খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বিএনপি-জামায়াতের অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোলবোমা গত বছরের ১৫ জানুয়ারি কেড়ে নিয়েছে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাংতা গ্রামের বিধবা মায়ের একমাত্র আয়ের অবলম্বন পুত্র আবুল কালাম হাওলাদারকে (২৭)। অকালে পুত্রকে হারানোর শোকে আজও কাঁদেন তার বিধবা মা সাফিয়া বেগম। এছাড়া ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের তিনটি পয়েন্টে অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোলবোমার আঘাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই পুড়ে মৃত্যুবরণ করে ট্রাক চালক, হেলপারসহ ছয়জন। সূত্রমতে, রাংতা গ্রামের আব্দুল হক হাওলাদার মাত্র সাতবছর বয়সে আবুল কালামকে রেখে মারা যান। পরবর্তীতে পুত্রকে একমাত্র অবলম্বন করে কালামের বিধবা মা সাফিয়া বেগম অন্যের জমিতে দিনমজুরের কাজ করে ছেলেকে বড় করেন। সাফিয়ার দীর্ঘদিনের অভাবের সংসারে কেবল আলো জ্বেলে উঠতে শুরু করেছিল যখন কালাম ঢাকায় একটি প্রাইভেটকারের চালক হিসেবে চাকরি নেয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের অবরোধের পেট্রোলবোমা সে আলোকে নিভিয়ে দিয়েছে চিরদিনের জন্য। ঘটনারদিন মালিককে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি বের করেছিলেন কালাম। রাত সোয়া এগারোটার দিকে ঢাকার মগবাজারের আগোরা শপিং কমপ্লেক্সের সামনে পার্কিং করে রাখা প্রাইভেটকারের মধ্যে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কালাম। এমন সময় অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হন কালাম। স্থানীয়রা কালামকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। সেখানে সাতদিন পর ১৫ জানুয়ারি আবুল কালাম মৃত্যুবরণ করেন। ওইসময় ঢামেকের বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন পার্থ শঙ্কর পাল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আবুল কালামের শ্বাসনালীর ৩৩ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। বিধবা সাফিয়া বেগম জানান, তিনি সরকার ঘোষিত ১০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
পুড়ে অঙ্গার ট্রাক হেল্পার
এছাড়া ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি ভোরে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের উজিরপুরের সানুহারে ট্রাকে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে অবরোধকারীরা। এতে ঘটনাস্থলেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে য় মৃত্যুবরণ করে ট্রাকের হেলপার সোহাগ হাওলাদার (১৯)। অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন ট্রাক চালক একই এলাকার মীরের গ্রামের আব্দুল লতিফ শেখের পুত্র রিপন শেখ (২৯)। নিহত সোহাগ ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার শংকরপাশা গ্রামের মৃত সাগর হাওলাদারের পুত্র। তার মা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল সোহাগ। তার বাবা কোন ভূমি রেখে যেতে পারেননি। তাই সোহাগ তার অন্ধ মাকে নিয়ে শঙ্করপাশা গ্রামের মামা বাড়িতে থাকতেন।
জাফর ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম
একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদীর টরকীর নবীনগর এলাকায় লবণবাহী ট্রাকে অবরোধকারীদের ছোড়া পেট্রোলবোমায় ঘটনাস্থলেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন ট্রাক চালক ও হেলপার। নিহত ট্রাক চালক বাউফলের কালাইয়া গ্রামের মৃত আব্দুর রবের পুত্র নুর হোসেন ও হেলপার দশমিনার আদমপুরা গ্রামের শাহজাহান রাঢ়ীর পুত্র জাফর রাঢ়ী। নুর হোসেনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী মেরিনা বেগম তিন সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন। নিহত হেলপার জাফরের মা আছিয়া বেগম ও বৃদ্ধ পিতা শাহজাহান রাঢ়ীর সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল জাফর। নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, গৌরনদী থানা ও হাইওয়ে থানা পুলিশ পেট্রোলবোমার ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার কারণে তাদের দুটি অসহায় পরিবার সরকার ঘোষিত ২০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ভোরে একই মহাসড়কের গৌরনদীর দক্ষিণ মাহিলাড়ায় ট্রাকে অবরোধকারীরা পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে ঘটনাস্থলেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে ট্রাক ড্রাইভার, হেলপারসহ তিনজন মারা যায়। নিহত ট্রাকচালক ইজাজুল ইসলাম (৩৫), হেলপার মন্নু বিশ্বাস (৪৭) ও ইজাজুলের শ্বশুর মোতালেব শেখের (৬৫) বাড়ি ফরিদপুর সদর উপজেলার বিভিন্নস্থানে। চালক ইজাজুল ইসলাম ফরিদপুর সদর উপজেলার কৈজুরি ইউনিয়নের ডোমরাকান্দি গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের পুত্র। পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ইজাজুলের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী রিতা বেগম দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। হেলপার মন্নু বিশ্বাস একই জেলার গোয়ালচামচ এলাকায় বাসিন্দা। বরিশালের এক নিকট আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে আসা স্ত্রীকে নেয়ার জন্য মেয়ে জামাতা ইজাজুলের ট্রাকে বরিশালের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন মোতালেব শেখ।
সেই বিভীষিকায় আজও আতঙ্কে ওঠেন তারা
অপরদিকে পেট্রোলবোমার আঘাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে দীর্ঘদিন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া বরিশালের নদীভাঙ্গুলি মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের জব্বার খলিফার পুত্র আবুল হোসেন ও আগৈলঝাড়ার পশ্চিম রাংতা গ্রামের মৃত খালেক মল্লিকের পুত্র ফারুক হোসেন আজও সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা স্মরণ করে আঁতকে ওঠেন। সূত্রমতে, পেটের দায়ে এলাকা ছেড়ে স্ত্রী, সন্তান ও বাবা-মাকে নিয়ে রূপগঞ্জের তারাবোতে ভাড়া বাসায় বসবাস করা আবুল হোসেন কাজ করতেন একটি সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি রাতে গুলিস্তান থেকে গ্লোরি পরিবহনের বাসে রূপগঞ্জের বাসার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন আবুল হোসেন। ডেমরার কোনাপাড়ায় আরও ২৬ যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হন।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: