ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদন ও মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঘোষিত হলো সমন্বয়মূলক মুদ্রানীতি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

উৎপাদন ও মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঘোষিত হলো সমন্বয়মূলক মুদ্রানীতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ উৎপাদন ও মূল্য পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সতর্ক, সংযত ও সমর্থনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে দীর্ঘদিন পর কমানো হয়েছে রেপো ও রিভার্স রেপোর সুদ হার। বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রেপো ও রিভার্স রেপো হার ৫০ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে যথাক্রমে ৬ দশমিক ৭৫ ও ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। যার ফলে ব্যাংক খাতে তহবিল ব্যয় আসবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে গতি আনতে অভ্যন্তরীণ ঋণ যোগানের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা গত মুদ্রানীতির চেয়ে এক শতাংশ কমিয়ে ১৫.৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বেসরকারী খাতে ঋণ যোগানের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৪.৮ শতাংশ। এটি আগের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সামান্য কম হলেও প্রকৃত অর্জনের চেয়ে যথেষ্ট বেশি বলে দাবি বাংলাদেশ ব্যাংকের। এছাড়া মুদ্রানীতির অন্যতম সূচক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬.১ শতাংশ। ঋণ যোগান ও ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কোন বিঘœ ঘটাবে না বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৃহস্পতিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে গবর্নর ড. আতিউর রহমান চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আগের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা নয় বরং ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্জিত বাস্তব চিত্র এবং বাজার পর্যবেক্ষণ করে এবারের মুদ্রানীতির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সতর্ক ও সংযত হলেও সমন্বয়মূলক। যেহেতু ব্যাংকগুলোর সুদহার কমে এসেছে সেহেতু রেপো এবং রিভার্স রেপোর সুদ হার সমন্বয় করে কমানো হয়েছে। যা বাস্তবতার আলোকে যুক্তিসঙ্গত। এছাড়া গত জুন মাস থেকে নবেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩.২ শতাংশ থেকে ১৩.৭ শতাংশ। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ শতাংশ। তাই এবার এই ঋণ প্রবৃদ্ধি বাস্তবতার নিরিখে যাচাই করে ১৪.৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। মুদ্রানীতিতে ৬.১ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরলেও সর্বশেষ ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬.২ শতাংশ। আর খাদ্য ও জ্বালানি বহির্ভূত কোর মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৬.৮ শতাংশ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও সমন্বয় করা হয়নি দেশে। এছাড়া নতুন স্কেলে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এমন পরিস্থিতিতে মূলস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কতটা যৌক্তিক এমন প্রশ্নের উত্তরে গবর্নর বলেন, দেশে জ্বালানি তেলের দাম না কমলেও আন্তর্জাতিক বাজারে কমার সুফল আমরা ঠিকই পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমায় উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঁচামালের খরচ কমেছে। এছাড়া জাহাজ ভাড়া কমায় আমদানি-রফতানির ব্যয়ও কমেছে। ফলে সার্বিকভাবে দেশেও অনেক পণ্যে দাম কমে এসেছে। তাই আগামী দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে বলে আমরা হিসাব করে দেখেছি। এর আগে সর্বশেষ ব্যাংকার্স সভায় ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীরা অলস অর্থ বিনিয়োগে সম্প্রসারিত মূদ্রানীতি চেয়েছিলেন। কিন্তু উল্টো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে জবাবে ডেপুটি গবর্নর এস কে সূর চৌধুরী বলেন, আসলে সমস্যা আমাদের অলস অর্থ নয় অলস ব্যাংকিং। দেশে বর্তমানে যে পরিমাণ তারল্য রয়েছে তার ৯০.৪ শতাংশ সিকিউরিটিকে বিনিয়োগ করেছে ব্যাংকগুলো। বাকি যে হার রয়েছে তা হিসেব করলে পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মতো, অলস বলতে এটুকুই। এই পরিমাণ অলস অর্থও থাকবে না। কারণ আমরা এবারের মুদ্রানীতিতে এসএমই খাতে বিনিয়োগের উপর জোর দিয়েছি। ব্যাংকগুলো যদি অলসতা ছেড়ে মাঠপর্যায়ে যায় এবং ব্যাপকহারে এসএমই ঋণ দেয় তবে ঋণের চাহিদা দ্রুতই বাড়বে। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়াবে। আগামী ছয় মাসে মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণ যোগানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮.৭ শতাংশ। যা গত ছয়মাসের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৫ শতাংশ কম। তবে বাস্তবে গত নবেম্বর পর্যন্তও সরকারের ঋণ নেয়া কমেছে। এ সময় ৪.২ শতাংশ হারে ঋণাত্মক হয়েছে ঋণ নেয়ার প্রবৃদ্ধি। তার পরও কেন ১৮ শতাংশের উপরে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হলো এমন প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. বিরুপাক্ষপাল বলেন, সার্বিকভাবে ফিসক্যাল পলিসির আলোকেই মুদ্রানীতি করে থাকি আমরা। সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সঞ্চয়পত্রের ওপর জোর দিয়ে থাকে। গত ছয়মাসে সেটাই হয়েছে। তাই সঞ্চয়পত্র থেকে ইতোমধ্যেই ৭৫ শতাংশ ঋণ নিয়েছে। ভবিষ্যতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেবে না এমন কোন ইঙ্গিত সরকার কখনই দেয় না। চলমান পদ্মা সেতু প্রকল্পসহ বিভিন্ন বড় প্রকল্পে সরকারের অর্থ প্রয়োজন হতে পারে। এছাড়া বেতন খাতেও সরকারের খরচ বেড়েছে, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। সার্বিকভাবে যে কোন কারণে সরকার যদি চায় যাতে আমরা সে অর্থ যোগান দিতে পারি সে জন্য একটা সুযোগ রাখতে হয়। যদি সরকার সে অর্থ না নেয় তবে আমরা অন্যদিকে বিনিয়োগ করতে পারব। কিন্তু সুযোগ রাখতেই হবে। ড. আতিউর রহমান বলেন, বরাবরের মতো এবারও আমরা বর্তমানের বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা বিবেচনায় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সমন্বয় করতে সদা প্রস্তুত রয়েছি। মাঝপথেও, এই নীতিভঙ্গি পরিবর্তনের সুযোগ অবারিত থাকবে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ওপর আগের মুদ্রানীতির প্রভাব তুলে ধরেন গবর্নর। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার অগ্রগতি ছিল বেশ ভাল। বছরের শুরুর দিকের কিছু চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও আমরা ৬.৫১ শতাংশের সম্মানজনক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছি। অর্জন করেছি ম্যাক্রো-অর্থনৈতিক ও মূল্য স্থিতিশীলতা। লিখিত বক্তব্যে গবর্নর বলেন, ২০১৫ সালেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি নয়া মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। গত বছরই আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে এখনও রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি ঘটলেও ইউরোপের অর্থনীতি এখনও দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। জাপানের অর্থনীতির পুনরুত্থান এখনও তেমন একটা লক্ষণীয় নয়। চীনের প্রবৃদ্ধি কিছুটা ধীর গতিতে হচ্ছে। কারণ তারা ইতোমধ্যেই তাদের বিনিয়োগ ও ম্যানুফেকচারিংনির্ভর অর্থনীতি থেকে ভোগ ও সেবানির্ভর অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। ভারত এবং অল্প কিছু দেশ ছাড়া উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অধিকাংশ দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আনন্দের বিষয়, আমরা সেই অল্প কিছু দেশের অন্যতম। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে সামনের দিনগুলোতে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি আরও ধীরগতির হতে পারে। ড. আতিউর রহমান বলেন, উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং রফতানি পণ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমাদের রফতানি খাতের আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। শুধু রফতানি বাড়ালেই হবে না। এখন সময় এসেছে রফতানির পাশাপাশি আরেকটি ‘গ্রোথ ইঞ্জিন’ যুক্ত করার। আর সেটি হচ্ছে আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা। তবে আশার কথা, আমাদের তরুণ কর্মক্ষম জনশক্তির সুবিধা, দ্রুত বিকাশমান মধ্যবিত্তের চাহিদা, প্রযুক্তি গ্রহণে তাদের সদা প্রস্তুতি, বাড়ন্ত বাজার পরিধি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব আমাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ইঞ্জিনটিকে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সামনের দিনগুলোতে এই দুই ইঞ্জিনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদার ইঞ্জিনটিকে আরও শক্তিশালী করাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। সেজন্য আমাদের জাতীয় সঞ্চয়ের হার আরো বাড়াতে হবে এবং সেই সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল খাতে বেশি করে বিনিয়োগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক খাতকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। ব্যাংকে পর্যবেক্ষক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নর বলেন, আর্থিক মধ্যস্থতার কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করতে সুশাসন ও সুপারভিশনের ওপর জোর গুরুত্ব দিয়েছি। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগেই এর প্রমাণ মেলে। বাজার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ড মার্কেটকে দেশে ও দেশের বাইরে এবং প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের জন্য আরো সুগম করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দেশীয় বিনিয়োগ ভিত্তিকে বহুমুখীকরণের মাধ্যমে এই বাজারকে আরও লিক্যুইড করা হচ্ছে। এই দীর্ঘমেয়াদী তহবিলকে গতিশীল করার জন্য পেনশন তহবিল এবং বীমা খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আইএফসির আসন্ন টাকা বন্ড বিনিয়োগের জন্য আরও সম্পদের যোগান দেবে এবং মুদ্রা বিনিয়োগ হারের ঝুঁকি কমাতে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করছি। এটি স্থানীয় মুদ্রা বন্ডকে টাকায় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সহায়তা করবে। আমাদের যথাযথ মুদ্রানীতি ও রেগুলেটরি সমর্থন টেকসই পুঁজিবাজার উন্নয়নেও সহায়ক হবে। এছাড়া, পরিবেশ উন্নয়নে আর্থিক খাতকে কাজে লাগাতে আমরা গ্রিন বন্ড ইস্যুর জন্যও কাজ করছি। এসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গর্ভনর আবুল কাশেম, আবু হেনা মোঃ রাজি হাসান, এস কে সুর চৌধুরীসহ নির্বাহী পরিচালক ও বিভিন্ন বিভাগের মহাব্যবস্থাপকরা উপস্থিত ছিলেন।
×