ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইছালে সওয়াব মহফিলের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইছালে সওয়াব মহফিলের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইছালে সওয়াব মহফিল আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে যুগ পরস্পরাগতভাবে। এই ইছালে সওয়াব মহফিলের অর্থ সওয়াব পৌঁছানোর সম্মেলন। সাধারণত বছরে একবার এই মহফিল বিশেষ করে বিভিন্ন পীর সাহেবের খানকা শরীফে অনুষ্ঠিত হয়, আবার কোথাও কোথাও উরস নামের এই মিলন উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। তবে লক্ষ্য করা গেছে উরসের নামে যেসব বার্ষিক মহফিল অনুষ্ঠিত হয় তার অধিকাংশই র্শিক, কুফ্র বিদা’আত প্রভৃতি অনুষঙ্গ দ্বারা আচ্ছাদিত, যেখানে সওয়াব লাভের আশা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এর মানে এই নয় যে, সমস্ত উরসই ঐ দোষে দুষ্ট। ৬ রজব আজমীর শরীফে সুলতানুল হিন্দ গরীবে নওয়াজ খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযার শরীফে যে র্উস হয় সেখানে মানুষ খাজা মঈনুদ্দীন চিশ্তীর মাযার শরীফ যিয়ারত করে বহু ফায়দা হাসিল করে। কিন্তু সেই উরসকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর শরী’আত ও মা’রিফাত সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষ যে সমস্ত কার্যকলাপ করে তা শরী’আত সম্মত নয়। আমাদের দেশের গজিয়ে ওঠা এমন কিছু খাজাবাবা, বিশ্বওলী, সুফী সম্রাট, দয়াল বাবা কলবধারীদের কেন্দ্র করে মহাপবিত্র উরস শরীফের নামে যে সমস্ত কা--কারখানা চালু আছে সেগুলোতে শরিক হয়ে মহামূল্যবান ঈমান-আকিদা বরবাদ করা ছাড়া কোন লাভ হয় না, আবার এমন কিছু উরস অনুষ্ঠিত হয় যেখানে শরিক হলে রূহানী তরক্কী তো হয়ই সেই সঙ্গে ঈমান-আকিদা মজবুত বুনিয়াদ লাভ করে। যেমন প্রতিবছর ১৬ চৈত্রে অনুষ্ঠিত যশোরের খড়কী শরীফের উরস মুবারক। এই উরস শতাধিক বছর ধরে নির্দিষ্ট তারিখে হয়ে আসছে। এটার প্রতিষ্ঠা করেন বাংলা ভাষায় রচিত সর্বপ্রাচীন নির্ভরযোগ্য মৌলিক ও প্রামাণ্য তাসাওউফ গ্রন্থ এরশাদে খালেকীয়া বা খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্ব গ্রন্থের লেখক হযরত মওলানা শাহ্ সুফী মোহাম্মদ আবদুল করিম রহমাতুল্লাহি আলায়হি। এই গ্রন্থ সম্পর্কে প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান ও প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের যৌথ গ্রন্থনায় গ্রন্থিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত গ্রন্থেও ইসলামী সাহিত্য পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আবদুল করিম ছিলেন নক্শবন্দীয়া তরিকার একজন কামিল সুফী সাধক, নিজের জীবনে সুফীতত্ত্বের আমল করেছিলেন বলে দুরূহ সূফীতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান ছিল। প্রথম থেকে চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি তাসাওয়াফের জটিল দার্শনিক তত্ত্বের মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং পঞ্চম থেকে নবম অধ্যায়ে সূফী সাধনার নক্শবন্দীয়া, কাদেরিয়া এবং চিশ্তিয়া তরিকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। দশম বা শেষ অধ্যায়ে তিনি বেদ, পুরাণাদিতে প্রচলিত দার্শনিক বিষয়বস্তুর তত্ত্ব উদঘাটন করে ইসলামী সূফী মতবাদের সঙ্গে তার একটি তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। মোহাম্মদ আবদুল করিমের খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্বের মতো বাংলায় তাসাওয়াফ সম্পর্কিত বই আর দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৫৩)। এই গ্রন্থে উপযুক্ত পীরের লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে: পীরকে লোভশূন্য হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। লোভী ব্যক্তিকে ফকির জ্ঞান করিতে হইবে না এবং ফকির কখনও ঢং করিয়া অর্থোপার্জনের জন্য বুজুর্গী করিয়া বেড়ায় না। তাঁহারা সততই গুপ্ত থাকিতে চেষ্টা পান, প্রকাশ হওয়াকে ভালবাসেন না।...