ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিমন্ত্রী তারানা সিঙ্গাপুর গেছেন

সাইবার অপরাধ রোধে ফেসবুক সার্ভার বসানোর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬

সাইবার অপরাধ রোধে  ফেসবুক সার্ভার বসানোর উদ্যোগ

ফিরোজ মান্না ॥ সরকারের চিঠির প্রেক্ষিতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। আপত্তিকর কনটেন্ট ফিল্টারিংয়ের জন্য বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে একজন অনুবাদক নিয়োগ দিয়েছে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এখন ফেসবুকের সার্ভার বসানোর বিষয় নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম ফেসবুকের এ্যাডমিন অফিস ও অন্যান্য কার্যক্রমের ওপর আলোচনা করতে গত সোমবার রাতে সিঙ্গাপুর গেছেন। সেখানে ফেসবুক ছাড়াও গুগল ও মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আলোচনার কথা রয়েছে তার। সিঙ্গাপুর থেকে তিনি মালয়েশিয়াও যাবেন। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী ২৩ জানুয়ারি তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এই সিদ্ধান্তের ফলে ফেসবুকে বাংলা ভাষায় পোস্ট করা আপত্তিকর স্ট্যাটাস ও মন্তব্য ইংরেজীতে অনুবাদ করে ফিল্টারিং করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আপত্তিকর কনটেন্ট ব্যবহারকারীর তথ্য ও আইডি বন্ধে আবেদন করেও ভাষাগত কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে সম্প্রতি বাংলা ভাষার দু’টি অভিযোগ ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। পরে ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তারা একজন অনুবাদক নিয়োগ দিয়েছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বিটিআরসি থেকে ইতোমধ্যে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই ফোকাল পয়েন্টের ওপর প্রতিমন্ত্রী আলোচনা করবেন বলে জানানো হয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বুধবার ফেসবুক, গুগল ও মাইক্রোসফট কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আলোচনায় বসবেন। আলোচনায় বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার ওপর জোর দেয়া হবে। ফেসবুকের সার্ভার কোথায় স্থাপন করা হবে সে বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসবে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ থ্যাইল্যান্ডে ফেসবুকের সার্ভার রয়েছে। আর কোন দেশে সার্ভার না থাকায় আপত্তিকর কনটেন্টগুলো কোন প্রকার ফিল্টার হয় না। ফলে সমাজে বড় ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়। এটা যাতে না হয় তার জন্য চেষ্টা করা হবে বাংলাদেশে ফেসবুকের সার্ভার স্থাপনে। যদি এটা সম্ভব নাও হয়, তাহলেও ফেসবুক নিরাপদ করার জন্য যা কিছু করণীয় আছে সেই আলোচনাও করবেন তিনি। একই সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী গুগল ও মাইক্রোসফটের সঙ্গেও নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। সিঙ্গাপুরে তিন দিনের সফর শেষে প্রতিমন্ত্রী মালয়েশিয়া যাবেন। তিনি দেশটির আইসিটি মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরপর তিনি আজিয়াটা কোম্পানি পরিদর্শন ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন। মালয়েশিয়া থেকে তিনি আগামী ২৩ জানুয়ারি দেশে ফিরবেন। জানা গেছে, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গত বছরের ১৮ নবেম্বর সরকার ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস এ্যাপসহ ১২টি এ্যাপস বন্ধ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ ২২ দিন এ সব সেবা বন্ধ ছিল। ২২ দিন পর এসব এ্যাপস আবার খুলে দেয়া হয়। গত ৬ ডিসেম্বর ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দুই কর্মকর্তা ঢাকায় তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেও ফেসবুক কর্মকর্তারা তখন কোন মন্তব্য করেননি। সেই সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও ফেসবুকের দুই কর্মকর্তার বৈঠক হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন সাংবাদিকদের কাছে বলেন, আমরা আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরেছি। তারা বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন। ঢাকায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দুই কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, এখন চূড়ান্তভাবে কিছু না হলেও জানুয়ারিতে ফেসবুকের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি হবে। চুক্তি হলেই অনেক সমস্যার সমাধান হবে। তখন আমাদের সাইবার নিরাপত্তা অনেক জোরদার করা সম্ভব হবে। ফেসবুক বন্ধ থাকায় দেশের অনলাইন ভিত্তিক ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ সময় ধরে চরম সংকটে দিন কাটাতে হয়েছে। শুধু ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই যে প্রভাব পড়েছে তা নয়, এর প্রভাব তরুণ সমাজে আরও প্রকট আকারে পড়েছিল। সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যম দিয়ে দেশ-বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজন-বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেও পারছিল না। দীর্ঘ সময় ফেসবুক বন্ধ থাকায় সরকারের প্রতি একটা বিশাল জনগোষ্ঠী বিরূপ হয়ে পড়ে। দেশে ফেসবুক বন্ধ হওয়ার পর থেকে ফ্রিল্যান্সিং ও ই-কমার্স ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমেছিল। মোবাইল ফোন অপারেটরদের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, প্রতিদিন তাদের সাড়ে ৪শ’ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ ব্যবহার হতো। ফেসবুক বন্ধের পর ব্যান্ডউইথের ব্যবহার ৩শ’ টেরাবাইটের নিচে নেমে এসেছিল। গ্রামীণফোনের হেড অব কর্পোরেট এ্যাফেয়ার্স মাহমুদ হোসাইন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা বেশিরভাগ সময় ফেসবুক ব্যবহার করেন। এটি একটি খুবই জনপ্রিয় এ্যাপস। এটি বন্ধ থাকার ফলে ব্যান্ডউইথের ব্যবহার অনেক কমে যায়। বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস (বেসিস)-এর সাবেক সভাপতি তথ্য প্রযুক্তিবিদ হাবিবুল্লাহ এন করিম বলেন, সামাজিক যোগাযোগসহ অন্যান্য কোন সাইট বন্ধ করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। এই সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রযুক্তি দিয়ে প্রযুক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। অন্য কোন উপায়ে কোন প্রযুক্তি বন্ধ করে রাখা যায় না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে নারীর প্রতি হয়রানি, ধর্মীয় উস্কানি, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো ঠেকাতে সরকার বেশ আগে থেকেই উদ্যোগ নিয়েছে। এবার ফেসবুকের সঙ্গে আলোচনার পর একটা জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। এর আগে দেশ থেকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নানা অভিযোগ দায়ের করেও কোন ফল পাওয়া যায়নি। তারা সাফ জবাব দিয়েছে তারা শুধু আমেরিকার পেজগুলোই মনিটর করে। অন্য দেশের এ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের কোন পোস্ট মনিটর করে না। অনেক আপত্তিকর বিষয় নিয়ে এর আগে বিটিআরসি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেছে। কিন্ত কোন অভিযোগ তারা আমলে নেয়নি। দু’একটা অভিযোগ আমলে নিলেও সেগুলোর জন্য তারা আদালতে মামলা করেছে কিনা, আবার মামলা হলেও মামলায় দোষী প্রমাণিত হয়েছে কিনা এমন সব কাগজপত্র চেয়ে বসেছে। সব কাগজ দিলেই যে ওই ব্যক্তির এ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা কনটেন্ট মুছে দেবে-তাও তারা দিতে বাধ্য না বলে জানিয়ে দেয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে চুক্তি হলে তখন আর এমন কথা ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন না। তারা বাধ্য সাইবার নিরাপত্তা দিতে। সামাজিক নিরাপত্তা, নারীর সম্মান রক্ষা, সাইবার অপরাধ মুক্ত করার জন্যই প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের এই সফর।
×