ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় শুরু হচ্ছে রোহিঙ্গা শুমারি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় শুরু হচ্ছে রোহিঙ্গা শুমারি

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কক্সবাজার জেলায় নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। কিন্তু অনিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যার কোন হিসাব নেই সংশ্লিষ্ট দফতরে। কারও মতে চার লাখ, আবার কারও মতে পাঁচ লাখ। এবার এসব অনিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সঠিক সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। জেলার আট উপজেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করা রোহিঙ্গা নাগরিকদের শুমারি কার্যক্রমের আওতায় আনা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ডাটাবেজ তৈরি করতে ‘অনিবন্ধিত মিয়ানমার নাগরিক শুমারি’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে সূত্রে জানা গেছে। ওই প্রকল্পের আওতায় আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে ৪৯টি প্রশ্ন নিয়ে শীঘ্রই মাঠ পর্যায়ে শুমারি পরিচালনা করার জন্য কক্সবাজার পরিসংখ্যান ব্যুরোকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গত বছরের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেকে) অনুমোদন পান প্রকল্পটি। চলতি ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত থাকবে এ প্রকল্পের মেয়াদকাল। সূত্রমতে, মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে এদেশের আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের জন্য ১৯৯২ সালে সীমান্তের নাফ নদী ও স্থলপথ অতিক্রম করে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক সপরিবারে অনুপ্রবেশ করে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। ওসময় সরকার তাদের শরণার্থী মর্যাদায় খাদ্য ও মানবিক সেবা দিয়ে প্রায় ২০টি ক্যাম্প নির্মাণ করে সেখানে আশ্রয় দেয়। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক মিয়ানমারের সঙ্গে দফায় দফায় কূটনীতিক তৎপরতা জোরদার ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের সেদেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। প্রত্যাবাসনের আওতায় বেশিরভাগ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার এক পর্যায়ে ২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াত ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে হঠাৎ করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তখন উখিয়া ও টেকনাফের দুটি শরণার্থী ক্যাম্পে আটকা পড়ে যায় প্রায় ৩৩ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা। এরপরও বিভিন্নভাবে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গারা ফের অনুপ্রেবেশ করে ঝুঁপড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করে। সূত্রমতে, ওই সময় নাফ নদী অতিক্রম করে আরও লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সপরিবারে অনুপ্রবেশ করে উখিয়ার কুতুপালং বনভূমির জায়গায় ঝুঁপড়ি বেঁধে আশ্রয় নেয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক জয়নুল বারী এসব রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে দফায় দফায় চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত ওইসব রোহিঙ্গাদের অবৈধ ঘোষণা করে তাদের কোন প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা না করার ঘোষণা দেন স্থানীয় এনজিওগুলোকে। অরক্ষিত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের ধারাবাহিকতায় উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে এখন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা ১২ হাজার। কিন্তু স্থানীয়দের হিসাবে এদের সংখ্যা প্রায় ৭০ থেকে ৯০ হাজার। টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা ১৮ হাজার। ওই ক্যাম্পের কাছে লেদা এলাকায় আছে অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গা। এছাড়া পুরো জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অন্তত ৪ লাখ রোহিঙ্গা। জানা গেছে, গত ২০১৫ সালের জুনে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেকে) অনুমোদন পান প্রকল্পটি। ‘বাংলাদেশে অবস্থানরত অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক শুমারি ২০১৫’ শীর্ষক প্রকল্পটির জন্য বিশ্বব্যাংক ২১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত থাকবে এ প্রকল্পের মেয়াদকাল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারী হিসাব অনুযায়ী যে সংখ্যক রোহিঙ্গার কথা বলা হয়, তা সঠিক নয়। প্রতিদিনই অবৈধ অধিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা এখন শুধু কক্সবাজার এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই। দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে এদের বেশিরভাগই মাদক, অস্ত্র, চোরাচালান, ডাকাতি, ছিনতাইসহ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ কর্মকা-ে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশ গিয়েও তারা নানা অপকর্ম করছে। এছাড়া জেলার অন্যান্য উপজেলা ছাড়াও শহরের এসএমপাড়া, পাহাড়তলী, লারপাড়া, কলাতলী, আদর্শ গ্রাম, টিএ্যান্ডটি পাহাড়, সার্কিট হাউস, সিটি কলেজ, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, কুতুবদিয়াপাড়া, সদরের ইসলামপুর, ঈদগাঁও, পিএমখালী এলাকায় ছোট-বড় ৩০টি পাহাড়ে, খাসজমি ও ভাড়া বাসায় ৫০ হাজারের বেশি ঘরে বসবাস করছে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। কক্সবাজার পরিসংখ্যান ব্যুরোর উপ-পরিচালক ওয়াহিদুর রহমান জানান, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ৫টি কারণসহ শুমারি জরিপে ৪৫টি প্রশ্ন রাখা হবে। রোহিঙ্গা নাগকিরদের এদেশে অনুপ্রবেশের কারণ চিহ্নিত করতে অনিবন্ধিত নাগরিকদের একটি সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি, তাদের ছবি ও দলিলাদি সংগ্রহ, বর্তমান অবস্থান, এদেশে অনুপ্রবেশের আগে মিয়ানমারের স্থায়ী বাসস্থান নিরূপণ এবং আর্থ-সামাজিক পরিসংখ্যানই শুমারির প্রধান লক্ষ্য। চলমান শুমারি কার্যক্রমের ফলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও এ শুমারির কারণে উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রসঙ্গত, কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নোয়াখালীর হাতিয়ার ঠ্যাঙ্গারচর এলাকায় নেয়ার কথা ভাবছে সরকার। এই বিষয়ে নোয়াখালীর জেলা প্রশাসকের কাছে বেশ কিছুদিন আগে এমন একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়। হাতিয়ার ঠ্যাঙ্গার চরাঞ্চলের ৫শ’ একর জায়গার প্রস্তাব নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠান। তবে বিষয়টি সরকারের বিবেচনাধীন আছে বলে জানিয়েছেন সরকারী একটি সূত্র।
×