ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নীতিমালা নিয়ে চিন্তা

চেক জালিয়াতি থামছে না, অনেক অভিযোগ আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১২ জানুয়ারি ২০১৬

চেক জালিয়াতি থামছে না, অনেক অভিযোগ আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে

রহিম শেখ ॥ কোনভাবেই থামছে না চেক জালিয়াতি। জালিয়াতি ঠেকাতে ম্যাগনেটিক ইঙ্ক ক্যারেকটার রিকগনিশন (এমআইসিআর) চেক চালু করেও রেহাই মিলছে না। নিখুঁতভাবে নকল চেক তৈরি করে ব্যাংক থেকে গ্রাহকের কষ্টের জমানো টাকা তুলে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ চক্র। এ সংক্রান্ত প্রচুর অভিযোগ আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতাও মিলছে। জাল চেক দিয়ে টাকা উত্তোলনের পর কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া অর্থ ভুক্তভোগী গ্রাহকের এ্যাকাউন্টে জমা করা হচ্ছে। তবে বড় জালিয়াতির ঘটনাগুলোর সুরাহা করতে পারছে না কোন ব্যাংকই। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন চেক জালিয়াতি প্রতিরোধে নীতিমালা করা যায় কিনা তা ভাবছে। সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে চেক জালিয়াতির ঘটনা বেড়ে গেছে। প্রতিমাসে ২০-২৫টি চেক জালিয়াতিসংক্রান্ত অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে (সিআইপিসি) জমা পড়েছে। গত অর্থবছরে চেকসংক্রান্ত অভিযোগ ছিল ১৭৫টি। এর আগের বছর ২০৯টি। যা অধিকাংশই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চেক জালিয়াতির মধ্যে সর্বাধিকসংখ্যক ঘটনা ঘটেছে বেসরকারী খাতের সিটি ব্যাংকে। এরপরে রয়েছে ব্র্যাক ও আইএফআইসি ব্যাংক। এ ছাড়া ডাচ্-বাংলা, পূবালী, এবি, ইস্টার্ন, জনতা, সোনালী ব্যাংকেও একাধিক চেক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে বেসরকারী তিনটি ও সরকারী একটি প্রতিষ্ঠান চেক প্রস্তুত করে থাকে। এগুলো হচ্ছে নেট ওয়ার্ল্ড, জাপান বাংলাদেশ প্রিন্টিং কর্পোরেশন, সেকুরা প্রিন্টিং ও বাংলাদেশ সিকিউরিটি এ্যান্ড প্রিন্টিং কর্পোরেশন। জালিয়াতির সঙ্গে চেক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশ আছে কি-না তা খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি চেক জালিয়াতিসংক্রান্ত বেশকিছু অভিযোগ তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেছে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকের কর্মকর্তার যোগসাজশে জালিয়াতি হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। এ ঘটনায় অনেক কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক চাকরিচ্যুত করেছে। এ ধরনের ঘটনা ব্যাংক খাতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হওয়ায় এখন কোন নীতিমালা করা যায় কিনা সে বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে (সিআইপিসি) আসা অভিযোগ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ব্র্যাক ব্যাংকের ভুয়া চেকে ১৮টি ক্লিয়ারিং হাউসের লেনদেনে ৩ কোটি ১৬ লাখ ৬৫ হাজার ২৫০ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকে ক্লিয়ারিংয়ে একটি ভুয়া চেকে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার ৫৭০ টাকা এবং ব্যাংকের অভ্যন্তরে ১৬টি ঘটনায় ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এছাড়া বিদেশী খাতের এইচএসবিসি ব্যাংকে ক্লিয়ারিংয়ের ১৪টি লেনদেনে ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকা এবং সরাসরি ব্যাংক থেকে ৪টি ঘটনায় ১৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে আরও দেখা যায়, পূবালী ব্যাংকের ১৩টি ঘটনায় প্রায় ৩০ লাখ, এবি ব্যাংকে ১১টি ঘটনায় প্রায় ৪৮ লাখ, সোনালী ব্যাংকে ৫টি ঘটনায় ১০ লাখ ৫২ হাজার, জনতা ব্যাংকে ৭টি ঘটনায় ৮৬ লাখ ৫৯ হাজার, অগ্রণী ব্যাংকে ৩টি ঘটনায় ১ লাখ ৩২ হাজার, ইস্টার্ন ব্যাংকে ৫টি ঘটনায় ১১ লাখ ৪৪ হাজার, ঢাকা ব্যাংকে ৯টি ঘটনায় প্রায় ১ কোটি ৩৬ লাখ, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে ১২টি ঘটনায় ১ লাখ ২২ হাজার, মার্কেন্টাইল ব্যাংকে দুটি ঘটনায় ৮৩ লাখ ৩০ হাজার, ওয়ান ব্যাংকে দুই ঘটনায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে তিন ঘটনায় ৩ লাখ ৫৩ হাজার, নতুন অনুমোদিত মধুমতি ব্যাংকে দুই ঘটনায় ১ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা জাল চেকের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, ব্যাংক ব্যবস্থার নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রাহকের চেক ইস্যুতে ম্যাগনেটিক ইঙ্ক ক্যারেক্টার রিকগনিশন (এমআইসিআর) বাধ্যতামূলক করা হয়। ব্যাংক গ্রাহককে নির্দিষ্ট সংখ্যক পাতার চেক বই হস্তান্তর করে। কিন্তু এর মধ্যে একই সিরিয়ালের ভুয়া পাতা তৈরি করা হচ্ছে। ডুপ্লিকেট ওই পাতা ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ তুলে নেয়া হচ্ছে। কিছু ব্যাংক অর্থ হস্তান্তরের পূর্বে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের স্বাক্ষর যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যাংকের উদাসীনতা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে এমনই একটি জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্র্যাক ব্যাংকের গুলশান শাখার কর্মকর্তারা তাদের গ্রাহক ‘উর্মি ফ্যাশন গ্যালারির (হিসাব নং-১৫০১ ২০২০ ৮৮২১ ৩০০১) পক্ষে চারটি চেক জালিয়াতি করে। মোট এক কোটি ৪৬ লাখ ৯৮ হাজার ২০০ টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে এসিআই সল্টের এ্যাকাউন্টে থেকে কেটে নিয়ে উর্মি ফ্যাশন গ্যালারির এ্যাকাউন্টে জমা দেখিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হওয়া অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চেকের এমআইসিআর লাইনটি মেশিন রিডেবল না হওয়া সত্ত্বেও চেক উপস্থাপন করে টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। ইউভি মেশিনে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করা, মূল চেকের হুবহু নকল করা হয়েছে, এমআইসিআর লাইনটি ঘষামাজা, স্ক্যানার মেশিন রিড করতে না পারা, গ্রাহকের নিকট প্রকৃত চেক থাকা সত্ত্বেও জাল চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এমআইসিআর চেক ব্যবহারে চেক জালিয়াতি হওয়ার কথা নয়। তারপরও একটি চক্র দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলো সতর্ক রয়েছে। ব্যাংকের কোন কর্মকর্তা যদি এই অপতৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে ছাপানো প্রযুক্তির ব্যবহারে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। তারপরও কেউ ইচ্ছা করলে প্রায় কাছাকাছি একটি চেক ছাপানো কঠিন কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংককে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাহকের স্বাক্ষর পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মিলিয়ে দেখা, বড় অঙ্ক তথা এক লাখ টাকার চেক হলেই গ্রাহককে জিজ্ঞাসা করার বিধান রয়েছে। এভাবে অনেক জালিয়াতি ধরা পড়েছে।
×