ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আনন্দ কুমার সাহা

নব্য মোশতাকদের থেকে সাবধান!

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১২ জানুয়ারি ২০১৬

নব্য মোশতাকদের থেকে সাবধান!

এবারের মহান বিজয় দিবস ছিল- অন্য বছরের তুলনায় ভিন্নধর্মী। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার পর এবারের মহান বিজয় দিবসের তাৎপর্য ছিল অন্যরকম। বিজয় দিবসের একদিন পূর্বে অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫ মঙ্গলবার জাতীয় বেতন স্কেল গেজেট প্রকাশিত হলো। সরকারপ্রধান দেশরতœ শেখ হাসিনা এমন একটি বেতন স্কেল উপহার দিলেন, যা নিঃসন্দেহে আর্থিক দিক দিয়ে ভীষণ উঁচুমানের কিন্তু পরিতাপের বিষয় শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং কৃষিবিদ কেউ খুশি হতে পারেননি, কারণ মর্যাদার প্রশ্নে। সপ্তম বেতন স্কেলে যে মর্যাদাটুকু ছিলÑ এবারে সে মর্যাদা ম্লান হয়েছে। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘জাতীয় অধ্যাপক’দের মর্যাদা এভাবে ভূলুণ্ঠিত করা হলো কেন? জাতীয় অধ্যাপকদের সিনিয়র সচিবদের মর্যাদায় এনে এই বরেণ্য ব্যক্তিদের যেমন ছোট করা হয়েছে, অন্যদিকে তাঁদের পে-রুলে আনার এই প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে জাতীয় বেতন কাঠামোকে করা হয়েছে বিতর্কিত। জাতীয় অধ্যাপকদের বিশ্ববিদ্যালয় মনোনয়ন দেয় না, বা তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানের সঙ্গে জড়িত নন। বাংলাদেশে বর্তমানে ৫ জন জাতীয় অধ্যাপক আছেনÑ তাঁরা দেশবরেণ্য ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় এমিরিটাস প্রফেসর আনিসুজ্জামান স্যার ভারত রতœ উপাধিতে ভূষিত হলেন। এ রকম সম্মান খুব কম ব্যক্তিই পেয়ে থাকেন। আর এই সম্মানিত ব্যক্তিদের সচিব পর্যায়ে এনে কি সম্মান রক্ষা করা হলো? সরকারের এত সাফল্য অথচ গুটিকয়েক খন্দকার মোশতাকদের কারণে সেই প্রশংসা ঘরে তুলতে পারছে না। কোথায় যেন বিশ্বব্যাংকের থাবা দেখা যাচ্ছে। যেমন, পদ্মা সেতু যাতে না হতে পারে সে কারণে বিশ্বব্যাংক আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলÑ কিন্তু দেশরতœ শেখ হাসিনার কারণে ব্যর্থতা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এই মোশতাক বাহিনী থেমে নেই। সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছে। উত্তরা ষড়যন্ত্রের নায়ক অর্থ মন্ত্রণালয়ে, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কুখ্যাত রাজাকারের সন্তান, শুধু তাই নয় প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ সচিব যার বাবা ছিলেন কুখ্যাত রাজাকারÑ তারাই কি দেশ চালাচ্ছে? অনেকে কবি হয়েছেন, সাহিত্যিক হয়েছেন, সরকারের অর্থ ব্যয়ে পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েছেন এবং সরকারের উচ্চপর্যায়ে অধিষ্ঠিত আছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে যারা রাজাকার, আলবদর, আলশাম্স, পিস কমিটির লোক ছিলেনÑ তাদের সন্তানরা নিজ এলাকায় লেখাপড়া না করে অন্যত্র লেখাপড়া করেছে এবং অনেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু পিতার রক্তের প্রবাহ সন্তানের মধ্যে রয়েছে। মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম ভেতরে আলবদরের রক্ত। এদের কাছে কি আশা করা যায়? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনুগ্রহপূর্বক এই ষড়যন্ত্রকারীদের থেকে সাবধানে থাকবেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কি অন্যায় করেছেন? সপ্তম বেতন কাঠামোতে যে বেতন পেতেন তার থেকে নিচে নামানোর কারণ কি? আবার অন্য পেশায় যারা নিয়োজিত তাদের সুপার গ্রেড দেয়ার প্রয়োজন কি? ইচ্ছা করলে তাদেরও টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী বানাতে পারতেন। যারা প্রতিনিয়ত রং পাল্টায় তাদের কদর অনেক বেশি। যারা রং পাল্টাতে পারেনÑ ভিড় ঠেলে যারা সামনে যেতে পারেন তাদের শক্তি বেশি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা দিয়েছিলেন। ৬ ডিসেম্বর আপনার বাসভবনে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি এবং মহাসচিব দেখা করেন। বর্তমান ফেডারেশনের সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পর পর ৪ বার নির্বাচিত এবং ফেডারেশনের মহাসচিব তিনি পর পর তিনবার নির্বাচিত। তাঁরা মর্যাদার দিক থেকে অনেক ওপরে। আপনি সুস্পষ্ট আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ১. অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য সপ্তম জাতীয় বেতন কাঠামোর অনুরূপ সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল থাকবে, ২. অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে সিনিয়র সচিবদের জন্য যে সুপার গ্রেড সৃষ্টি করা হয়েছে, এই সুপার গ্রেডে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের মধ্য থেকে একটি অংশকে উন্নীত করা হবে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের দাবি ছিল শতকরা ২৫ ভাগ। শতকরা ১৫ ভাগ পেলেও ফেডারেশন গ্রহণ করত। কিন্তু দুঃখের বিষয় ৬ ডিসেম্বর শিক্ষক প্রতিনিধিদের আশ্বাস দিলেন এবং তার উল্টো কাজটা করেছেন ১৯ নবেম্বর। এটা কি প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সরকারবিরোধীদের প্রভাবে হলো? ভাবা দরকার। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির জনকসহ তাঁর পরিবারের অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকা- ঘটনার পূর্বে বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়েছিল। বাসন্তী নামক বোবা মেয়েকে জাল পরিয়ে সারাবিশ্বে ছবি প্রচার করেছিল। যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে শক্ত করতে চায়Ñ তাদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সঙ্গে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করার কাজে লিপ্ত বিশ্বব্যাংকের নেতারা। নব্য খন্দকার মোশতাকদের থেকে অনেক দূরে থাকতে হবে। বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় প্রথম শহীদ বৃদ্ধিজীবী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শহীদ ড. শামছুজ্জোহা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজশাহী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেফতার করে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী আপনাকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ একদিনের প্রতিবাদী ছুটি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সেই শিক্ষকদের সম্মানহানির চেষ্টা চলছে। এটা সুকৌশলে দেশরতœ শেখ হাসিনার সঙ্গে একটি ফাঁক সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে একটি গোষ্ঠী। এদের থেকে আমাদের সচেতন এবং সাবধান থাকতে হবে। লেখক : সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি
×