ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ ॥ জ্যাকব

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৪ জানুয়ারি ২০১৬

মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ ॥ জ্যাকব

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করলেন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এএকে নিয়াজী। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর কাছে সেই স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই জন্ম হলো নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। ঐতিহাসিক সেই আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া নিজে লিখেছিলেন তখনকার ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় চীফ অব স্টাফ লে. জেনারেল (অব.) জেএফআর জ্যাকব। শুধু দলিলের খসড়া রচনাই নয়, নিয়াজীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার কৃতিত্বও তার। অবিস্মরণীয় সেই অর্জনের ৩৬ বছর পর আবার জ্যাকব এদেশে এসেছিলেন। ৩৭তম স্বাধীনতা দিবসে বাংলাদেশের আমন্ত্রণে শুভেচ্ছা সফরে আসা মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা ১১ জনের একটি প্রতিনিধি দলের প্রধান হয়ে। ঐ সময় ভারতীয় হাইকমিশনে সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এই অন্যতম বীর ফিরে গিয়েছিলেন লড়াইয়ের সেই দিনগুলোতে। আলোকপাত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রেক্ষিতের ওপর।- বিডিনিউজ। লে. জেনারেল (অব.) জেএফআর জ্যাকব প্রশ্ন : জেনারেল, আপনি তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নিয়েছেন, ইহুদিদের ওপর চালানো নিধনযজ্ঞের কথা জানেন। ১৯৭১ সালে জাতিগত বিশোধনের নামে বাঙালীদের বিরুদ্ধে যে গণহত্যা চালিয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী, সেটা কি চোখে দেখেন? উত্তর : পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংসতার কথা আপনাদের চেয়ে ভালো আর কে বলতে পারবে। এ ব্যাপারে আর যে কারও চাইতে বেশি তথ্যবহুল এবং খুঁটিনাটি বর্ণনাসমেত রেকর্ড রয়েছে আপনাদের কাছে। আপনারা ওই নির্মমতার সাক্ষী, তাই এ ব্যাপারে আপনারাই সঠিক রায় দিতে পারবেন। প্রশ্ন : আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সম্পৃক্ততা কখন থেকে? উত্তর : এ ব্যাপারে সরকারী ভাষ্য জানতে চান না বেসরকারী? (হেসে) ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছিলাম। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর রেডিও বার্তা শুনে আমরা বিস্ময়ে থ’ হয়ে গেলাম। আমরা মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনেছি, এরপর জিয়ার। আর তারপর শুরু হলো সীমান্ত অভিমুখে বাংলাদেশের শরণার্থীদের অবিশ্বাস্য ঢল। আমরা পরিস্থিতি বিচার করে মুক্তিবাহিনীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলাম। এপ্রিলে তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, ওসমানী- সবাই কলকাতার থিয়েটার রোডে জড়ো হলেন। মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হলো আর শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। আমরা সম্ভাব্য সব ধরনের রসদ দিয়ে তাদের সাহায্য করেছি। বেসরকারী হিসেবে এপ্রিল থেকেই আমরা এই যুদ্ধে সহযোগিতা দেয়া শুরু করেছি, সরকারী ভাষ্যমতে আরও অনেক পরে। প্রশ্ন : ভারতীয় বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি কি রকম? উত্তর : এটা আমার বইয়ে লেখা আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ১ হাজার ৪০০ ভারতীয় সেনা প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে ৪০০ জন। প্রশ্ন : গত বছর এক টিভি