ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

ডিজিটাল প্রভাব ॥ অন্ধ জাতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

ডিজিটাল প্রভাব ॥ অন্ধ জাতি

কয়েক সপ্তাহ আগে ‘আমার দিন’ কলামে ‘অরবিস’ নামের উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতাল নিয়ে লিখেছিলাম। আমার সেই লেখা পড়ে খুব সুন্দর একটি ই-মেইল করেন অরবিসের এশিয়া অঞ্চলের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ডাঃ আবু রায়হান। তারপর তিনি একদিন সদয় হয়ে আমার সঙ্গে কফি খেতে আসেন। কথা হয় অরবিসের সঙ্গে তার দীর্ঘসূত্রতার, জীবনের বড় একটা অংশ অরবিসের সঙ্গে থাকার। ব্যক্তি জীবনে ডাঃ রায়হান একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। লেখাপড়া করেছেন বাংলাদেশে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৯৪ সালে জন হপকিন্স থেকে পাস করার পর অরবিসে যোগ দেন। তখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে অরবিসের অপারেশন চালু করার দায়িত্ব নেন। এই দীর্ঘ সময়ে আমরা অরবিসের যে উড়োজাহাজটি বাংলাদেশের মাটিতে দেখেছি, তার পেছনের মানুষটি হলেন এই ডাঃ আবু রায়হান। বর্তমানে তিনি এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে যেমন- বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, নেপাল, ফিলিপিন্স ও ভিয়েতনামে অরবিসের প্রোগ্রাম দেখাশোনা করেন। যেহেতু চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়া তার অধীনে, জনসংখ্যার হিসাবে তার হাতেই অরবিস ইন্টারন্যাশনালের বড় অপারেশন। কথা হচ্ছিল কিভাবে ছোট একটি প্রতিষ্ঠান সারাবিশ্বের অন্ধত্ব দূর করার কাজে একটি দলকে নিয়োজিত রেখেছে। একটি উড়োজাহাজের ভেতর কিভাবে একটি হাসপাতাল এবং ট্রেনিং সেন্টার তৈরি করেছেন সে গল্প শুনছিলাম এবং তারা বিভিন্ন দেশে কিভাবে প্রযুক্তিকে ট্রান্সফার করে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তাই বিভিন্ন দেশে এখন আর পুরো উড়োজাহাজটি নিয়ে যেতে হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা হাজার হাজার ডাক্তারকে ট্রেনিং দিয়ে ফেলেছেন। পাশাপাশি অনেক প্রযুক্তি এখন সুলভ হয়ে গেছে। উড়োজাহাজে করে সেটাকে নিয়ে যাওয়াটা অনেক সময় বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যায়। তবুও পুরো বিশ্বে অরবিসের আইডিয়া এবং অবদানের জন্য সম্মানিত। আমি আগের লেখাটিতেও বলেছিলাম, অরবিসের সাফল্য হলো যখন তারা তাদের অপারেশনটি বন্ধ করে দিতে পারবে, অর্থাৎ এই পৃথিবী থেকে অন্ধত্ব দূর করা যাবে। (একই যুক্তিতে বলেছিলাম, যখন আমরা আর দরিদ্র থাকব না, সেদিন এই দেশের অনেক এনজিও বন্ধ হয়ে যাবে এবং এটাই তাদের সাফল্য বলে বিবেচিত হবে)। আমার ধারণা ছিল পৃথিবী এগোচ্ছে, এবং পৃথিবী থেকে অন্ধত্ব ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে এবং খুব শীঘ্রই আমাদের এই গ্রহের মানুষ আর অন্ধ হয়ে যাবে না। আমি এমন একটা ভাব নিয়েই রায়হান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের সবচেয়ে বেশি অপারেশন এখন কোথায়? তিনি বললেন, চীনে! আমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে জানতে চাইলাম, জনসংখ্যা বেশি তাই ওখানে অন্ধত্ব বেশি? আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘না, ঠিক তা নয়। চীনের জনগণ নতুন একটি সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল বিস্ফোরণের জন্য ওখানে অন্ধত্ব বাড়ছে।’ আমি হা হয়ে জিজ্ঞাস করি, ‘মানে?’ ডাঃ আবু রায়হান যা বললেন তার সংক্ষেপ হলো, চীন আরও ২০-২৫ বছর আগে থেকেই ডিজিটাল বিশ্বে প্রবেশ করে গেছে। ওখানকার শিশুরা জন্মের পর থেকেই গ্যাজেট ব্যবহার করতে শুরু করে এবং রীতিমতো নেশায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি চীনের এ্যাপার্টমেন্টগুলো দিন দিন ছোট হয়েছে। আর তার সঙ্গে বিপরীতমুখী গতিতে টিভি স্ক্রিনগুলো বড় আকার ধারণ করেছে। ড্রয়িংরুম ছোট হয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে টিভি স্ক্রিনের আকার পাল্লা দিয়ে বড় হয়ে যাওয়ায় মানুষ খুব কাছ থেকে টিভি দেখছে। ফলে তাদের ভেতর অন্ধত্ব বেড়ে গেছে। এখন চীনের শিশুদের চোখে চশমা পরাটা খুবই স্বাভাবিক এবং তারা দূরের বস্তুকে দেখতে পায় না। রায়হান ভাই আমার চোখের রেটিনার ওপর যে ছাউনি ছিল, তার একটি যেন সরিয়ে দিলেন। মনে মনে বললাম, বলে কী! একটি জাতি এত অল্প সময়ের ভেতরই ডিজিটাল যুগের ফল পেতে শুরু করে দিয়েছে! গ্যাজেট, মোবাইল ফোন, টিভি এবং স্ক্রিন পুরো একটি জাতিকে ধীরে ধীরে অন্ধ করে দিচ্ছে? এটা ছিল এই সময়ে আমার জন্য সবচেয়ে বড় শকিং নিউজ। দুই. মানুষের অন্ধত্বের সঙ্গে অর্থনীতির একটি চরম যোগসূত্র আছে। সেটা চোখের অন্ধত্বের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত, মনের অন্ধত্বের সঙ্গেও সেটা সম্পর্কিত। চোখের অন্ধত্ব আমরা দেখতে পাই, মনেরটা দেখতে পাই না। তবে প্রভাব একই রকম। একটি দেশে যদি শতকরা ১০ ভাগ মানুষ দেখতে না পান, তার অর্থ হলো এই মানুষগুলো স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে পারেন না। আমাদের মতো দেশগুলো এখনও এমন উন্নত হয়ে যায়নি যে, অন্ধ মানুষের জন্য বিশেষ কাজের জায়গা তৈরি করে দেবে। আমরা যদি ধরি, বাংলাদেশে ১০ কোটি মানুষ কাজ করে, উপার্জন করে এবং অর্থনীতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে; সেখানে যদি এক কোটি মানুষ অন্ধ থাকে তাহলে তারা তেমন কোন ভূমিকা পালন করতে পারছেন না। তারা কৃষিকাজ, ফ্যাক্টরি কিংবা গাড়ি চালানো নয় তো অন্য কোন কাজ করতে পারেন না শুধু তাদের চোখে দৃষ্টি নেই বলে। একবার ঠা-া মাথায় চিন্তা করে দেখুন তো, আপনার চোখ দুটোতে দৃষ্টি নেই, কেমন হবে আপনার পৃথিবী এবং কাজের পরিধি? আপনি পর মুহূর্তেই হয়ে যাচ্ছেন অন্যের ওপর নির্ভরশীল। একইভাবে একটি নতুন জেনারেশন যদি হয় অন্ধ, কিংবা দেখতে সমস্যা হয় (চশমা ব্যবহার করতে হয়), তখন তাদের কর্মদক্ষতা কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এমনকি স্কুলে যে ছাত্রছাত্রীকে ছোটবেলা থেকেই চশমা পরতে হয়, তাকে কিন্তু অনেক কিছুতেই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। যেমন, অন্যরা তাকে ফুটবল খেলতে নাও নিতে পারে, তাকে হয়ত ক্রিকেটে নেবে না, তাকে দৌড়াতে হলে সমস্যা হবে, চোখ থেকে চশমা পড়ে গেলে দুনিয়া অন্ধকার। তাকে চ্যালেঞ্জিং দলে কম নেয়া হবে। এটাই স্বাভাবিক। ভারতে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সঠিক অপারেশন করার পর শতকরা ৮৫ ভাগ পুরুষ এবং ৫৮ ভাগ নারী দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার পর কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছেন এবং তাদের চোখের অপারেশন করতে যত টাকা খরচ হয়েছিল পরের বছরেই অর্থনৈতিক রিটার্ন ছিল ১,৫০০%। কোটি কোটি মানুষ যদি অন্ধ থাকে, তাহলে সেই জনগোষ্ঠীকে পালন করতে একটি বিশাল অঙ্কের টাকা সারাজীবনের জন্য খরচ করতে হয়। সেজন্য