ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জগলুল কবির

মনের টানে প্রকৃতির কাছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

মনের টানে প্রকৃতির কাছে

সোনালি ধানের মাঠ, এ মাঠ পেরিয়ে ঐ দিগন্ত, যেখানে প্রকৃতি সবুজের পসরা সাজিয়েছে। মনে হয় সোনালি সাগরের পারে সবুজে সবুজে ভরা প্রকৃতি আমাদের জন্য নতুনভাবে সেজেছে। দোয়েল-কোয়েল, মহুয়া-চড়ুই-শালিকেরা যেন জানান দিচ্ছে এটা আমাদের আহার সংগ্রহের ভরা মৌসুম। এদের কিচিরমিচির ডাকে গ্রামগুলো নতুন সুরে বেজে ওঠেছে। ঘরে পালা কবুতরগুলো বাকবাকুম শব্দে সোনালি সাগরে ডুব দিচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে এরা মনের আনন্দে খাবার খাচ্ছে। আনন্দ শেষে নিজের নীড়ে নিজেদের মতো করেই ফিরে আসছে। চড়ুইড়া ঝাঁকে ঝাঁকে ধানের ক্ষেতে আসে। ওদের ভরা যৌবনের নেশায় এখানেও মেতে ওঠে। বার বার যৌবনের স্বাদ ওরা নিতে থাকে। ওদের দেখে আমরা পুলকিত হই। আমাদের হৃদয়েও পবিত্র প্রেম জেগে ওঠে। দেখেছি ঐ দিগন্তে সোনালি সাগড় পাড়ি দিয়ে একাকী একটি পাখি উড়ে চলেছে, ও যেন নিজের সাথীরে খুঁজে, প্রেম ও ভালবাসার টানে এমন সুদূরে ডানা মেলেছে। এমনি হলো ভালবাসার টান যা কি-না বিশাল সোনালি-সমুদ্র পাড়ি দিতেও উদ্বুদ্ধ করে। দোয়েল যে জাতীয় পাখি, তা গ্রামে গেলে এখনও বুঝা যায়। পৌষের শুরুতে সোনালি ধানের ক্ষেতে এরা বার বার আসে। একটু খেয়ে ফুরুত করে গাছের ডালে উড়ে যায়। আবার কিছুক্ষণ পড়ে নিচে নেমে আসে। ওদের সকাল থেকে সন্ধ্যাবেলা এভাবেই কাটে। মনের আনন্দে এ পাখিগুলোর জীবনও ভরে ওঠে এই শীতের ঋতুতে। যা পল্লী­কবির সোনার বাংলাদেশে এখনও দেখা যাচ্ছে মাঠ-ঘাট, গ্রাম-প্রান্তরে। দক্ষিণ বাংলার একটা পুরনো ঐতিহ্য, প্রায় প্রতি ঘরের সঙ্গেই একেকটা পুকুর, ডোবা-জলাশয়গুলো বিলের কোনায় কোনায়। মাছরাঙা পাখি একা একা একেকটি ডালের মাথায় ঝিম মেরে বসে থাকে, হঠাৎ পানির ভেতর তেড়ে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করে উড়ে চলে যায়। মাছরাঙার রং নজর করে দেখলে সকলেরই মন রঙিন হয়ে যাবে। অদ্ভুত সুন্দরে সাজানো তার শরীর। মাছরাঙার রং গাঢ় নীল, হলুদ ও কালো আর সাদার মিশ্রণ, অন্তর চোখ দিয়ে দেখলে চোখ ভরে মনও জুড়িয়ে দেবে। কাকগুলো বোধ হয় শহর কেন্দ্রিক, গ্রামে এর বিচরণ মনে হলো কম। কৃষক তো আমরাই, আমাদেরই স্বজনরা। এখন ওনারা সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। নিজেই ধান কেটে বেঁধে এক জায়গায় করে নেয়। এখন আর আগের মতো গরু দিয়ে মাড়াই করার প্রয়োজন হয় না। মেশিন দিয়ে মাঠে বসেই মাড়াই করে ফেলে। গ্রামীণ অনেক ঐতিহ্যই আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে। তবুও ভাপাপিঠা, চিতলপিঠা, নিজের ঘরে মুড়ি ভাজা এগুলো বাকি আছে। আর এখনও এখানে প্রায় সব পরিবার হাঁস পালে। হাঁসগুলো সকাল থেকে সন্ধ্যা পুকুরে পুকুরে ভেসে চলে, মূলত খাবার সংগ্রহের জন্য। তবে এদের বেঁকে বেঁকে হাঁটার পৎ পৎ শব্দের মাঝে একটা ভিন্ন ধরনের শিল্পের আবেদন আছে। যা নজর করলে মানুষও রোমান্টিক হয়ে যায়। হাঁসগুলো খেতে খেতেই নিজেদের মাঝে নিজেরা রোমান্টিক হয়ে ওঠে। সাহেব-বেগম মিলে-মিশে দুজনে যেন দুজনার তার জানান দেয়, একাকার হয়ে যায়, পরক্ষণে আবার মনোনিবেশ করে নিজের খাবার খাওয়ায়। পুকুরের ধারে হাঁস আর বক একাকার, মনে হয় একই প্রজাতির ভাই-বোন। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে পাখিগুলোও বিভেদ ভুলে গিয়েছে। এমনি হয়। এটাকেই বলে সুন্দরের পুজারি। ঠিক এমনি মানুষ। সুন্দরকে পেলে মানুষও আনন্দিত হয়। বিভেদ ভুলে একাকার হতে পারে। প্রকৃতি এটাই শেখায়। পথে পথে হেঁটে চললে দেখা যায়, মোড়গ-মুরগিরাও দল বেঁধে ক্ষেতের ধারে ঘুরে ঘুরে খাবার খাচ্ছে। লাল-সাদা-খয়েরির মিশ্রণ। মা মুরগিরা ১০-১৫টা বাচ্চা নিয়ে আনাচে-কানাচে ঘুরে ঘুরে খাবার নিচ্ছে। নদীর ধারে সমুদ্রের পাড়ে গাংচিলেরা উড়ে বেড়ায়। অতিথি পাখির কলোরবে সাগর-ঝিল-পুকুর ভরে থাকে। পাখিরা সাধারণত নিরীহ, নিরীহ সবকিছু মানুষের প্রিয়, আর এদের সৌন্দর্য বোধ হয় প্রাকৃতিক। প্রকৃতিই মানুষকে তার মতো নির্মল করে দিতে পারে। শীতের সকালে সরিষার সবুজ গাছে শিশিরের ঝরনা ঝরেছে। সাদা শিশিরে ভরা ক্ষেত। শিশিরগুলো যেন কোন এক অজানা মায়ায় তার প্রেম দিয়ে সবুজ গাছগুলোকে সিক্ত করে দিচ্ছে। শিশিরের কনার উপরে খালি পা রাখলে হৃদয়ে শিহরণ আসে। স্বর্গীয় অনুভূতি। সরিষা গাছের পাশে পানের বরজ। ভিন্ন মাত্রার কৃষি। ফাঁকে ফাঁকে সবজি লাগানো হয়েছে। একটি বাগানবাড়িতে গিয়ে দেখলাম বসতঘরের সামনে ছোট একটি বাগান, প্রায় সব ধরনের ফলজ গাছ এখানে আছে। দক্ষিণ দিকে বড় পুকুর, পুকুরের পারে বড়ই, নারিকেল, তেঁতুল, তাল ও কিছু কিছু কাঠ গাছ। বাড়ির পূর্বদিকে আম গাছের ছোট বাগান, কাঁঠাল গাছ, বড় বড় বিভিন্ন গাছ যা দিয়ে ভাল কাঠ হবে। এর সঙ্গেই আরেকটি পুকুর। এখানে পানি স্বচ্ছ। ঘাট বসানো আছে। ঘাটটি দক্ষিণমুখী, এটা অনেক চওড়া করে বাঁধানো, কিছুটা পূর্বের সময়ের জমিদার বাড়ির ধাঁচের। পুকুরে লাইন দিয়ে হাঁসগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শীতের মিষ্টি রোদের আলোকছটা যখন পানিতে ভেজা হাঁসের পেখমে পরে বিকিরণ করছে তা দেখে মনে হয় প্রকৃতি তার রূপকে চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। বড় পুকুর ঘাটের সঙ্গে মসজিদ। পাশেই বড় মাঠ ও কাচারি ঘর। এমনইভাবে সাজানো আছে আমাদের গ্রামের কিছু কিছু বাড়ি। শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় যে ছবি তার চেয়েও সুন্দর ও সাজানো রূপকে আমি এখানে দেখেছি। কোন মানুষ এমন সুন্দরকে যদি অন্তর দিয়ে দেখে কেবল তখনই এই দেশের রূপকে উপলব্ধি করতে পারবে। তখনই মনে হবে ‘এমন দেশটি কোথায়ও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি ।’ তাই প্রকৃতির এতরূপ দেখতে হলে এই শীতের দিনে গ্রামে যেতে হবে। শহর থেকে গ্রামে গিয়ে গ্রামকে উপভোগ করলে নিজের ক্লান্তি দূর হবে। সঙ্গে পাড়াগাঁয়ের মানুষকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হবে। প্রকৃতিতে এত সুন্দর করে সাজানো এ দেশে এখনও গ্রামে গ্রামে শীতের কাপড়ের অভাবে মানুষ কষ্ট পায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত যারা দিনমজুরের কাজও করতে পারে না, আবার বড় কোন কাজও নেই, তাদের কেউ কেউ এখনও অভাবে আছে। ওদের কষ্ট নিজের চোখে দেখলে মায়া হবে ও কষ্ট লাঘবের জন্য কিছু করার আগ্রহ তৈরি হবে। সামর্থ্যরে মধ্যে সহযোগিতা করতে পারবেন। ব্যক্তিগতভাবে কিছু করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এত সুন্দর প্রকৃতির রূপ ও মায়া দেখে এমন মহৎ কাজ করতে পারলে সত্যিই সুন্দর আর ত্যাগের মহিমায় মনে হবে এ যেন এ ধরায়ই স্বর্গীয় সুখ আপনার জন্য নেমে এসেছে। তখনই আমরা বলতে পারব এমনই মায়াময় মমতা আর ভালবাসায় জড়ানো সোনার বাংলা আমার জন্মভূমি, তোমার বুকে জন্ম নিয়ে মাগো আমি ধন্য হয়েছি। এ জন্মভূমির সবার মাঝেই তোমরা আমায় খুঁজে নিও। মডেল : সজিব খান ও সজিব চৌধুরী
×