যাহার কোন রিপু বলবৎ আছে, তাহাকে সিদ্ধ ফকির বলিয়া জানিতে হইবে না।...তাহাদের মিষ্টালপন-কুহকজাল হইতে সতর্ক থাকিবেন। আমাদের দেশে একশ্রেণীর উরসে লোক জড়ো করবার জন্য যেসব প্রচারণা-কৌশল প্রয়োগ করা হয় তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় তাতে বেশ এক বড় ধরনের কিন্তু রয়েছে। আর এই কিন্তুকে দূর করবার জন্য ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দিদে যামান মওলানা শাহ্ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ফাল্গুন মাসের ২১, ২২, ২৩ তারিখ নির্ধারণ করে ফুরফুরা শরীফে ইসালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করেন যা আজও ঐ তিনদিন ধরে সেখানে লাখ লাখ লোকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তিনি এই মহফিল সম্পর্কে বলেছেন: আমি জানি, আল্লাহ বলিয়াছেন: ইয়া আইয়ুহাললাযীনা আমানু কুও আনুফুসাকুম ওয়া আহলীকুম নারা-‘হে ইমানদারগণ তোমরা নিজেদিগকে ও নিজেদের পরিজনকে অগ্নি হইতে রক্ষা কর। এই আয়াতের মর্ম অবলম্বনে আমার বাড়িতে দেশী-বিদেশী সকলকে আমদাওয়াত দিয়া বহু আলেম-ওলামা, হাফেজ, ক্বারী কর্তৃক ওয়াজ-নছিহত করাইয়া ও নিজে করিয়া শরিয়তের হুকুম আহ্কাম জানাইয়া দেই। ...৬০/৭০ খতম কুরআন শরীফ, সূরা এখলাছ ও ফাতেহা, কলেমা ইত্যাদি পড়ানো হয়। এই সমস্তের সওয়াব হযরত নবী (সা.) এর ও যাবতীয় অলি আওলিয়া গওছ, কুতব ও যাবতীয় মুসলমানদের রূহের ওপর সওয়াব রেছানী করা হয়। এই জন্য এই মহফিলের এক নাম ইছালে সওয়াব। এই মহফিল যাতে আল্লাহ কায়েম রাখেন, তার চেষ্টা আমার পুত্রগণ, খলিফাগণ ও মুরিদগণ করবেন। খলিফাগণের মধ্যে যদি কাহারও বাড়িতে এরূপ মহফিল করতে কারও শক্তি হয়, তবে তিনি তাহা করিবেন। সাবধান! কেহ যেন অর্থের লোভে বা অন্য কোনরূপ মান মর্যাদার জন্য না করেন। বিশুদ্ধ হেদায়াতের নিয়তে করিলে বহু নেকী পাইবেন। আরও সাবধান থাকিবেন যে, যেন এই মহফিলে কোন প্র্রকার বেদয়াত ও হারাম কার্য বা নামাজের জামাত তরক না হয়। বাজে তামাশা ইত্যাদি না হয়। (মওলানা মোহাম্মদ রুহল আমিন, ফুরফুরা শরীফের হযরত পীর সাহেব কেবলার বিস্তারিত জীবনী, প্রথম সংস্করণ, কলিকাতা ১৯৩৯, পৃ-২৪২-২৪৩)। ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামান হযরত মওলানা শাহ্ সূফী আবু বকর সিদ্দিকী (রহ) তাঁর প্রধান প্রধান খলিফাগণের বাড়িতে তারিখ নির্ধারণ করে ইছালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করে যান- যা আজও অব্যাহত রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: শর্ষীনার ইছালে সওয়াব-যা অনুষ্ঠিত হয় ১৪, ১৫, ১৬ অগ্রহায়ণ, যশোরের (বর্তমান মাগুরা জেলা) দ্বারিয়াপুর শরীফের ইছালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল-যা প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় ৪ঠা মাঘ। এ ছাড়াও কুমিল্লার ধামতিতে, যশোরের ইনায়েতপুরে, ফরিদপুরের ডোবরায়, পটুয়াখালীর আমতলীতে, সাতক্ষীরার হামিদপুরে, নোয়াখালীর শ্রীনদীতে এবং অন্যান্য প্রায় শতাধিক স্থানে ইছালে সওয়াব মহফিল অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন