ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হারিছ চৌধুরী অন্তর্ধান রহস্য, ৮ বছরেও হদিস মেলেনি

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

হারিছ চৌধুরী অন্তর্ধান রহস্য, ৮ বছরেও হদিস মেলেনি

শংকর কুমার দে ॥ রহস্যজনক অন্তর্ধানের দীর্ঘ আট বছরেও হদিস নেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে দোর্দ- প্রতাপশালী রাজনীতিক হারিছ চৌধুরীর। বিএনপি চেয়ারপার্সন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া ‘হাওয়া ভবনের’ দেখভাল করতেন তিনি। তিনি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানার আসামি। তার স্থায়ী, বর্তমান ঠিকানাসহ আত্মীয়স্বজনের কাছে খোঁজখবর নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতারি পরোয়ানার ফরমান ফিরে এসেছে। কিন্তু কোথাও হদিস নেই হারিছ চৌধুরীর। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলের ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতার ব্যাপক দাপট দেখিয়ে অবৈধভাবে বিপুল অর্থবিত্ত, সম্পদ করেছেন হারিছ চৌধুরী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ও বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারিছ চৌধুরী গত আট বছর ধরে কোথায় আছেন সবার কাছেই অজানা। রাজনৈতিক অঙ্গনে এত দাপুটে রাজনীতিকের এই ধরনের অন্তর্ধান রহস্য দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আগে ঘটেনি এবং এই ঘটনা নজিরবিহীন। বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, যিনি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গাড়ি কিনেছিলেন, হাতিয়ে নিয়েছেন বিশাল অঙ্কের টাকা তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, দুর্নীতি ও বাড়িতে বন্যপ্রাণী রাখার অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দিয়েছে আদালত। দুর্নীতি দমন কমিশনের এক মামলায় তাকে ৬৯ বছরের জেল দেয়া হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায়ও তার নাম রয়েছে। হারিছ ছিলেন সাধারণ এক গাড়ি ব্যবসায়ী। কিন্তু পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটিপতি হয়ে উঠেছেন তিনি। দেশে এবং বিদেশে প্রচুর অবৈধ টাকা কামিয়েছেন হারিছ। আর এক্ষেত্রে সরকারী ও বেসরকারী খাতে ব্যবসায়ী কন্ট্রাক্টরদের কাজের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায়ও অভিযুক্ত হারিছ। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যুবদলে যোগ দেয়ার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে আরেক ক্ষমতাধর ভবন হিসেবে পরিচিত ‘হাওয়া ভবনে’ নির্বাচনের প্রার্থীদের কাছ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করার দায়িত্ব নেন হারিছ। নির্বাচনের টাকা দিয়ে নিজের এ্যাকাউন্ট সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। আর শান্তিনগর ছেড়ে তার বাসা তৈরি করেছেন অভিজাত এলাকায় বারিধারায়। রহস্যজনক অন্তর্ধানের আগ পর্যন্ত তিনি গুলশানে অবস্থান করতেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠনের পরই খালেদা জিয়ার খুব কাছাকাছি চলে আসেন হারিছ। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হিসেবে। ২০০৮ সালের তদন্তে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বিভিন্ন ব্যাংকে হারিছ চৌধুরীর রয়েছে পঁচিশটি এ্যাকাউন্ট। আর এগুলো করা হয়েছে তার স্ত্রী, ভাই, শ্যালিকা, বোন, পুত্র ও সাবেক সহকারীর নামে। তার ও তার পরিবারের স্বনামে-বেনামে জমা হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হারিছ চৌধুরীর রহস্যজনক অন্তর্ধান রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে চেষ্টায় অভিযুক্ত এই ব্যক্তি এখন কোথায় আছেন তা না বলতে পারে তার দলের লোক, না বলতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কেউ কেউ ধারণা করছেন তিনি ভারতে লুকিয়ে আছেন। আবার কেউ বলছেন তিনি ইউরোপের কোন দেশে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময়টাতেই ভারতের অসম রাজ্যের করিমগঞ্জে পালিয়ে যান হারিছ চৌধুরী। এমন গুজব আর খবরের সত্যতা যাচাই-বাছাইয়ে কেটে গেছে দীর্ঘ আট বছর। হারিছ চৌধুরীর আদি বাড়ি অসমের করিমগঞ্জে। তার আত্মীয়স্বজনের বেশিরভাগই সেখানে। গোয়েন্দা কাজের অংশ হিসেবে সম্প্রতি ভারতের করিমগঞ্জ, শিলচর ও শিলং সফর করে এসেছেন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। অসম সফর করে আসা ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলে তিনি জানান, ভারতে অবস্থানকে সম্ভবত নিরাপদ মনে করেননি হারিছ। আর তাই ইউরোপের কোন দেশে পালিয়ে যেতে পারেন তিনি। এটাই তার ধারণা। ধারণা থেকেই বলা হয়েছে, সম্ভবত যুক্তরাজ্য গেছেন তিনি। সেখানে তার অবৈধভাবে উপার্জিত বিত্তবৈভব, সম্পদের পাহাড়। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা যিনি গোয়েন্দা কাজের অংশ হিসেবে ভারত ঘুরে এসেছেন, তিনি বলেন, তার স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের বক্তব্যে এমন ধারণাও পেয়েছেন যে, হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন না বেঁচে আছেন তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র বলেছেন, হারিছ চৌধুরী সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে এবং তাকে আদালতে হাজির করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশের গ্রেফতারের তালিকায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকান্ডের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানায় অভিযুক্তদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম রয়েছে তার। গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, হারিছ চৌধুরীর অন্তর্ধান রহস্য যেন রূপকথার এক কল্পকাহিনী।
×