অন্ধত্বটুকু দূর করে দিতে পারলে সেই মানুষটি বাকি জীবনের জন্য তার জীবনকে ফিরে পেল। বাংলাদেশে এই নিয়ে সঠিক গবেষণা নেই। তবে অনুমান করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ লাখের বেশি মানুষ অন্ধ রয়েছেন এবং প্রায় ৪০ হাজারের মতো শিশু অন্ধত্ব বরণ করেছে। ডাঃ রায়হান আমাকে জানালেন, এই মানুষগুলোর জন্য বছরে আমাদের প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে এবং এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে তাদের জীবদ্দশায় দেশের ক্ষতি হবে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার), যা কিনা পদ্মা সেতুর বাজেটের প্রায় সমান। কিন্তু এই পুরো গোষ্ঠীকে অন্ধত্ব দূর করতে আমাদের খরচ হতে পারে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। মানিকগঞ্জে অরবিস একটি গবেষণা করে দেখেছে যে, তারা যখন ওই এলাকার মানুষের ক্যাটারেক্ট অন্ধত্ব দূর করে দিলেন তার পরের বছরই তাদের অর্থনৈতিক রিটার্ন ছিল ১,০০০%-এর বেশি। আমরা চাইলেই হয়ত এই ৩৫০ কোটি টাকা ৪-৫ বছরের মধ্যে বিনিয়োগ করে দেশ থেকে পুরো অন্ধত্ব দূর করতে পারতাম। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন আমাদের মনের অন্ধত্ব দূর করা। তিন. অতিরিক্ত মাত্রায় স্ক্রিন ব্যবহারের ফলে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি (বিশেষ করে দূরের জিনিস দেখতে না পাওয়া) যে কমে যায় সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। এর মূল কারণটি হলো- দীর্ঘ সময় কাছের জিনিসের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখের ফোকাস কাছের জিনিসের ওপর চলে আসে এবং দূরের বিষয়বস্তু দেখার জন্য যে পেশীশক্তি এ্যাডজাস্টমেন্ট প্রয়োজন হয় চোখ তা হারিয়ে ফেলে। ফলে দূরের বিষয়কে চোখ আর ফোকাস করতে পারে না। তখনই চশমার প্রয়োজন দেখা দেয়। মানুষের বার্ধক্যজনিত সময়ে এই সমস্যা হওয়ার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত গ্যাজেট ব্যবহারে শিশুকালেই এটা হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি একটু আমাদের চারপাশের বাচ্চাদের দিকে তাকাই তাহলে দেখা যাবে তারা স্মার্টফোন, নয়ত ট্যাবলেট, নয়ত পে-স্টেশন কিংবা কম্পিউটার নিয়ে খেলছে। এমনকি বাংলাদেশেও এর প্রবণতা অসম্ভব আকারে বেড়েছে। শিশুদের জন্য যেহেতু বাইরে খেলাধুলা করার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ নেই, তাই ভার্চ্যুয়াল দুনিয়াতেই তাদের জীবন। আর সেই ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ার স্বাদ নেয়ার প্রধান মাধ্যম হলো চোখ। আমরা যত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছি, তত বেশি চোখটা নষ্ট করার দিকে এগোচ্ছি। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, যে সকল শিশু বেশি বেশি গ্যাজেট ব্যবহার করে তাদের ড্রাই আই হয়ে থাকে। লম্বা সময় ধরে ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট ব্যবহারের ফলে চোখের কর্নিয়া শুকিয়ে যেতে পারে। আর দূরদৃষ্টি হারানো তো হচ্ছেই। বর্তমান চীনে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী দিনে গড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিন ব্যবহার করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলের শতকরা ৬০ ভাগ ছেলেমেয়ে দূরের বিষয় দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, যে কারণে চীনে দেখা যায়, হাজার হাজার শিশু এখন চশমা