সাক্ষাতকারে আপনি দাবি করেছেন যে, ঢাকা দখলের চিন্তা ভারতীয় বাহিনীর মূল পরিকল্পনায় ছিল না। কিন্তু আপনি সে আদেশ অমান্য করে ঢাকা দখলের জন্য ছোটেন। উত্তর : আসলে এটা বিশাল কাহিনী, শুনতে গেলে বিরক্ত হয়ে যাবেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত লেখা হয়েছে আমার বইয়ে। কখন কিভাবে কি হয়েছে, আমাদের যুদ্ধ কৌশল ও সামর্থ্যরে খুঁটিনাটি বর্ণনা আছে ওখানে। প্রশ্ন : এটা কি সত্যি যে ভারত যুদ্ধের আগে থেকেই স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল? উত্তর : না, যুদ্ধের আগে না। সত্যি বলতে ১৩ এপ্রিল থেকে আমরা তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছি। আর ক্রমেই তা বেড়েছে। প্রশ্ন : পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করতে পারে সেটা কিভাবে আন্দাজ করলেন? উত্তর : ১৪ ডিসেম্বর আমরা খবর পেলাম গবর্নর হাউসে একটা বৈঠক হবে। সেখানে নিয়াজী থাকতে পারে ভেবে আমরা বিমান হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিই। হামলার পর গবর্নর (মালেক) পদত্যাগ করেন এবং হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে (পরে যা শেরাটন) আশ্রয় নেন। পরিস্থিতি তখন ক্রমশ জটিল হচ্ছিল। জাতিসংঘ চেষ্টা করছিল যুদ্ধবিরতির। আর রাশিয়া চাপ দিচ্ছিল যা করার দ্রুত করতে। কারণ তারা আমাদের পক্ষে ঘন ঘন ভেটো দিয়ে বিব্রত বোধ করছিল। সেই দুপুরেই জেনারেল নিয়াজী যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব পাঠান জাতিসংঘে। ভুট্টো তখন নিউইয়র্কে। তিনি সে প্রস্তাব বাতিল করে দেন। ১৫ ডিসেম্বর দিল্লীতে আমাদের কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। আমরা সেটা গ্রহণ করি। ১৬ ডিসেম্বর সকালে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় পাকিস্তানী বাহিনীকে আত্মসমর্পণে রাজি করাতে। প্রশ্ন : বলা হয় যে আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া আপনিই করেছিলেন। প্রস্তাবটা দেয়ার পর নিয়াজীর প্রতিক্রিয়া কি ছিল? উত্তর : নিয়াজী বললেন, আপনাকে কে বলেছে আমরা আত্মসমর্পণ করব! আপনার তো যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করার কথা। তর্ক চলতেই থাকল। অচলাবস্থা সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা নিয়ে। নিয়াজীর দাবি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। কিন্তু আমি সেটা প্রত্যাখ্যান করে জোর দিলাম যে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। পরে নিজের দেশে হামদুর রহমান কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আত্মসমর্পণের কারণ হিসেবে নিয়াজী বললেন আমি নাকি তাকে ব্ল্যাকমেল করেছি! নিজের বইতেও একই কথা লিখেছেন তিনি। আমি কেন তাকে ব্ল্যাকমেল করব? আমি গেছি আত্মসমর্পণ নিয়ে সমঝোতা করতে, ব্ল্যাকমেল করতে না। অবশ্য আমি তাকে বলেছি যে আত্মসমর্পণ না করলে পরবর্তী হিংসাত্মক পরিস্থিতির দায় আমরা নেব না। এরপর তাকে ভাবার জন্য তিরিশ মিনিট সময় দিলাম। যখন ফিরে এলাম, নিয়াজী তখনও নিশ্চুপ। আমি তার সামনে গিয়ে বললাম, আপনি কি এই চুক্তি মানতে রাজি আছেন? পরপর তিনবার জিজ্ঞেস করার পরও কোন উত্তর দিলেন না তিনি। তখন আমি দলিলটা হাতে নিয়ে বললাম, ধরে নিচ্ছি আপনি আমার দাবি মেনে নিয়েছেন। এরপর দেখি তার চোখে জল। আমি সেদিকে করুণাভরে তাকিয়ে ভাবলাম, এই লোকটা বাংলাদেশের মানুষকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আপনারা জানেন, তার সেনাবাহিনী কি করেছে, তাই নতুন করে তা বলার নেই। এজন্য আমি তাকে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। নিয়াজী আবারও বললেন তিনি তার সদর দফতরে আত্মসমর্পণ করবেন। আমি