স্টাফ রিপোর্টার ॥ ব্যাপক সমালোচনার পর এবার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে নারীদের জন্য অবমাননাকর প্রতীক রাখছে না ইসি। এর পরিবর্তে নতুন করে প্রতীক সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কমিশনের সভায় বিদ্যমান প্রতীক বাদ দিয়ে নারীদের জন্য ১০টি প্রতীকের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন এসব প্রতীকের মধ্যে রয়েছে কলম, ক্যামেরা, তালগাছ, জিরাফ, বই, বক, কলস, মাইক, হেলিকপ্টার ও সূর্যমুখী ফুল।
পৌরসভা নির্বাচনের পর এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসি। আগামী মার্চ থেকেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শুরু হবে। আইনানুযায়ী পৌরসভার মতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও হবে দলীয় ভিত্তিতে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীদের মধ্যে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, মঙ্গলবারের কমিশনের সভায় ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের জন্য নিবন্ধিত প্রতীক ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য ১০টি প্রতীকের তালিকা করা হয়েছে। এছাড়াও সংরক্ষিত সদস্য পদে ১০টি ও সাধারণ সদস্য পদে ১০টি সংরক্ষিত প্রতীকের তালিকা দেয়া হয়েছে।
গত পৌরসভা নির্বাচনে নারীদের জন্য অবমাননাকর প্রতীক ব্যবহার করায় সারাদেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বিভিন্ন মহল থেকে নারীর প্রতি ইসির দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হয়। তবে বিভিন্ন মহলের অসন্তোষ সত্ত্বেও পৌরনির্বাচনে ঘনিয়ে আসায় এবং আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে নারী প্রার্থীদের প্রতীক চুড়ি, পুতুল, ফ্রক টপরিবর্তন করতে পারেনি। ওই সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারীদের জন্য অবমাননাকর সব প্রতীক বাদ দেয়া হবে। তবে ইসির পক্ষ থেকে এও বলা হয় সংরক্ষিত নারী আসনের প্রার্থীদের প্রতীক অবমাননার জন্য করা হয়নি। এটা করা হয়েছে মূলত প্রার্থী চেনার জন্য। এর আগে এপ্রিলে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও নারী প্রতীক নিয়ে সমালোচনা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারীদের জন্য এসব অবমাননাকর প্রতীক বাদ দিয়ে নতুন করে ১০টি প্রতীকের প্রস্তাব ইসির করা হয়েছে।
ইসি সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নারী প্রার্থীরা অপমানিত বোধ করেন এমন প্রতীক রাখা হবে না। অসাবধানবশত এতদিন এ ধরনের প্রতীক রয়ে গেছে। ইসির আইন শাখার যুগ্মসচিব মোঃ শাহজাহান বলেন, ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত সদস্য পদের প্রার্থীদের জন্য নতুন প্রতীকের তালিকা হয়েছে। বিদ্যমান প্রতীকগুলোয় পরিবর্তন এনে আরও পর্যালোচনা করে নতুন প্রতীক দেয়া হবে। নারী প্রার্থীদের নতুন প্রতীকগুলো হচ্ছে কলম, ক্যামেরা, তালগাছ, জিরাফ, বই, বক, কলস, মাইক, হেলিকপ্টার ও সূর্যমুখী ফুল।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনের জন্য আলাদা প্রতীক সংরক্ষণ করে গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এতে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা পদের জন্য প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয় কড়াই, গলার হার, চিরুনি, জবা ফুল, নূপুর, পাউরুটি, পেন্সিল কাটার, বিড়াল, বেগুন ও স্কুল ব্যাগ। এছাড়া পৌরসভায় নারী প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে আঙ্গুর ফল, কাঁচি, গ্যাসের চুলা, চকোলেট, চুড়ি, পুতুল, ফ্রক ভ্যানিটি ব্যাগ, মৌমাছি ও হারমোনিয়াম। যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে প্রতীক বরাদ্দে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। ইসি জানিয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্য পদের প্রতীকে ক্ষেত্রেও এবার পরিবর্তন আনা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীদের ক্ষেত্রে নিবন্ধিত প্রতীক বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রতীকে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। পৌরসভার নির্বাচনের মতো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীর বাইরে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকছে এবারও। তবে পৌরসভার নির্বাচনের মতো স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোটারের সমর্থনযুক্ত কোন তালিকা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হচ্ছে না। এছাড়া সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত নারী সদস্য পদেও এবার পৌরসভার মতো নির্দলীয় নির্বাচন হবে।
