ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

‘সবচেয়ে আশাবাদের দেশ’ সৃষ্টির কারিগরকে অভিনন্দন

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

‘সবচেয়ে আশাবাদের দেশ’ সৃষ্টির কারিগরকে অভিনন্দন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের দুই বছরপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন মঙ্গলবার রাতে। ওই দিনই সকালবেলা সকল সংবাদপত্রে একটা খবর ছাপা হয়। ওই খবরে বলা হয়, সারাবিশ্বে সবচেয়ে আশাবাদের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বলাবাহুল্য, এটি একটি জরিপের ফল। জরিপটি কোন বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান করেনি, সরকারের তো নয়ই। যারা করেছে সেই প্রতিষ্ঠানের নাম ‘উইন ও গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল’। এটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ওই জরিপে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে আশাবাদের দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। আশাবাদের প্রশ্নে বাংলাদেশের ‘স্কোর’ হচ্ছে ৭৪ শতাংশ। দশটি দেশের মধ্যে আশাবাদের নিরিখে দ্বিতীয় দেশটি হচ্ছে চীন। তাদের স্কোর হচ্ছে ৭০ শতাংশ। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হচ্ছে- এই তালিকায় পাকিস্তান দশ নম্বরে আর ভারত নয় নম্বরে। তাদের স্কোর যথাক্রমে ৪২ ও ৪৭ শতাংশ। অন্য যারা এই তালিকায় স্থান পেয়েছে তারা হচ্ছে- নাইজিরিয়া, ফিজি, মরক্কো, সৌদি আরব, ভিয়েতনাম ও আর্জেন্টিনা। এদিকে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ এই দশটি দেশের মধ্যে দ্বিতীয়। এখানে ‘স্কোর’ ৬০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা নাইজিরিয়ার। তাদের স্কোর ৬১ শতাংশ। মজার ফল হচ্ছে চীনের। তারা এই তালিকায় তৃতীয়, স্কোর ৫৪ শতাংশ। ভারতের স্কোর ৪৪ শতাংশ এবং তালিকায় স্থান ছয় নম্বরে। একটু বিস্তারিতভাবেই জরিপের ফলটি উপরে উল্লেখ করলাম। যারা খবরটি পড়েছেন তাদের অনেকের মতো আমার মনে একটি প্রশ্ন কাজ করেছে। এই আশাবাদের ভিত্তি কী? বাংলাদেশের মানুষ কিসের ভিত্তিতে এত আশাবাদ ব্যক্ত করল? আমি জরিপের দিকে যাব না। এমনটিতেই দেখতে পাচ্ছি আশাবাদের শক্ত ভিত্তি আছে। যারা মনোযোগসহকারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি পড়বেন তারাই বুঝতে পারবেন মানুষ আশাবাদী হচ্ছে অনেক কারণে, যার একটা ইঙ্গিত তিনি তার ভাষণে দিয়েছেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে আশাবাদের কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয়ই। ১৬ কোটি মানুষ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্বকালীন ভয়াবহ দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। গত দুই বছর যাবত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। জ্বালাও-পোড়াও নেই। এই স্থিতিশীলতার ফল পাচ্ছে অর্থনীতি, ফল পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। শুধু দুই বছরের বিষয় নয়, দেখা যাচ্ছে বিগত সাত বছর যাবত অব্যাহতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছয় শতাংশের ওপর ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যাচ্ছে, যা একটা আশাপ্রদ ঘটনা এবং আঞ্চলিকভাবে একটা বড় উদারহণ। দেখা যাচ্ছে, এই দ্রুত অব্যাহত উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ‘জিডিপি’র ভিত্তিতে আজ বিশ্বে ৪৫তম। আর যদি ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি অর্থাৎ পারচেইজিং পাওয়ার প্যারিটি) হিসাব করা হয় তাহলে আমাদের অর্থনীতি আজ বিশ্বে ৩৩তম। ভাবা যায় এই অর্জনের কথা! ২০০৯ সালের দিকে দেশে খাবার নেই, টাকা দিয়েও বিশ্বে চাল পাওয়া যায় না। যার কথা প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলবেন কেন? এটা তো চোখের দেখা। তখনকার অন্ধকার দিনগুলোর কথা তো এখনও মনে পড়ে। বাসায় বিদ্যুত নেই, অফিসে বিদ্যুত নেই, কারখানায় বিদ্যুত নেই, কৃষিতে বিদ্যুত নেই। খাদ্যের অভাব। ‘আলু খাওয়ার’ জন্য গান বানানো হয়। কত কীর্তি। