ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না কেউ ;###;অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে

টিউশন ফি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারী স্কুল-কলেজে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

টিউশন ফি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেসরকারী স্কুল-কলেজে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নতুন পে স্কেলে সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন বাড়লেও এবার গ্যাঁড়াকলে পড়েছে বেসরকারী স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা! পে স্কেলে সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে তাই বেসরকারী স্কুল, কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তাদেরও দাবি বাড়াতে হবে বেতন। আর এ দাবিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতেই রাজধানীসহ সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ পাল্লা দিয়ে বাড়াচ্ছেন শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি, বেতনসহ সকল শিক্ষা ব্যয়। বেতন ফি বৃদ্ধিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কোন নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত বেতন ফি বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মাঝে। রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজে বর্ধিত বেতন প্রত্যাহারে কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন আন্দোলনরত অভিভাবকরা। হঠাৎ করে বেতন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে এক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রবিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের’ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনে ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন অভিভাবকরা। দাবি আদায়ে একই সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান এবং লাগাতার অবস্থান কর্মসূচীও ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া অধ্যক্ষ নিয়োগ, গবর্নিং বডির নির্বাচন, শিক্ষক নিয়োগ এবং কলেজের বিভিন্ন অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধেও আইনী ব্যবস্থা নিতে দুই মাসের সময় দিয়েছেন অভিভাবকরা। মাসিক বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে গত ৩ জানুয়ারি অভিভাবকরা স্কুলের বাইরে কাকরাইল এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছিলেন। ওই দিন স্কুলের ইংরেজী মাধ্যমের ভারপ্রাপ্ত প্রধান এ এস এম মাসুদ জানিয়েছিলেন, স্কুলের ব্যবস্থাপনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেতন বাড়ানো হয়েছে। রবিবার সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অভিভাবক শামিমা সুলতানা বলেছেন, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বর্ধিত ফি প্রত্যাহারসহ তিন দফা দাবি আদায় না হলে ১৩ জানুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান এবং ১৭ জানুয়ারি স্কুল প্রাঙ্গণে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী পালন করা হবে। অভিভাবকদের অন্য দাবি দুটি হলো- মতিঝিল আইডিয়াল ও ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের টিউশন ও অন্যান্য ফি সমন্বয় করা এবং স্পেশাল ক্লাসের নামে ‘মাত্রাতিরিক্ত’ বেতন আদায় বন্ধ করা। অভিভাবকদের অভিযোগ, সরকারীভাবে কোচিং নিষিদ্ধ করা হলেও স্পেশাল বা বিশেষ ক্লাসের নামে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসিক বেতনের সমপরিমাণ টাকা আদায় করা হচ্ছে। বেতনের বাইরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বছরে ৩০০ থেকে ১৮০০ টাকা ‘আইটি চার্জ’ নেয়া হলেও আদতে শিক্ষার্থীরা আইটি সুবিধা পায় না। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে ৬০ জন শিক্ষক এবং ১০০ কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগ করেছে অভিভাবক ফোরাম। অভিভাবকদের একজন হারুনুর রশিদ বলেন, সরকারী বেতন স্কেলের পর মেয়ের বেতন হঠাৎ করে ১৩০০ টাকা থেকে ২১০০ টাকা হয়ে গেল। এটা কি ধরনের কথা। অথচ আইডিয়াল কিংবা ভিকারুন নিসা স্কুলে বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। বেতন বাড়বে বাড়ুক। আমরা চাই অন্য স্কুলের সঙ্গে সমন্বয় করা হোক। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন এক ধাপে ৬০০ থেকে বেড়ে ১১০০ টাকা এবং ইংরেজী মাধ্যমে ১৯০০ থেকে ২৭৫০ টাকা হয়েছে বলে জানান এই অভিভাবক। ষষ্ঠ শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর মা তাহমীনা চৌধুরী বেতন বাড়ানো প্রসঙ্গে বলছিলেন, আমার বাচ্চার বেতন আগে যা ছিল এখন তার থেকে প্রায় এক হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। প্রায় দ্বিগুণ। বেতন বাড়ানোর একটা পরিমাণ থাকে। তাদের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। অভিভাবকের অভিযোগ, বর্তমানে যিনি প্রধান শিক্ষক আছেন তিনি স্কুলের দায়িত্বে আসার পর থেকে সবাইকে বিরক্ত করছেন। উনি আসার পর বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন, শিক্ষকরা সঠিকভাবে পাঠদান করেন না। কোন নিয়ম-নীতি নেই বললেই চলে। এদিকে বর্ধিত বেতন কমানো হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে বেতন বৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করেছেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় দিয়ে ৩৯৮ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দিতে হয়। পে স্কেলে অন্যদের