ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলনবিলের নৌকা-স্কুল

শিক্ষা বিস্তারে এগিয়েছে কয়েক ধাপ, বিশ্বের দেশে দেশে মডেল

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

শিক্ষা বিস্তারে এগিয়েছে কয়েক ধাপ, বিশ্বের  দেশে দেশে মডেল

সমুদ্র হক চলনবিলের জলরাশির নৌকা-স্কুল শিক্ষা বিস্তারকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। বিলের তীরের গ্রামের কোন শিশু আর শিক্ষা বিমুখ থাকছে না। দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিশ্বের কয়েকটি দেশে এই নৌকা-স্কুল শুধু পরিচিতি পায়নি, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় মডেল হয়েছে। বিল পাড়ের নিভৃত গ্রামের এক তরুণ প্রকৌশলী যিনি বুয়েট থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় ডিগ্রী নিয়েছেন তার সৃষ্টিশীল ভাবনায় ফসল এমন নৌকা-স্কুল। এই স্কুলের আইডিয়া বিলগেটসের মেরিন্ডা ফাউন্ডেশনের মনেও ধরেছে। তারাও এই মডেল নিয়েছে। নৌকা স্কুল মূলত অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক পাঠের একটি ভাসমান স্কুল। বিল ও নদী তীরের গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা যখন দূরের কোন স্কুলে যেতে পারে না তখন শিক্ষার ব্যাঘাত ঘটে। আবার প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির পরও নানা কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরেও পড়ে। বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে শিশুদের একটা অংশ এখনও এমন বঞ্চনার শিকার। আরেকদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত এই দেশে বন্যার সময় অনেক প্রাথমিক স্কুলে পানি উঠে পাঠ বন্ধ থাকে অনেকটা সময়। এক তথ্যে বলা হয়, মৌসুমি বন্যায় দেশের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা ডুবে যায়। বড় বন্যায় তিন ভাগের দুই ভাগ এলাকা তলিয়ে যায়। বন্যাকবলিত গ্রামের শিকার হয় শিশু শিক্ষার্থীরা। প্রাথমিক স্কুল ডুবে থাকায় অন্তত ১৫ লাখ শিশুর লেখাপড়ার ক্ষতি হয়। বন্যার সময় বিলের কোন গ্রামের শিশুরা যেন কোনভাবেই পাঠ থেকে দূরে না থাকে সেই লক্ষ্যেই বিলপাড়ের প্রকৌশলী মোহাম্মদ রেজওয়ান বনিয়েছেন নৌকা-স্কুল। উত্তরাঞ্চলের নাটোরের চলনবিল পাড়ের গুরুদাসপুর উপজেলার প্রত্যন্ত সিঁধুলাই গ্রামের ছেলে রেজওয়ান। বনেদী পরিবারের ছেলে, বেড়ে উঠেছেন চলবিলের জলরাশির মধ্যে। তিনি নিজেও ছিলেন টানা বৃষ্টি ও বন্যার কারণে স্কুলে যেতে না পারার শিকার। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোন পথ ছিল না সেই সময়ে। তখন শিশুমনেই গেঁথে যায় এই অবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। প্রাথমিক মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের পর ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। ১৯৯৮ সালে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক পাস করেন। তখন থেকেই শিশুমনে অঙ্কুরোদগম হওয়া সেই ভাবনার বীজ তরুলতায় মেলে যায়। নিজের সিঁধুলাই গ্রামে স্বনির্ভর সংস্থা নামে অলাভজনক সংগঠন গড়ে তোলেন। এর মধ্যেই ঢুকে পড়ে সৃষ্টিশীল ভাবনা নৌকার মধ্যে স্কুল গড়া। ৫৫ ফুট প্রস্থ ও ১১ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি মাঝারি নৌকা বানিয়ে তার ওপর বাঁশ-বেতের বড় ধরনের ছাউনি (ছই) এঁটে দেন। ঘরের মতো জানালাও থাকে। পাঠদানের ছোট কক্ষ বানান নৌকার