ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গীর উৎস খুঁজতে হবে?

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

জঙ্গীর উৎস খুঁজতে হবে?

১৭ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াতপন্থী সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম প্রশ্ন তোলেন, আদালতে আইএস জঙ্গী নামে যে চারজনের বিচার চলছে তারা কারা? অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন আইএস জঙ্গী হিসেবেই তাদের বিচার চলছে। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল ২৩ ডিসেম্বর আলেম-ওলামাদের সমাবেশে বলেছেন, দেশে কোন আইএস জঙ্গী নেই, দেশকে বিশ্বের কাছে জঙ্গীবাদী রাষ্ট্রের খেতাব পাওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে চক্রান্ত চলছে। কয়েকদিন আগে ’৭১-এর টিভিতে এক টকশোতে দেখলাম, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি এবং পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা। অসাম্প্রদায়িক উদারভিত্তিক সমাজ গড়ার শিরোনামের আলোচনায় চেয়ারম্যান সাহেব এক জায়গায় উল্লেখ করেন, জামায়াতের বিভিন্ন নামে ১২০টি সংগঠন আছে অর্থাৎ ১২০টি ছোট-বড় জঙ্গী সংগঠন আছে, যার গডফাদার হলো জামায়াতে ইসলাম। বাংলাদেশে ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে জামায়াতসহ নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয় এবং পরবর্তী সরকারগুলো ক্ষমতার রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ধর্ম ও ধর্মান্ধ দলগুলোকে ব্যবহার করে। সেই থেকে জামায়াত-শিবির নেপথ্যে থেকে বিএনপির ওপর ভর করে দেশে ধর্মান্ধ রাজনীতি ও বিভিন্ন নামে জঙ্গী সংগঠনের জন্ম দেয়। আর জোট সরকারের আমলে ক্ষমতার পার্টনার ও আশীর্বাদ পেয়ে দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটানো হয়। জামায়াতে ইসলামী নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে নাম লেখালেও তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক আচরণ করেনি। জামায়াত এ দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে একদিকে যেমন রগ কাটা, হাতকাটার রাজনীতি থেকে শুরু করে পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ মারার রাজনীতি সূচনা করে। অন্যদিকে আশীর্বাদপুষ্ট জঙ্গী সংগঠনের মাধ্যমে চাপাতির আঘাতে মুক্তমনের মানুষদের হত্যার সংস্কৃতি চালু করে। জামায়াতে ইসলামীর যে মূল লক্ষ্য ইসলামী হুকুমত কায়েম অর্থাৎ আল্লাহ্র শাসন ব্যবস্থা। অপরদিকে জঙ্গী সংগঠনগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম এবং ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচী থাকলেও তাদের লক্ষ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় খোলাফায়ে রাশেদিন কিংবা আল্লাহর শাসন কায়েম। জামায়াতে ইসলামী প্রচলিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও সেটা তাদের লোক দেখানো ভাঁড়ামি। আসল লক্ষ্য অগণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা দখল। জোট আমলের জেএমবিপ্রধান বাংলাভাই (ওরফে সিদ্দিকুর রহমান) ও শায়খ আব্দুর রহমান যথাক্রমে শিবির ক্যাডার এবং জামায়াতের কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য ছিলেন। হরকত-উল-জিহাদপ্রধান মুফতি হান্নান (২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার অভিযোগে আটক) এক সময়ের জামায়াতের লোক ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে আটক আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হামজা ব্রিগেড কিংবা হিযবুত তাহ্রীর মতো জঙ্গী সংগঠনের অধিকাংশ সদস্য অতীতে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার ছিল। গত ২৫ ডিসেম্বর পুলিশ মিরপুরে জঙ্গী অস্ত্রাগারের সন্ধান পায় এবং সেখান থেকে ৩ জন প্রশিক্ষিতসহ ৭ জন জেএমবি জঙ্গীকে গ্রেফতার করে, যারা কারাবন্দী জেএমবির আমির এবং জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের অনুসারী। এবার বাংলাদেশে আইএস জঙ্গীর কর্মকাণ্ড বা অস্তিত্ব আছে কি নেই এ বিষয়ে বলতে গেলে গত দেড় দশকের বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকাইÑ জঙ্গী বা আইএস বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব। ২০০১ সালে জোট সরকারের একটি অংশের সহযোগিতায় এ দেশে জঙ্গী উত্থান ঘটে। তারও আগে বিভিন্ন সময়ে মুফতি আমিনীসহ অন্যান্য ধর্মান্ধ দলের নেতারা ইসলামী বিপ্লবের কথা বলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে টাকা আনে এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ’৭১-এর প্রতিশোধ নিতে বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস ও জঙ্গী উত্থানে একটি বড় ভূমিকা রাখে যা এখনও অব্যাহত। গত মাসে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের সেকেন্ড সেক্রেটারি ফারিনা আরশাদের জঙ্গী অর্থায়ন ও জাল মুদ্রা পাচারে জড়িত থাকাই তার প্রমাণ। