ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন স্বপ্নে জেগে উঠুক যশোরের ফুটবল

প্রকাশিত: ০৬:৪০, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

নতুন স্বপ্নে জেগে উঠুক  যশোরের ফুটবল

যশোরের ক্রীড়ামোদীরা যা কখনই কল্পনা করেনি এবার তার চেয়েও তারা বেশি পেয়েছে বললে ভুল হবে না। প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী আসর বসে যশোরের শামস-উল-হুদা স্টেডিয়ামে। ৮ জানুয়ারি উদ্বোধনী ম্যাচে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা। স্বভাবতই বৃহত্তর যশোর এবং আশপাশের হাজার হাজার ক্রীড়ামোদীর উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে উঠেছিল গোটা যশোর। দর্শকদের অনুপ্রেরণায় উদ্বোধনী ম্যাচে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ৪-২ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে। এরপর আরও দুটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় যশোরের মাটিতেই। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন মালয়েশিয়া, রানার্সআপ বাংলাদেশ, নেপাল, বাহরাইন, মালদ্বীপ, কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং অনূর্ধ্ব-২৩ বাংলাদেশ ফুটবল দল এই টুর্নামেন্টে খেলছে। সবগুলো দলেরই পা পড়ে যশোরের মাটিতে। ১৭৮১ সালে যে যশোর জেলা শহরের সূচনা সেই শহরে এর আগে কোনদিনই এ রকম কোন ক্রীড়া আসরের আয়োজন হয়নি। স্বভাবতই বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টকে ঘিরে যশোরের ক্রীড়ামোদীদের মাঝে ছিল এক নতুন প্রাণের উচ্ছ্বাস। টুর্নামেন্ট উপলক্ষে যশোর সেজেছিল এক নতুন সাজে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে সারা শহরের রাস্তাঘাট পোস্টার-ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছিল। দেশী-বিদেশী খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা, রেফারি এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়ে আবাসিক হোটেলগুলোতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। হাজার হাজার ফুটবল দর্শক এসেছিল চারপাশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, খুলনা, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকেও। এক সময় বৃহত্তর যশোরে ফুটবলের ঢের জনপ্রিয়তা এবং জোয়ার দুই-ই ছিল। ফুটবলের নাম শুনলেই যশোরের প্রতিটি থানা-গ্রামেই ফুটবলমোদীদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা যেত। যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং নড়াইলের এমন কোন জায়গা ছিল না যেখানে ফুটবল খেলা হতো না। বাদ পড়ত না ধানক্ষেত, পাটক্ষেত পর্যন্ত। স্বল্প পরিসরের জায়গা পেলে সেখানেও জমে উঠত ফুটবল আর ফুটবল। যশোরে ফুটবল দেখার জন্য দর্শকরা নাওয়া-খাওয়া পর্যন্ত ভুলে যেত। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফুটবল দেখার অপেক্ষায় থাকত সবাই। শুধু জেলা বা মহকুমা সদর নয়, এ চিত্র ছিল গ্রামগঞ্জেও। অনেক গ্রামে ফুটবল এতটাই জমে উঠত যে, সেখানে উৎসব চলত। অনেক জায়গাতেই প্রচলিত আট, ষোলো বা চব্বিশ টিমের খেলা। স্থানীয় ক্লাব বা গ্রামের দলগুলো নিয়ে এই খেলা চলত। আর আকর্ষণীয় টুর্নামেন্টের আয়োজন হলে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নামকরা সব ক্লাবকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হতো। যশোর জেলায় নিয়মিত লীগ হওয়ার পাশাপাশি মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং নড়াইল মহকুমা সদরেও নিয়মিত লীগ ও বিভিন্ন টুর্নামেন্টের খেলা হতো। শুধু এই নয়, জেলা ও মহকুমা সদরের বাইরে বিভিন্ন থানার বিভিন্ন গ্রামে আয়োজিত হতো মন মাতানো সব ফুটবল টুর্নামেন্ট। যশোরের পৌরসভা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট, মাগুরার কাদের চ্যালেঞ্জ শিল্ড টুর্নামেন্টসহ বিবিধ টুর্নামেন্টের আয়োজন হতো। যেসব টুর্নামেন্টে শুধু বৃহত্তর যশোরের বিভিন্ন ফুটবল দলই নয়, খুলনার আবাহনী ক্রীড়া চক্র, কসমস ক্লাব, শিপইয়ার্ড ক্লাব, মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব, মেহেরপুরের উল্কা ক্লাব, কুষ্টিয়ার মোহিনী মিল ক্লাব, চালনা বন্দর ক্লাব, ফরিদপুর আবাহনী ক্রীড়া চক্রসহ বিভিন্ন ক্লাব অংশগ্রহণ করত। এদিকে জাতীয় পর্যায়ের যে কোন খেলায় যশোর জেলা ফুটবল দলের ছিল অন্যরকম