ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বার ও নির্বাহী বিভাগ নিয়ে সিনহার বক্তব্যে উদ্বিগ্ন আইন অঙ্গন

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১২ জানুয়ারি ২০১৬

বার ও নির্বাহী বিভাগ নিয়ে সিনহার বক্তব্যে উদ্বিগ্ন আইন অঙ্গন

আরাফাত মুন্না ॥ ‘নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা নিয়ে নিতে চাচ্ছে’ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার এমন বক্তব্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের প্রখ্যাত আইনজ্ঞরা। তারা বলেন, যেখানে বর্তমান সরকার বিচার বিভাগকে আরও অনেক বেশি শক্তিশালী করতে কাজ করছে, ওই সময় প্রধান বিচারপতির এ ধরনের বক্তব্য অনভিপ্রেত। বার কাউন্সিল নিয়ে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের বিষয়ে আইনজ্ঞরা বলেন, বার কাউন্সিলের বর্তমান নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেশের সকল আইনজীবীকে প্রধান বিচারপতি হেয় করেছেন। এর আগে রবিবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা অভিযোগ করেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে। এ চেষ্টা রুখতে আইনজীবীসহ বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি তিনি আহ্বানও জানান। অনুষ্ঠানে আইনজীবীদের ‘অন্যায় আবদারের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় তিনি বার কাউন্সিলের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছে জানতে চাই, বার কাউন্সিল কি শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের মতো ভোট চাওয়ার জন্য? ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক স্পীকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ একাধিক বিএনপিপন্থী আইনজীবী নেতা উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলমের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি জনকণ্ঠকে জানান, এ বিষয়ে তাঁর কোন বক্তব্য নেই।বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল বাসেত মজুমদার বলেন, বার কাউন্সিলের বর্তমান নেতৃত্ব কোনভাবেই রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে না। বার কাউন্সিলের নেতৃত্বকে দুর্বল এবং পেশাগত দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয় এমন মন্তব্য অনভিপ্রেত। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতি অভিযোগ করেছেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা নিয়ে নিতে চাচ্ছে। তবে আমিতো এমন কিছুই দেখছি না। সরকার প্রধান বিচারপতিকে এড়িয়ে কোন বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন এমন ঘটনাওতো ঘটেনি। ফলে আইনজীবীদের নিয়ে বিশেষ কোন আন্দোলন বা সমাবেশ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তিনি বলেন, বার কাউন্সিলের বর্তমান নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে আইনজীবীদের নির্বাচিত নেতৃত্বকে হেয় করার অর্থ দেশের সকল আইনজীবীকেই অপমান করা। এ বিষয়ে আইনজীবীরা প্রতিবাদ জানাবে। তিনি বলেন, আইনজীবীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি নষ্ট করে অন্য কাউকে দিয়ে আইনজীবী সমাবেশ আহ্বান অনাকাক্সিক্ষত এবং অনৈতিক বলে মনে করেন বার কাউন্সিলের এ ভাইস চেয়ারম্যান। এ বিষয়ে আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, প্রধান বিচারপতি এ বক্তব্য দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আইনজীবীদের উস্কে দিতে চেষ্টা করছেন, এতে তাঁর কি উদ্দেশ্য রয়েছে তা আমার জানা নেই। তাঁর এ ধরনের বক্তব্য দেশ ও গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ। তিনি বলেন, উনি (প্রধান বিচারপতি) আইনজীবীদের রুখে দাঁড়াতে বলেছেন। তার এ ধরনের বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। বিচারপতি মানিক বলেন, ওনার (প্রধান বিচারপতি) নিশ্চই কোন এজেন্ডা রয়েছে, তবে সেটা কি তা বোঝা মুশকিল। ওই দিন (রবিবার) তার সঙ্গে যেসব আইনজীবীরা ছিলেন, যাদের নিমন্ত্রণে তিনি ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তারা সবাই বর্তমান সরকারের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত। বিচারপতি মানিক আরও বলেন, একজন প্রধান বিচারপতি রাজনৈতিক বক্তৃতা দিতে পারেন না। তার এ বক্তব্য এবং সাম্প্রতিক সময়ে দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য পুরোপুরি রাজনৈতিক। প্রধান বিচারপতির এ বক্তব্য বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। প্রধান বিচারপতি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বলে মনে করেন এ বিচারপতি। সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। এটা নিয়ে বলার কিছু নেই। প্রধান বিচারপতি কেন মনে করছেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছেÑ সেটি বললে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যেত। বিষয়টি না জেনে ডিফেন্ড করতে চাই না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ওকালতি করি, রাজনীতি করি না।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে প্রধান বিচারপতির এ ধরনের বক্তব্য সঠিক নয় বলে আমি মনে করি। নির্বাহী বিভাগ এমন কোন কাজ করেছে বলে আমার জানা নেই বরং বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করতে নির্বাহী বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে বলেই আমি মনে করি। যদি কোন কারণে এ ধরনের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি বৃদ্ধি হয় তাহলে তার প্রভাব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ওপরও পড়তে পারে। উল্লেখ্য, রবিবার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এখন নির্বাহী বিভাগ আমাদের কাছ থেকে সব ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে।’ এ চেষ্টা রুখতে আইনজীবীসহ বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অতীতে আমরা দেখেছি, যখনই এ ধরনের কিছু হয়েছে, আইনজীবীরা সোচ্চার হয়েছেন। এখন যদি বিচার বিভাগের প্রতি নির্বাহী বিভাগ, আইনজীবী মহল, বিচারপ্রার্থী প্রত্যেকের আঘাত আসে, তাহলে বিচার বিভাগকে রক্ষা করবে কে?’ সামান্য অজুহাতে জেলা পর্যায়ে আইনজীবীদের আদালত বর্জনের সমালোচনা করেন প্রধান বিচারপতি। আইনজীবীদের অন্যায় আবদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় তিনি বার কাউন্সিলের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছে জানতে চাই, বার কাউন্সিল কি শুধু রাজনৈতিক সংগঠনের মতো ভোট চাওয়ার জন্য?’ আইনজীবীদের আদালত বর্জনে বার কাউন্সিলের নীরবতার উদাহরণ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল বাসেত মজুমদারকে নিয়ে সুনামগঞ্জে গিয়েছিলাম একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সেখানে তাকে বললাম, সুনামগঞ্জের একজন নারী বিচারকের কোর্ট আইনজীবীরা বয়কট করছেন। কারণ, উনি আইনজীবীদের বলেছেন, পুরনো মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য। মামলায় নিষ্পত্তির তাগিদ দেয়ায় বিচারক অপসারণের দাবির কড়া সমালোচনা করে এস কে সিনহা বলেন, ‘বিচারককে প্রত্যাহার করতে বললেন; কিন্তু আপনারা আইনজীবীদের কিছু বলতে পারলেন না। এটা কী ভোটের জন্য?’
×