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দেশের ধর্মান্ধ দলগুলো ও তাদের সমর্থিত জঙ্গী সংগঠনগুলো দেশের ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি লক্ষ্য রেখে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেছে। যেমন ’৯০-এর দশকে বাংলাদেশ থেকে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য দলে দলে জিহাদী পাঠিয়েছে। আবার ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালেবানী বিপ্লব ঘটলে এসব ধর্মান্ধ দল ও জঙ্গী সংগঠনগুলো ঢাকার মাটিতে অস্ত্র হাতে আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান সেøাগানে মিছিলও করেছিল। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে আমিনী-নিজামী গংদের প্রতিনিধি আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানী শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমর, গুলবদর ও আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে দেখা করার সচিত্র প্রতিবেদনও পত্রিকায় ছাপা হয়। জামায়াতসহ এসব ধর্মান্ধ দল ও জঙ্গী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পথের কাঁটা একমাত্র আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের দলগুলো। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে ’৭১-এর ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হাত দেয়। আর তখন থেকেই জামায়াতসহ ধর্মান্ধ দলগুলো বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে যুদ্ধাপরাধী বিচার বানচালে দীর্ঘ সময় সারাদেশে সহিংস তাণ্ডব চালিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে। পত্রিকার সূত্র মতে, এই সময় তারা সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে নন্দিরহাট, সাতক্ষীরা, চিলিরহাট, রামুতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে এবং একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক, ব্লগার, ভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস ও মতের মানুষ, বিদেশী, মুক্তমনের লেখক ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে দেশকে জঙ্গীবাদী রাষ্ট্রে রূপ দিতে বিভিন্ন ছল-কৌশলের আশ্রয় নেয়। এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালেবান, আল কায়েদাকে ছাড়িয়ে আইএস বিশ্বের কাছে এক ভয়ানক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর দেশীয় জঙ্গী সংগঠনগুলোও আইএসের আনুগত্য স্বীকার করে জঙ্গী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল যখন বাংলাদেশে নিরাপত্তার কারণে আসতে অস্বীকৃতি জানাল, সরকার অভয় দিল। ঠিক তখনই দুই বিদেশী এক ইতালি নাগরিক তাভেলা ও জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাকাণ্ড ঘটে। সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বলে দেশে কোন আইএস জঙ্গী নেই। তার পরই দেখা গেল, আইএসের অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য, আইএস স্টাইলে নৌবাহিনীর ঈশা খাঁ ঘাঁটির দুই মসজিদে জুমার নামাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোমা হামলা, বগুড়ায় শিয়া মসজিদে বোমা হামলা ও মুয়াজ্জিনকে গুলি করে হত্যা, দিনাজপুরের কান্তিজিউর রাসমেলা এবং ইসকন মন্দিরে বোমা হামলা হয়। আর মন্ত্রী মহোদয় যেন এসব হামলা ও হত্যাকাণ্ডকে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইলেন? বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে এর জন্য অবলীলায় ‘র’-এর নাম এসে যেত। যেমনটা জোট আমলে ময়মনসিংহের তিনটি সিনেমা হলে বোমা হামলা হলে তখনকার স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী বাবর সত্যকে আড়াল করতে ভারতের ‘র’ যোগসাজশে হামলার অভিযোগ এনেছিলেন। দোষ না চাপিয়ে দেশীয় জঙ্গী সংগঠন (জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) যাদের অস্তিত্ব আছে তাদের শক্তি কোথায় তার উৎস খোঁজা দরকার। অস্বীকার না করে তাদের সঙ্গে আইএস তালেবান সম্পৃক্ততা অনুসন্ধান দরকার। শত্রুর শক্তি এবং উৎস না জানলে এদের প্রতিহত বা প্রতিরোধে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অতীতে বাংলাদেশেই তার দৃষ্টান্ত রয়েছে। লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী
×