ইসি জানিয়েছে, আইনানুযায়ী স্থানীয় নির্বাচন দলীয় হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও বিদ্যমান বিধিমালায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে কমিশনের বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে কমিশনের বৈঠকে ইউপি নির্বাচন বিধিমালা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। জানা গেছে বৈঠকে প্রস্তাবিত নির্বাচনী বিধিমালা ও আচরণ বিধিমালা নিয়ে কমিশন আলোচনা হয়েছে। ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে কয়েক দিনের মধ্যেই তা চূড়ান্ত করা হবে।
কমিশনের ওই বৈঠকে বিধিমালা সংশোধন ছাড়াও চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্য পদের প্রতীকেও পরিবর্তন করে নতুন প্রতীকের প্রস্তাব করা হয়েছে। চেয়ারম্যান পদে রাজনৈতিক দলের দলীয় ৪০টি প্রতীকের বাইরে স্বতন্ত্র পদের চেয়ারম্যান প্রার্থীদের জন্য অটোরিকশা, আনারস, ঘোড়া, টেবিল ফ্যান, ঢোল, টেলিফোন, ক্যালকুলেটর, দুটি পাতা, মোটরসাইকেল, রজনীগন্ধা ফুল এবং সাধারণ আসনের কাউন্সিলর প্রার্থীদের জন্য আপেল, ক্রিকেট ব্যাট, ঘুড়ি, টিউবওয়েল, পানির পাম্প, ফুটবল, ফুলের টব, ভ্যান গাড়ি, বৈদ্যুতিক পাখা, মোরগ, লাটিম ও তালা প্রতীকের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে জানা গেছে, চেয়ারম্যান পদে ক্যালকুলেটর ও সাধারণ সদস্য পদে ফুলের টব যুতসই নয় বলে মত দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ কমিশনার আব্দুল মোবারক। তিনি মত প্রকাশ করেন ক্যালকুলেটর পোস্টারে স্পষ্টভাবে প্রদর্শনযোগ্য নয় এবং ফুলের টব গ্রামের অনেক লোক কোনদিন দেখেনি। তিনি এ দুটি প্রতীক পরিবর্তে করার কথা বলেছেন।
ইসি জানিয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদের বিধিমালা চূড়ান্ত করার পর তা আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হবে। ভেটিং শেষে ইসির অনুমোদনের পর এ সংক্রান্ত বিধিমালার গেজেট করবে ইসি সচিবালয়। এর পরই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কয়েকধাপে অনুষ্ঠিত হবে। তবে কয় ধাপে হবে তা এখনও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তবে প্রথম ধাপে মার্চের শেষে দেশের প্রায় ৬শ’ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। জানা গেছে, প্রথম ধাপে উপকূলীয় জেলার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর পর মে মাস থেকে জুলাই পর্যন্ত বাকি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। তবে জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের আচরণ বিধি অনুযায়ী পৌর নির্বাচনের মতোই মন্ত্রী-এমপিসহ অধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। একই সঙ্গে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রচারে অংশ নিতে পারছেন না।
কমিশনের হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা রয়েছে চার হাজার ৫৭১টি। সর্বশেষ ২০১১ সালে এটিএম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচন করে। ওই বছরের কয়েকধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন করে হুদা কমিশন। এর মধ্যে ২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল উপকূলীয় ২৪ উপজেলার প্রায় ৬শ’ ইউনিয়ন পরিষদে এবং ৩১ মে থেকে ৫ জুলাই দেশের বাকি ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণ করা হয়। কমিশন জানিয়েছে পরিষদের মেয়াদের মধ্য থেকে নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। শুরুতে উপযুক্ত এলাকাগুলোর ভোট করা হতে পারে। পর্যায়ক্রমে এ নির্বাচন জুন-জুলাই পর্যন্ত চলবে।
স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইনানুযায়ী, নির্বাচন পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে (মেয়াদ শেষের আগের ১৮০ দিন) নির্বাচন করতে হবে। আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর। নির্বাচনের পর পরিষদের প্রথমসভা থেকে পরবর্তী ৫ বছরের মেয়াদ গণনা হয়ে থাকে। কমিশন জানিয়েছে, যেহেতু আইনানুযায়ী মেয়াদ শেষের আগেই এসব নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে তাই প্রাথমিক প্রস্তুতি এখনই শুরু করতে হবে। কমপক্ষে ৪০ থেকে ৪৫ দিন হাতে রেখে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।