বেতন বেড়েছে। এখন আমাদের এখানেও বেতন বাড়াতে হবে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি বাড়ানো হয়েছে। সেটা না বাড়ালে এদের বেতন-ভাতা কীভাবে দেব? অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তো পে স্কেল দেয়ার দাবিতে কর্মবিরতিতে যাওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। কয়েকটি ধাপে গড়ে ৪৯ শতাংশ বেতন বেড়েছে উল্লেখ করে আবুল হোসেন বলেন, কোন কোন ক্ষেত্রে একটু বেশি বেড়েছে। বাড়ানোর এই হার ভিকারুন নিসা, আইডিয়াল স্কুলের কাছাকাছি। শিক্ষক নিয়োগে কোন অনিয়ম হয়নি বলেও দাবি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের। এদিকে কেবল এই প্রতিষ্ঠানই নয়। পে স্কেলকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর অর্থের বোঝা চাপাচ্ছে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। বিয়াম ফাউন্ডেশন পরিচালিত বিয়াম স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, অগ্রণী স্কুল এ্যান্ড কলেজ, জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাই স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন প্রায় অর্ধেকের বেশি বাড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন অভিভাবকরা। এ নিয়ে আন্দোলনেও প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা। উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর বাবা হুমায়ূন কবীর বলেন, আমার বাচ্চার বেতন চারশ টাকা বাড়ানো হয়েছে। একবারে এতো টাকা না বাড়িয়ে প্রতিবছর বা দুই বছর পরপর দুইশ’ টাকা করে বাড়ালেও তারা পারতেন। নতুন পে স্কেল ঘোষণার পর থেকেই সব কিছুর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। যে কারণে আমাদের ওপর দিন দিন চাপ বাড়ছে। আরেক অভিভাবক শামসুল আলম বলেন, বেতন বাড়ানোর পর আমরা অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি জানিয়েছেন, শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। তাই শিক্ষার্থীদের বেতনও বাড়ানো হয়েছে। ১০ শতাংশ বাড়ালেও তা মেনে নেয়া যেত। কিন্তু যে পরিমাণ বেতন বাড়ানো হয়েছে, এত টাকা অনেক অভিভাবকের পক্ষেই দেয়াটা কষ্টকর। বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ড. উম্মে সালেমা বেগম বলেছেন, আমাদের ১২ জন শিক্ষক মাত্র এমপিওভুক্ত। বাকি শিক্ষকদের বেতন প্রতিষ্ঠান থেকে দিতে হয়। আবার আমাদের প্রতিষ্ঠানে বিষয় বেড়েছে চারটা। এজন্য শিক্ষক বাড়ানো প্রয়োজন। ৬৫টি কম্পিউটার প্রয়োজন। আছে মাত্র ১৫টি। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণী কক্ষ প্রয়োজন ৫৬টি। আছে মাত্র চারটি। তাহলে এত ঘাটতি আমরা কিভাবে পূরণ করব? সে কারণেই শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। এ স্কুলের এক শিক্ষক তাদের নিজেদের দাবি বিষয়ে বলছিলেন, দেখেন সরকারী শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তাই আমরা বলছি আমাদের বেতন বাড়াতে হবে। তবে আমরা শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়াতে বলিনি। ধানম-ির জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থী কমল অভিযোগ করেছেন, এ স্কুলে বাড়ানো হয়েছে পাঁচশ টাকা। এখন দেখার বিষয়, কোন কোন মানুষ পে স্কেলের অধীনে বেতন পাচ্ছে। আমি তো ব্যবসা করি। আমার তো টাকা বাড়েনি। এ অভিভাবক বলেন, আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত প্রতিবাদ দিয়েছি। কিন্তু তারা কোন কথা শুনতে রাজি নন। এভাবে চলতে পারে না। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজে প্রতিটি শ্রেণীতে মাসিক বেতন ১০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের বেতনও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শিগগিরই পরিচালনা কমিটি সভা করে নতুন বেতন নির্ধারণ করবে বলে জানা গেছে। এভাবে রাজধানীর প্রায় প্রতিটি স্কুলেই কম বেশি শিক্ষা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। ভিকারুন নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজে একাদশ শ্রেণীর এক ছাত্রীর অভিভাবক জানান, মাসিক বেতন এক হাজার ৭০০ টাকা, যা প্রতি দুই মাসে এক সঙ্গে আদায় করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ফি দেখিয়ে দু’মাস পরপর আদায় করা হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার টাকা। প্রশ্ন উঠছে বিয়াম স্কুলের কর্মকা- নিয়ে। সরকারী সুযোগ সুবিধা নিয়ে পরিচালিত এ স্কুলের পে স্কেলের সঙ্গে বেতন কেন বাড়ানো হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকরা। জানা গেছে, এখানে মাসিক বেতন দুইশত টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে আছে বেতন বৈষম্য। অন্য অভিভাবকদের সন্তানদের বেতনের তুলনায় অর্ধেক বেতন দিতে হয় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের। এতে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সন্তানদের সঙ্গে অন্যান্য অভিভাবকদের সন্তানদের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অভিভাবকরা। সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলছিলেন, সরকার নতুন পে স্কেল দিয়ে তো বলেনি সরকারী-বেসরকারী সবাইকেই তা কার্যকর করতে হবে। আর স্কুলগুলো যে পরিমাণ বেতন বাড়ায় এর চার ভাগের এক ভাগও শিক্ষকদের পেছনে ব্যয় করে না। আমাদের আওতায় যতটুকু সম্ভব ততটুকু ব্যবস্থা আমরা নেব। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ব্যাপারটা আমরা দেখছি। আর অন্যান্য স্কুলের অভিভাবকদের কাছ থেকে যদি অভিযোগ পাই, তাহলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×