মধ্যেই। যেখানে এক সঙ্গে ৩০ শিশু পাঠ নিতে পারে। এই নৌকা-স্কুল পরিচালনার জন্য একটি টিম তৈরি করেন। এভাবে প্রথম নৌকা-স্কুল চালু হয় ২ হাজার ২ সালে। রেজওয়ান তার স্কলারশিপের ৫শ’ ডলার দিয়ে স্কুল বানিয়ে ল্যাপটপে ই-মেইলে সেই তথ্য ছড়িয়ে দেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বছর না পেরোতেই দেখা যায় বর্তমানে বিলের শুকিয়ে যাওয়া ভূমির ওপর স্থাপিত স্কুলের চেয়ে এই স্কুলের উপস্থিতির হার বেশি। অবকাঠামোর স্কুলের চেয়ে এই নৌকা-স্কুলের সুযোগ-সুবিধা দিনে দিনে বাড়ানো হয়। বর্তমানে স্কুলের ভেতরে বাতির জন্য নৌকার ছাদে বসানো হয়েছে সৌর প্যানেল (সোলার)। রাতেও সোলারের বাতিতে ক্লাস কার্যক্রম চলে। সবচেয়ে বড় যে বিষয় তা হলো নৌকা-স্কুলে ছোটদের পাশাপাশি বড়দের কম্পিউটার শিক্ষারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাঠাগার কম্পিউটার ল্যাব সংযুক্ত করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক অনেক ডিভাইস দ্বারা সাজানো হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির এমন ল্যাব। প্রযুক্তির অগ্রসরতায় গ্রামের অনেক শিক্ষিত অভিভাবক এই কম্পিউটার ল্যাবের ডিজিটাল প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। জলে বেষ্টিত চলনবিলের তীরের গ্রামগুলোতে আধুনিক শিক্ষা প্রযুক্তির সুযোগ করে দিয়েছে এ নৌকা স্কুল। চলনবিল বলতেই আগে বলা হতো পশ্চাৎপদ এলাকার জনগোষ্ঠী। আজ সেই জনগোষ্ঠী পরিবর্তনের ধারায় যোগ দিয়ে নতুন দুয়ার খুলছে একের পর এক। এমন স্বর্ণ-দুয়ার খুলে দিয়েছে গ্রামের তরুণ রেজওয়ান। বর্তমানে রেজওয়ানের নৌকা-স্কুলের সংখ্যা একশ’টি। যা তিন জেলার ভেতরে থাকা বিশাল বিলের প্রতিটি পয়েন্টে ভেসে বেড়ায়। ভিড়ছে ঘাটে ঘাটে। রেজওয়ানের এই নৌকা-স্কুলের বিষয়টি ই-মেইলে পৌঁছে যায় বিশ্বের সেরা ধনী বিলগেটেসের মেরিন্ডা ফাউন্ডেশনে। সেখান থেকে অনুদান মেলে ৫ হাজার ডলার। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে জলবায়ুর ঝুঁকির মধ্যে থাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান সেøাভানিয়া ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া নাইজরিয়া জাম্বিয়া ফিলিপিন্সসহ কয়েকটি দেশ রেজওয়ানের এই মডেল গ্রহণ করে বাস্তবায়িত করেছে। ওইসব দেশের পাঠ্যপুস্তকেও স্থান পেয়েছে এই স্কুল। এমন স্কুলের স্থপতি রেজওয়ান জানান, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বন্যাকবলিত অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় পড়ে। অস্তিত্বের এমন সঙ্কট মোকাবিলায় নৌকা-স্কুল ছাড়াও নৌকার মধ্যে ভাসমান কৃষি খামার, সবজি বাগান, প্রয়োজনে পোলট্রি ফার্ম গড়ে তোলা সম্ভব। নৌকা-স্কুলকে আরও উন্নত করে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে প্রাথমিক মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক এমনকি স্নাতকোত্তর পর্যায়েও নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এমন স্বপ্ন দেখছেন রেজওয়ান। তার এই ভাসমান স্কুলের ওপর বরেণ্য তথ্য চিত্র নির্মাতা ‘ইজি লাইক ওয়াটার’ নামে একটি তথ্য চিত্র বানিয়েছেন, যা বিশ্বের দেশে দেশে প্রদর্শিত হয়ে বাংলাদেশের বড় অর্জনটি সমর্থিত হয়েছে। সামনের দিনে সকল ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষ সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে সেই চেষ্টা করছেন রেজওয়ান।
×