্ফূর্তিও হয়েছে বিলীন! (অনুবাদ : লেখককৃত)। অন্যদিকে The palme (তালগাছ) শিরোনামের বিখ্যাত কবিতায় ভালেরি লিখেছেন, ‘While between sand and sky,/ it remains ignorant of itself,/ each new day that shines. makes a little honey for it./ Its sweetness is measured by the divine length of time/ which does not count the days,/ but rather conceals them in juice/ where all the perfume of love is stored. (অনুবাদ : A. hartley) ‘বালুভূমি ও আকাশের মাঝখানে দাঁড়ানো/ সে (তালগাছ) যে সময় নিজের ব্যাপারে অচেতন/ তখন প্রতিটি ঝলমলে দিন তাকে মধু এনে দেয়/ তার মিষ্টতা মাপা যাবে না সময়ের/ অতিন্দ্রীয় দৈর্ঘ্য,ে সময়ের ওই ফিতা দিনগুলোকে মাপে না/ কেবল তাদের আড়াল করে ফেলে তালরসের ভেতর/ যেখানে সৌরভময় ভালবাসা জমা হতে থাকে গোপনে।’ (অনুবাদ : লেখক)। একজন কবি যদি একই সঙ্গে গদ্য লেখকও হন তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্টতা ধরা পড়ে সেই গদ্য রচনায়। পল ভালেরির বেলায়ও আমরা এটা লক্ষ্য করি। কেননা মানস গঠনের সারল্য বা জটিলতা কাব্যে তেমন ফুটে ওঠে না, যতখানি ফুটে ওঠে গদ্যে। ভালেরির সাহিত্যচিন্তার ও শিল্পভাবনার স্বচ্ছতার এবং স্পষ্টতার বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায় তার যৌক্তিক গদ্যের শৃঙ্খলা ও সাবলীলতার মাধ্যমে। অনুভূতিরর সূক্ষ্মতাই হচ্ছে সেই মুখ্য জিনিস যা তার গদ্য রচনাকে অপূর্ব সংবেদী আর হার্দ্য করে তুলেছে। বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদ এ লেখকের দুই প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সবকিছুর উর্ধে কাব্যের হৃদয়-সংবেদ্যহতাকে তিনি স্থান দিয়েছেন বলে মনে হয়। তাই বুদ্ধিজীবী কবিদের ‘মিথ’-এর সর্বাত্মক প্রয়োগের বিরোধী ছিলেন তিনি। কেননা বুদ্ধির কসরত এবং কবিতার মর্মরস একই সমান্তরালে অবস্থান করে না। মিথের অতিপ্রয়োগসহ নানা রকম দুর্বোধ্যতার বিপক্ষে, অতএব, কলমও ধরেছিলেন তিনি এবং যথারীতি ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন সমকালীক অনেক কবি-লেখককে। তার ওই ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের (সমালোচনায় প্রযুক্ত) জবাব হিসেবে আক্রান্ত লেখকরা এমন কথাও বলেছেন যে, আত্মপ্রশংসা ছাড়া ভালেরি অন্যকিছু বোঝেন না; তার সৌন্দর্যবাদও একান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যাহোক, তার গদ্যের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ভালেরির আলোচনা-সমালোচনামূলক গদ্যের প্রাচুর্য বিস্ময়কর। তার ‘ঈধযরবৎং’ (নোটবইসমূহ) প্রকাশিত হয়েছিল ঊনত্রিশ খণ্ডে মৃত্যুর পর। এ বিশাল গদ্যসম্ভারে কবিতা ছাড়াও ভাষা, দর্শন, গণিত, রাজনীতি, ধর্ম, পদার্থবিদ্যা, চিত্রকলাবিষয়ক চিন্তা-ভাবনার গভীর প্রতিফলন আছে। Notebooks Cahiers-এর দ্বাদশতম খণ্ডে ধৃত ‘Remarks on poetry’ শিরোনামের লেখায় ভালেরি কবিতা ও কবিতার পাঠক সম্বন্ধে বিদগ্ধ মন্তব্য করেছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি- The poetry reader is quite different./ It poetry truely acts on someone it is surely not by dividing him in his nature, by communicating him illusions of a fictious and purely mental life. Poetry imposes upon him no false reality which requires the submission of the mind and thus the abstention of the body. Poetry must extend over the whole being, for it aims to provoke or reproduce the unity and harmony of the living person.’ এ উদ্ধৃতি থেকে পাঠক, আশা করি, ‘ ‘ঈধযরবৎং’ বা ‘ঘড়ঃবনড়ড়শং’-এ কী ধরনের চিন্তাধারা মুদ্রিত হয়েছে তার একটা ধারণা পাবেন। উঁচুদরের সাহিত্যে আমরা পেয়ে থাকি আঙ্গিকের স্পষ্টতা এবং ব্যতিক্রমী প্রকাশ সামর্থ্য। ভালেরির কবিতা ও গদ্য সম্বন্ধেও আমরা একই কথা কলতে পারি। বিশ শতকে ফ্রান্সে অনেক বড় লেখকের আবির্ভাব ঘটেছে, যাদের মধ্যে পল এলুয়ার, লুই আরাগঁ’র মতো ব্যক্তিরাও আছেন। কিন্তু ভালেরিকে আমার সকলের চেয়ে আলাদা মানে হয়েছে- সুগভীর পা-িত্য, বৈদগ্ধ ও দর্শনদীপ্ত কাব্যিক উচ্চারণের জন্য। The penguin companion to Literature-এর দ্বিতীয় খণ্ডে (পৃষ্ঠা-৭৮৮) সমালোচক W. N Ince ভালেরির ওপর মন্তব্য করেছেন ‘He is incontestably one of frances greatest and most original poets and an outstanding example of our age of a genius who saw no gulf between the so called two culture (of 19th and 20th centuries) because he united them in himself so naturally and triumphantly. যথার্থই বলেছেন তিনি। ভালেরির যতটুকু পড়েছি তাতে মনে হয়, এ বক্তব্য রীতিমতো যৌক্তিকও। শুধু ফ্রান্সে নয়, গোটা ইউরোপের আধুনিক সাহিত্যে তার মতো যুগান্ধর লেখক সত্যিই বিরল।
×