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। ব্যবসায়ীরা নাজেহাল। কত আর বলব। এসব কী আজ আছে? নেই। তাহলে মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস কেন ফেলবে না। তাহলে মানুষ আশাবাদী কেন হবে না। চালে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। চালের দাম স্থিতিশীল। বাজারে অফুরন্ত চাল। চালের অভাবে, ভাতের অভাবে কেউ ভোগে না। উত্তরবঙ্গে মঙ্গা নেই। মঙ্গা শব্দটি নির্বাসিত। যে উত্তরবঙ্গের কোন লোককে ঢাকায় দেখা যেত না, আজ সেই উত্তরবঙ্গের লোকে ঢাকা ভর্তি। তারা অবশ্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমজীবী। ক্ষতি কী? দৈনিক মজুরি তো তারা পাচ্ছে। দরিদ্রের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেছেন পাঁচ কোটি লোক নিম্ন আয় থেকে মধ্য আয়ে উন্নীত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই পাঁচ কোটি লোকের একটা বড় বাজারের দেশ বাংলাদেশ। এটা কিন্তু বিশাল ঘটনা। বাংলাদেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ লোক বাজার অর্থনীতির বড় অংশীদার। তারাই ক্রেতা, বড় বড় ক্রেতা। ফ্ল্যাট কিনছে তারা, গাড়ি কিনছে তারা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদির সেবা নিচ্ছে এরা। এরাই দেশ-বিদেশ করছে। এরা অর্থনীতির ভিত্তিই শুধু শক্ত করছে না, সমাজকে করছে উদার ও জ্ঞানভিত্তিক। এগুলো কী আশাবাদী হওয়ার কারণ নয়? অবশ্যই এসব ঘটনা বাংলাদেশের মানুষকে আশাবাদী করছে। ভাবা যায় যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪১ শতাংশ, সেখানে আজ তা মাত্র ২২ শতাংশ! রেমিটেন্সের পরিমাণ গত ছয়-সাত বছরে প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অর্থ কী? এই রেমিটেন্সের ডলার দিয়ে অর্থনীতি সচল রাখা হচ্ছে, আমদানির প্রয়োজন মেটানো যাচ্ছে। আর গ্রামের অর্থনীতি হচ্ছে উজ্জীবিত। এর সুবিধা ভোগ করছে সরাসরি প্রায় পাঁচ কোটি লোক। এক কোটি-সোয়া কোটি লোক বিদেশে চাকরি করে এবং ডলার পাঠায়। প্রতিটি পরিবারে চারজন করে লোক ধরলে তা হয় পাঁচ কোটি। এই পাঁচ কোটি গ্রামের মানুষ ডলার পাচ্ছে। তারা কিছু সঞ্চয় করছে, গ্রামাঞ্চলে কিছু বিনিয়োগ করছে, বাড়িঘর পাকা করছে, পয়ঃপ্রণালী পাকা করছে, পানীয়জলের ব্যবস্থা করছে। উন্নত জীবনের স্বাদ পাচ্ছে তারা। এসব লোক কেন আশাবাদী হবে না? তারা কেন স্বপ্ন দেখবে না? তাই ঘটছে বাংলাদেশে। ‘উইন ও গ্যালাপ’ আকাশ থেকে খবর পায়নি যে, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আশাবাদী। সারাদেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুত পায়। গ্রামাঞ্চলে গেলে বোঝাই যায় না গ্রামে গেছি, না শহরে আছি। বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুত যাচ্ছে। মানুষের আনন্দের সীমা নেই। দলবেঁধে পল্লী বিদ্যুতে টাকা জমা দিচ্ছে- বিদ্যুতের লাইন নেবে বলে। গ্রামের বাজারগুলো বিদ্যুতের আলোকে জ্বলজ্বল করে এখন। উপজেলা পর্যায়ে এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানও আছে। উপজেলা পর্যায়ে, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে পর্যন্ত ব্যাংকের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা স্কুল ব্যাংকিংয়ের আওতায় ব্যাংক হিসাব খুলছে। টাকা জমাচ্ছে। ব্যাংকিং সেবার এই উন্নতি মানুষের সাড়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। গ্রামের উন্নয়নে এই সাড়া কাজে লাগছে। আনন্দের খবর, বড়ই আনন্দের খবর- শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশ অসামান্য ফল দেখিয়েছে। মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলেমেয়েদের অংশগ্রহণের হার ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অর্জন আজ বিশ্বস্বীকৃত। এসব দেখে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাতব্বর শ্রেণীর লোকেরা এখন ঢাকায় এসে যেচে যেচে বাংলাদেশের প্রশংসা করছে। অথচ তারাই একদিন বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে নিন্দা করেছিল। ভাবা যায়, বাংলাদেশের বাজেটের আকার এখন দুই লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। শুধু বাজেটের আকারই বৃদ্ধি পায়নি, উন্নয়ন বাজেটের আকারও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় এক লাখ কোটি টাকা এখন আমাদের উন্নয়ন বাজেটের আকার। পূর্বতন বিএনপি সরকার পরিকল্পনা তুলে দিয়েছিল। কিসের পরিকল্পনা, যাচ্ছেতাইভাবে চলবে অর্থনীতি। পরিকল্পনার কোন প্রয়োজন নেই। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, তাহলে সাহায্য পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। ‘মঙ্গা’ শব্দের অর্থ বুঝতেন না সাইফুর রহমান সাহেব। সেই স্থলে ষষ্ঠ পরিকল্পনা ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কাজ। বিশাল আয়োজন। সরকারের অনেক মন্ত্রীই বিশ্বাস করতে চান না এই পরিকল্পনার টার্গেটগুলোকে। কিন্তু সবই সম্ভব মানুষের সমর্থন পাওয়া গেলে। যে আশাবাদ বাংলাদেশের মানুষ পোষণ করে, যে আশাবাদ পোষণ করতে সরকার ভিত্তি রচনা করে দিয়েছে, সেই আশাবাদকে বাস্তবে বড় রূপ দিতে এখন দরকার বিচক্ষণ প্রশাসন ও রাজনীতি। বর্তমান সরকার আশা করি এদিকে সজাগ। পরিশেষে মার্কিন জরিপ সংস্থার জরিপের যে ফল- সবচেয়ে বেশি আশাবাদী বাংলাদেশ- তার ভিত্তি রচনার কারিগর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন, তার সরকারের দুই বছরপূর্তি উপলক্ষেও তাকে অভিনন্দন। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×