দাপট। বিশেষ করে সত্তর ও আশির দশকে শেরেবাংলা কাপ টুর্নামেন্টসহ বিভিন্ন জাতীয় ফুটবল প্রতিযোগিতায় যশোরের অংশগ্রহণ ও সাফল্য অন্যরকম মর্যাদা বহন করত। অনেকের নিশ্চয়ই মনে আছে ’৭৬ সালে চট্টগ্রামের মাঠে অনুষ্ঠিত শেরেবাংলা কাপ জাতীয় ফুটবলেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল যশোর জেলা ফুটবল দল। সেবার তারা কুমিল্লাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ষাট-সত্তর দশকে যশোরের অনেক তরুণই ছিল ঢাকার মাঠের জনপ্রিয় খেলোয়াড়। হাকিম, লুৎফর, শফিকুজ্জান, খবির, সোহরাব, আলমগীর সিদ্দিকী, গোলকিপার শফি এখনও যশোরবাসীর কাছে ফুটবলের কিংবদন্তি হয়ে আছেন। পরবর্তী ধারায় বিজেএমসিতে খেলা লোভন, রকিব, জিল্লুর, কাওসার, সাথী বৃহত্তর যশোরবাসীর কাছে এখনও মোহনীয় ফুটবলার হিসেবে খ্যাত। এছাড়াও বৃহত্তর যশোরের ফিরোজ, মোস্তফা, আনোয়ার, ইস্রাফিল, রতন, আজাদসহ অনেকেই আলোকিত করেন ঢাকার মাঠ। বৃহত্তর যশোরবাসীর কাছে ফুটবলের আরও যারা খ্যাত হয়ে আছেন তাঁরা হলেনÑ বশিরুল ইসলাম কচি (বেসপাড়া), মোহন ( মাগুরা), মকবুল (মাগুরা), আছাব (মাগুরা), আফাঙ্গীর (ঝিনেদা) মধু (ঝিনেদা), অসিত (বেসপাড়া), মিঠু (ঝিনেদা) জামি, বেলাল, জাহিদ, হারানসহ আরও অনেকে। নব্বই দশক পরবর্তীতে বৃহত্তর যশোরের কাজী জামাল, সোহান, মকবুল, উজ্জ্বল, লাজুকসহ আরও অনেকেই জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। কিন্তু যশোরের ফুটবলের রং ফিকে হয়ে গেছে অনেক আগেই। বৃহত্তর যশোরে এখন আর ফুটবল বলে কিছু নেই। জাতীয় পর্যায়ে ফুটবলের যে মরণদশা সেই বৃত্ত থেকে যশোরও বের হতে পারেনি। তরুণ প্রজন্মের কাছে ফুটবল যেন অচ্ছুত। মাঠগুলো তাই খা খা পড়ে থাকে। নিয়মিত খেলা হয় না। কোথাও কোথাও নামকাওয়াস্তে দু-একটা টুর্নামেন্ট হলেও তার ধারাবাহিকতা নেই। কোথাও ভাল কোচ নেই। যারা ফুটবলার তৈরি করবেন তারাও যেন কোথায় হারিয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গেই বলছিলেন সত্তর দশকের বৃহত্তর যশোর জেলা দলের নন্দিত ফুটবলার সৈয়দ নাজমুল হাসান লোভন। তাঁর মতে, ফুটবলে যশোরের যে জৌলুশ ছিল তার এখন কিছুই নেই। বিবিধ কারণেই সেটি হয়েছে। তবে যশোরের মাটিতে বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টকে তিনি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন। তাঁর ভাষায়, এই টুর্নামেন্টই হোক যশোরের ফুটবলারদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। যশোরের আরেক নন্দিত ফুটবলার সৈয়দ মাশুক মুহাম্মদ সাথী, বৃহত্তর যশোরের ফুটবল মাঠে যার ঝাঁকড়া চুল দোল খেত। বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক ফুটবলের আয়োজন যশোর হওয়াতে ভীষণ খুশি তিনি। কিন্তু যশোরের ফুটবল জৌলুশ কি ফিরেয়ে আনা সম্ভব হবে- এমন প্রশ্নে সাথী বলেন, যশোরের ফুটবলকে উজ্জীবিত করতে হলে নিয়মিত লীগসহ স্কুল-কলেজে টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে হবে। মিল, কলকারখানার ফুটবল দলগুলোকে আবার তৈরি করতে হবে। খেলোয়াড়দের জন্য ভাল পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করতে হবে। ভাল কোচ তৈরি করতে হবে। তারও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এভাবেই একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা তৈরি এবং তা বাস্তবায়ন করা হলে ফুটবলের সেই পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সাথী আরও বলেন, একটি আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজনের মধ্য দিয়ে যশোরের যে যাত্রা শুরু হলো এটি অবশ্যই ধরে রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু কাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী আসরের আয়োজনের মধ্য দিয়ে যশোর অবশ্যই আমাদের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম অংশ হয়ে উঠল। তবে আগামীতে এ ধরনের আয়োজনকে আরও সার্থক করতে হলে যশোরের স্টেডিয়ামকে অবশ্যই আধুনিক করতে হবে। এবারের আয়োজনের মধ্য দিয়ে সৃজনশীল ক্রীড়া সংগঠক কাজী নাবিল আহমেদ এমপি যশোরবাসীর প্রতি যে ভালবাসা ও দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন তা অসামান্য। এ রকম একটি আয়োজন অবশ্যই বৃহত্তর যশোরের ক্রীড়ামোদী এবং তরুণ প্রজন্মকে নতুন স্বপ্নে বিভোর করবে। সেই স্বপ্ন ধরেই জেগে উঠুক ঐতিহ্য হারানো যশোরের ফুটবল।
×