বললাম, না, আপনাকে রেসকোর্স ময়দানে ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি নিয়মিত বাহিনীর প্রকাশ্য আত্মসমর্পণই শুধু নয়, আমি তাদের গার্ড অব অনার দিতেও বাধ্য করলাম। এই মানুষটিই বলেছিলেন যে ঢাকা দখল করতে হলে তার লাশের ওপর দিয়ে করতে হবে। এজন্যই তাকে আমি ঢাকাবাসীর সামনে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলাম। উনি বড়াই করে বলেছিলেন আরো দু’সপ্তাহ ঢাকা দখলে রাখার মতো ক্ষমতা তার আছে। আগেই বলেছি আর দু’য়েকদিন দেরি হলেই জাতিসংঘ তাদের যুদ্ধবিরতি আদেশ কার্যকর করত। তাহলে ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণে তিনি কিভাবে রাজি হতে পারলেন! তার উত্তর- ‘জ্যাকব আমাকে ব্ল্যাকমেল করেছে।’ প্রশ্ন : আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী থাকেননি কেন? উত্তর : এ নিয়ে অনেক গালগল্প কানে এসেছে। উনি কাউকে না জানিয়ে সিলেট চলে গিয়েছিলেন। পথে তার হেলিকপ্টারে গুলি করে পাকিস্তানী সেনারা। সে সময় আমি বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় সবাইকেই কলকাতায় থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু ওসমানী হেলিকপ্টারে করে ঘুরতে গিয়ে গুলি খেলেন আর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে থাকতে পারলেন না। এটা তো আমাদের দোষ না। তার অবশ্যই ওখানে থাকা উচিত ছিল, আমরা চেয়েছি উনি যেন অবশ্যই থাকেন। পরে তার জায়গায় খন্দকার ছিলেন। প্রশ্ন : পরে তো নিয়াজী এবং রাও ফরমান আলীকে জেরা করার সুযোগ হয়েছিল আপনার। তখন তারা কি বলেছে? উত্তর : তারা সব অভিযোগ অস্বীকার করে। তারা নাকি কোনো ধরনের গণহত্যা, ধর্ষণ বা এ ধরনের নৃশংসতায় জড়িত ছিল না। এর পাশাপাশি হুমকি দিয়ে বলেছিল তারা এই অপমান কখনোই ভুলবে না এবং এর বদলা (প্রতিশোধ) নেবে। প্রশ্ন : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনেকেই আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ কিংবা গৃহযুদ্ধ বলে অভিহিত করেন যেটা আমাদের জন্য অপমানজনক। আপনি ব্যাপারটা কিভাবে দেখেন? উত্তর : আমি সবসময়ই বলেছি, এটা আপনাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ। আপনাদের মুক্তিযুদ্ধ। প্রশ্ন : সম্প্রতি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আবার বেগবান হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডাররা এতে যোগ দেয়াতে। অনেকে বলেন ভারতের কাছে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ ও উপাত্ত রয়েছে। আপনার কি মনে হয় ভারতের উচিত এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাহায্য করা? উত্তর : দেখুন, এটা বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব মামলা। আপনাদের সমস্যা আপনাদেরই মেটাতে হবে। আমি এ ব্যাপারে কিছু বলব না। কারণ এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার আপনাদেরই নিতে হবে। তাছাড়া আমি যোদ্ধা মানুষ, রাজনীতিবিদ না। সবশেষে বলি, মুক্তিযোদ্ধা ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অসাধারণ বীরত্বের সুবাদেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। সীমিত সামর্থ্য নিয়ে স্রেফ তুমুল দেশপ্রেম পুঁজি করেই একটা শক্তিশালী নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে জয় ছিনিয়ে এনেছে তারা। আমরা তাদের সাহায্য করেছি, আমরা তাদের সহযোদ্ধা। কিন্তু তাদের লড়াইটা তারা নিজেরাই লড়েছে। চেতনার পুরোটা ঢেলে দিয়েই তারা তাদের লক্ষ্য পূরণ করেছে। তাদের প্রতি আমার হৃদয়ভরা আশীর্বাদ এবং আপনাদের সঙ্গে আমিও তাদের শ্রদ্ধা জানাই। তারাই আপনাদের সত্যিকার রতœ যাদের নিয়ে এদেশ গর্ব করতে পারে।
×