ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চরমপন্থী, নাকি ভিন্ন নামে কোন জঙ্গী গোষ্ঠী- এলাকায় আতঙ্ক

উত্তরাঞ্চলে রাতে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিচ্ছে এরা কারা!

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

উত্তরাঞ্চলে রাতে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিচ্ছে এরা কারা!

সমুদ্র হক/বিশ্বজিৎ মণি ॥ ফের চরমপন্থীদের (!) আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পূর্বের জায়গাগুলোতেই এরা সমবেত হচ্ছে, তবে কিছুটা ভিন্নভাবে। ইতোমধ্যে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পাকা সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় গ্রামীণ জীবনমান পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর ধু ধু পাথার তেমন নেই। পাকা সড়কের মোড়গুলোতে দোকানপাট, কোথাও ছোট বাজার বসেছে। যেখানে সারাক্ষণ জনসমাগম লেগেই থাকে। এছাড়া ঘরবাড়ি নির্মিত হচ্ছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও টেম্পো, ব্যাটারি চালিত থ্রি হুইলার (ইজি বাইক) দিনভর এবং রাতের অনেকটা সময় ধরে চলাচল করে ওসব পথে। এ অবস্থায় সেদিনের চরমপন্থীরা এখন সহজেই প্রকাশ্যে বের হতে পারে না, এমন ধারণাই সাধারণের। এর মধ্যেই তারা সন্ধ্যার পর হতে রাতের কোন সময়ে অস্ত্র উঁচিয়ে কখনও ফাঁকা গুলি করে তাদের (!) অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। গত ক’দিনে উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি এলাকায় চরমপন্থীদের নানাভাবে আবির্ভূত হতে দেখা যাচ্ছে। তবে এরা আসলেই চরমপন্থী কিনা অথবা চরমপন্থীর ছদ্মাবরণে উগ্র জঙ্গী কি না বিষয়টি এখনও খতিয়ে দেখা হচ্ছে না। নওগাঁর আত্রাই, রানীনগর, মান্দা এলাকা, নাটোরের সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, কামারখন্দ, পাবনার ঢালারচর, বগুড়ার শেরপুরের ভবানীপুর ও নিকটের রানীরহাট এলাকায় বছর কয়েক আগে চরমপন্থীরা (যাদের কেউ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি কেউ সিরাজ সিকদারের অনুসারী নামে চিনত দিনে রাতে মহড়ার পাশাপাশি গ্রামের জোতদার শ্রেণীকে হত্যা করত। নওগাঁর আত্রাই রানীনগর মান্দা, নাটোরের সিংড়া, পাবনার ঢালারচরে এরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ অনেককে হত্যা করেছে। বগুড়া নাটোর সিরাজগঞ্জের সীমানার ত্রিকোন পয়েন্ট শেরপুরের ভবানীপুর ও শাজাহানপুরের রানীরহাট এবং বগুড়ার আদমদীঘি ও নওগাঁর আত্রাই এলাকা দ্বিমুখী পয়েন্টে এই চরমপন্থীরা খুব সহজেই তাদের লক্ষ্য পূরণ করে নির্বিঘেœ সটকে পড়েছে। নওগাঁ, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্টে স্থাপিত পুলিশ ক্যাম্পেও এরা হামলা চালিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটিয়েছে। প্রথমে এরা ধরা পড়েছে কম। একটা সময় পুলিশের লাগাতার চিরুনি অভিযানে এদের বেশিরভাগই ধরা পড়ে। অনেকে আত্মসমর্পণ করে। তারপর এই চরমপন্থীদের আর দেখা যায়নি। এর কিছুদিন পরই নওগাঁ ও আত্রাই এলাকাতেই আবির্ভূত হয় উগ্র জঙ্গীগোষ্ঠী জামায়াতুল মুজাহিদীন (জেএমবি)। এই জঙ্গীরা দেশজুড়ে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তবে জেএমবি উত্থানের আগেই উগ্র মৌলবাদী জঙ্গীরা নানা নামে দেশের প্রতিটি স্থানেই শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটাতে থাকে। একটা সময় এই জঙ্গীদের দমন করা হয়। বিশেষ করে বাংলাভাই পরিচয়ের সিদ্দিকুল ইসলাম, শায়খ আব্দুর রহমানসহ জেএমবির কয়েকজনের বিচার ও ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর জেএমবির কার্যক্রম প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। কিছুদিন পর পুনরায় উগ্র জঙ্গীদের আবির্ভাবে জেএমবিসহ নানা জঙ্গী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা শুরু হয়ে যায়। যা এখনও চলমান। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করা যাচ্ছে কথিত সর্বহারা পার্টির আদলে চরমপন্থীদের আনাগোনা। বগুড়ার শেরপুরের ভবানীপুর বাজার এলাকায় গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর দোকানপাট যখন কেবলই দুই একটা করে বন্ধ হচ্ছে তখনই প্রায় ৫০ জনের অস্ত্রধারী তরুণ অস্ত্র উঁচিয়ে বাজারে প্রবেশ করে মহড়া শুরু করে। সঙ্গত কারণেই দোকানি ও বাজারের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। দ্রুত দোকানপাট বন্ধ করে দোকানিরা। সওদাপাতি নিতে আসা লোকজন বাজার ছাড়তে শুরু করে। অস্ত্রধারীরা দেয়ালে পোস্টার দোকানের ভেতরে লিফলেট ছড়ায়। তারপর ফাঁকা গুলি ও মিছিল করে এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নামে সেøাগান দেয়। ঘণ্টাখানেক পর তারা সিরাজগঞ্জের দিকে যায়। বাজারের এক দোকানি জানান, এই তরুণদের পরনে ছিল হাফ প্যান্ট। বেশিরভাগেরই মুখ ছিল মুখোশে ঢাকা। আরেক দোকানির কথা- বছর কয়েক আগে চরমপন্থীদের যেভাবে সেøাগান দিতে দেখেছেন ও শুনেছেন এবারের চরমপন্থীদের কথা বার্তা চালচলন অন্যরকম। যতক্ষণ বাজারে ছিল ততক্ষণ অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিয়েছে। এর আগের চরমপন্থীদের মহড়া এ ধরনের ছিল না। তারা প্রকাশ্যে অস্ত্র বের করেনি। তবে লুকিয়ে যে রাখত তাও বোঝা যেত। এদের অস্ত্র দেখে মনে হলো এরা নতুন। একটাই মিল ছিল- এরাও লোকজনের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি। ভবানীপুরের এক জনপ্রতিনিধি জানালেন, দশ বছর আগে একই বাজারে শতাধিক চরমপন্থী এসে সমাবেশ করেছিল। তারাও সংগঠনের পোস্টার এঁটে দিয়েছিল। ওই সময় চরমপন্থীরা এই বাজারে রাতে মাঝে মধ্যেই আসত। এদের আগমন বোঝা যেত। এবার একেবারে অপ্রত্যাশিত আগমন। এদের বয়স ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। মনে হবে এরা ছাত্র। নওগাঁর আত্রাই রানীনগর এলাকার ক’জন জানান, কিছুদিন ধরে চরমপন্থীদের মতোই একশ্রেণীর তরুণের আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বছর কয়েক আগেও আত্রাই রানীনগরের অনেক এলাকা ছিল বিরানভূমি। মনে হবে নিধুয়া পাথার। বর্তমানে লোকালয় ঘরবসতি ও বাজার বসেছে। এই এলাকার সঙ্গেই চলনবিলেরও একটা লিংক আছে। যা সিংড়া হয়ে চলে গেছে। চলনবিলের এই লিংক এখন আর জলাশয় নেই। শুকিয়ে গিয়ে পথঘাট উন্নত হয়েছে। এর মধ্যে চরমপন্থীদের আগমন আগের অবস্থানে নেই। আহসানগঞ্জ (আত্রাই) রেল স্টেশনের কাছের এক দোকানি বললেন, চরমপন্থীদের মতো কিছু তরুণকে দেখা যাচ্ছে। তারা মোটরসাইকেলে চেপে আসে। পরনের কাপড়চোপড় আগের চরমপন্থীদের মতো নয়। তিনি শুনেছেন চরমপন্থী আর নেই। তাহলে বর্তমানে যারা চরমপন্থী পরিচয়ে মহড়া দিচ্ছে এরা কারা! পূর্বের চরমপন্থী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে খোঁজখবর করে প্রায় একই ধরনের তথ্য মিলেছে। বগুড়ার শেরপুরের ভবানীপুরে যে তরুণরা মহড়া দিল তারা কি সত্যিই চরমপন্থী! শেরপুর থানা পুলিশ বলছে ওই বাজারে চরমপন্থীরা ফাঁকা গুলি করেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তারা যে পোস্টার সেঁটে দিয়েছে তা জেনে পরদিন সকালেই তা অপসারিত হয়েছে। কারা এই কাজ করল তার অনুসন্ধান চলছে। পুলিশের আরেক সূত্র জানায়, চরমপন্থী কিনা তা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না। বর্তমানে অন্য কোন উগ্র গোষ্ঠী চরমপন্থীর ছদ্মাবরণে মাঠে নামছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
×