তারিখে। ফুরফুরা শরীফের মুজাদ্দিদে যামানের অন্যতম প্রধান খলীফা দ্বারিয়াপুর শরীফের পীর সাহেব কিবলা হযরত মওলানা শাহ্ সূফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর পীরের নির্দেশে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে যে ইছালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল কায়েম করেন তা আজও ৪ঠা মাঘ তারিখেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইছালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে খতমে কুরআন বহুবার করা হয়। এছাড়াও বাদ মাগরিব তরীকতের নিয়ম অনুযায়ী এক ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে যিক্র-আয্কার, তা’লীম-তালকীন প্রদান করা হয়। হাজার হাজার মানুষ যখন একযোগে অনুচ্চস্বরে আল্লাহ্ আল্লাহ্ নাম মুবারক যিক্র করে, লাইলাহা ইল্লাল্লাহ্ ুযিক্র করে, কিংবা জীবনের তাবত্ গোনাহ্র কথা স্মৃতিতে এনে তওবার ফয়েজ রপ্ত করে রব্বানা জলামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম মাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানা কুনান্না মিনাল্ খাসেরীন মনে মনে খেয়ালের সঙ্গে পাঠ করে এবং কাঁদতে থাকে তখন এক অনন্য পবিত্র পরিবেশ সমস্ত মহফিল আঙিনাজুড়ে প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। ‘ইশার নামায বাদ শুরু হয় বিভিন্ন আলিমের ওয়াজ-নসিহত-যা রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত চলে, একপর্যায়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা হয়, তারপর বিভিন্ন স্থানে একজন একজন দাঁড়িয়ে সুমধুর স্বরে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি সালাত ও সালাম অর্থাৎ আসলাতু আস্সালামু আলায়কা ইয়া রসূলাল্লাহ পেশ করতে থাকে। তারপর ফজরের আযান হবার পর ফযরের নামায আদায় করা হয়, তারপর যিক্র-আয্কার, তারপর মিলাদ মহফিল ও কীয়াম অনুষ্ঠিত হয় অন্ততপক্ষে দু’ঘণ্টা ধরে, তারপর সওয়াব রিসানীহয় আখেরী মুনাজাতের মাধ্যমে। তামাম আম্বিয়া কেরাম, সাহাবায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, আজওয়াজে মুুতাহিরা, আশারায়ে মুবাশ্শিরা, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, তরীকতের ইমামগণ সমস্ত ওলী আল্লাহ্গণ মুুমিন, মুমিনাত, মুসলিমিন-মুসলিমাতসহ যাঁরা ইন্তিকাল করেছেন সবার রূহে সওয়াব পৌঁছানো হয় এবং বিশ্ব শান্তির জন্য বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্যসহ তাবত্ বিষয়ে দু’আ করা হয়। এই সময় বিরাট সমাবেশে যে ক্রন্দনরোল ওঠে তা যেন আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করতে থাকে। এসব ইছালে সওয়াব মহফিলে শরী’আতবিরোধী কোন কিছু হয় না-হতেও পারে না। এসব ইছালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিলকে হিদায়াত লাভের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের মহফিল থেকে বহু লোক হিদায়ত লাভ করে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে এবং হিদায়ত লাভ করে আসছে। ইছালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে আলোকিত পথের দিকে আহ্বান করা হয়। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন: উদ’উ সাবিলে রাব্বিকা বিলহিকমাতি ওয়াল মাও’ ইজাতিল হাসানা-মানুষকে তোমার রব্-এর পথে আহ্বান করো হিক্মতের মাধ্যমে এবং সুন্দর সুন্দর ওয়াজ নসিহত দ্বারা। (সূরা নহ্ল: আয়াত ১২৫)। ইছালে সওয়াব ও ওয়াজ মহফিল ঐ আয়াতেকারীমা পালনের এক অনন্য ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×