পরছে। তাই স্ক্রিন ব্যবহারে নিয়ম আনার কথা বলছে পুরো বিশ্ব। আপনার সন্তান ফেসবুক ব্যবহার করুক কিংবা গেম খেলুক, নয়ত ভিডিও দেখুকÑ যাই করুক না কেন, তার জন্য সময় বেঁধে দেয়াটার মূল কারণ হলো তার স্বাস্থ্যগত। তার চোখটাই যদি চলে যায়, তাহলে সারাটা জীবন তাকে একটি ভিন্ন ধরনের জীবনযাপন করতে হবে। পাশাপাশি ২০১৫ সালেই ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল ছাত্রছাত্রী দিনে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে স্ক্রিন টাইম ব্যবহার করেছে (ট্যাবলেট, টিভি, স্মার্টফোন ইত্যাদি) তাদের পরীক্ষার ফল অন্যদের থেকে খারাপ হয়েছে। এমনকি যে সকল ছাত্রছাত্রী অনেক বেশি লেখাপড়া করেছে এবং পাশাপাশি অনেক বেশি স্ক্রিন টাইম ব্যবহার করেছে তাদেরও পরীক্ষার ফল খারাপ হয়েছে। অনেক মা-বাবা মনে করেন, তাদের ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করবে, এটা স্মার্টনেসের স্বাক্ষর। কিন্তু তাদের প্রশ্ন করা উচিত, কতটা সময় একটি বাচ্চা স্ক্রিন টাইম পেতে পারে? বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন রকমের নিয়ম এবং পরামর্শ দিয়েছে। আমেরিকার স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, দু’বছর বয়সের নিচের বাচ্চাদের স্ক্রিনের সামনে যাওয়াই সঠিক নয় এবং পরবর্তীতে শিশুদের সারাদিনে সব মিলিয়ে দুই ঘণ্টার বেশি স্ক্রিন টাইম থাকা ঠিক নয়। ফ্রান্স সরকার তিন বছরের নিচে শিশুদের বাসার ডিজিটাল টেরিস্ট্রিয়াল টিভি ব্যান্ড করে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডাতেও একই রকম নিয়ম। তাইওয়ানের সরকার আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে। তারা তাদের শিশুদের ভবিষ্যত ঠিক রাখার জন্য মা-বাবার প্রতি নির্দেশনা জারি করেছে। তারা আইনগতভাবে সন্তানদের স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য। ১৮ বছরের নিচের সন্তানরা যদি অতিরিক্ত সময় ধরে স্ক্রিন ব্যবহার করে তার জন্য তার মা-বাবাকে সরকার জরিমানা করতে পারে। নিজেদের সন্তানদের বাঁচানোর জন্য এখন চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়াও একই নিয়মে আসতে শুরু করেছে। একদিকে আমরা যেমন ডিজিটাল যুগে প্রবেশের জন্য চেষ্টা করছি, আরেকদিকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের তৈরি করারও সময় এসেছে। চার. বাচ্চাদের স্ক্রিন টাইম নিয়ে চিন্তিত নয় এমন মা-বাবা হয়ত এখন পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে শহরের মা-বাবাদের জন্য এটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ বললে অতিরিক্ত বলা হবে না। সবাই নিশ্চয়ই চাইছেন কিভাবে এটাকে ম্যানেজ করা যায়। বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালে অনেক রকমের পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে। ‘আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স’ বেশকিছু বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে। আমি ওখান থেকে পাঁচটি বিষয় তুলে দিচ্ছি। ক. রোল মডেল হওয়া ॥ সবচেয়ে প্রথমেই যে বিষয়টি বলা হয়েছে তা হলো বাচ্চাদের সঙ্গে ইনভলব হওয়া এবং তাদের রোল মডেল হওয়া। আপনি যদি সারাক্ষণ স্ক্রিন টাইম নিয়ে থাকেন (টিভি দেখা, ট্যাবলেট ব্যবহার করা, ফোনে থাকা) তাহলে ছেলেমেয়েরাও সেটা করতে গেলে বাধা দিলে শুনবে কেন? বাচ্চাদের স্ক্রিন টাইমের সময় বেঁধে দিন। নিজেও স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিয়ে ফেস টাইম বাড়িয়ে দিন। তাদের সঙ্গে আড্ডা মারুন, কথা বলুন, তাদের সঙ্গে নিয়ে স্ক্রিন ব্যবহার করুন (একসঙ্গে মুভি দেখা কিংবা ইন্টারনেটে ভিডিও দেখা ইত্যাদি)। তাতে বাচ্চাদের নিজেদের স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং তারা এটার প্রতি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে না। খ. একে অপরের কাছ থেকে শেখা ॥ অনেক সময় দেখা যায় মা-বাবারা বাচ্চাদের শেখার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভিডিও ছেড়ে দেন। বিশেষ করে ভাষা শেখার ক্ষেত্রে এটা ঠিক কাজ করে না বরং নিজেদের ভেতর কথা বললে সেটা অনেক বেশি কার্যকরী। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ‘প্যাসিভ ভিডিও লার্নিং’ কোন কাজে আসে না। দ্বিপাক্ষিক ভাবের আদান-প্রদান অনেক বেশি কার্যকরী। তাই স্ক্রিনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজেরা ইন্টারএ্যাক্টিভ হোন। গ. মানসম্মত কন্টেন্ট ॥ বাচ্চাদের স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করলেন ঠিকই, কিন্তু ওরা ঠিক কী কন্টেন্ট দেখছে তার দিকে নজর রাখলেন নাÑ তাহলে লাভ নেই। মানসম্মত কন্টেন্ট অনেক বেশি জরুরী। তাই ওদের স্ক্রিন টাইমের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি মানসম্মত কন্টেন্ট যেন পায় সেদিকেও নজর দেয়াটা প্রয়োজন। ঘ. সামাজিকভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করা ॥ বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায় যে, শিশুরা নিজেদের মতো কোন একটা স্ক্রিনে ব্যস্ত। হয়ত স্মার্টফোনে ‘এ্যাংরি বার্ড’ খেলছে, নয়ত অন্য কোন গেম। একা একা এভাবে ছেড়ে না দিয়ে সবাই মিলে খেলা যায় এমন কিছুতে প্রযুক্তি ব্যবহার করাটা ভাল। ছোট মোবাইল ফোনে একা একা গেম খেলার চেয়ে বড়পর্দায় সবাই মিলে পারিবারিকভাবে একটি গেম খেলা অনেক বেশি ভাল। এতে সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। ঙ. বাচ্চাদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ॥ বর্তমান সময়ের অনেক বাচ্চাই ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতে যুক্ত হচ্ছে। এটা দেয়া যেতে পারে। তবে সেখানে মা-বাবাকেও যুক্ত হতে হবে। তাদের বুঝতে দিতে হবে, বাস্তবের যোগাযোগ এবং ফেসবুকের যোগাযোগ একই রকম। ওখানে কিভাবে যোগাযোগ করতে হয়, কিভাবে মন্তব্য লিখতে হয়, কিভাবে ভদ্রতা বজায় রাখতে হয় ইত্যাদি বিষয় শিখিয়ে দেয়া যেতে পারে। এখানে বলে রাখা ভাল যে, উপরের সব বিষয় আমি নিজেও যে করতে পারি তা কিন্তু নয়। নিজেকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই বিষয়গুলো লিখে রাখলাম। বর্তমান সময়টা খুবই দ্রুত পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সকল পিতা-মাতা দৌড়ে পেরে উঠছেন না। তাই অনেকেই হয়ত দৌড়ানো বন্ধই করে দিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো যা ইচ্ছা তাই করছে। কিন্তু চীন তাদের ফল এখন পেতে শুরু করেছে। তখন তাদের কেউ গাইড করেনি; পুরো একটি জেনারেশন প্রায় অন্ধ হতে বসেছে। আমাদের সময় এসেছে চীনের এই শিক্ষা থেকে কাজে লাগানো। আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে গেছি। আপনার শিশুকে অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করুন, তাতে পুরো জাতিটা অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পাবে। ৯ জানুয়ারি ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×