ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাঙ্গাতে চান বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত চেক

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জাদুধনের শেষ স্মৃতি ধরে রাখার সংগ্রাম, ক্লান্ত বাবা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১০ জানুয়ারি ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ জাদুধনের শেষ স্মৃতি ধরে রাখার সংগ্রাম, ক্লান্ত বাবা

মোরসালিন মিজান ॥ হয়ত বা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/ বড় বড় লোকেদের ভিড়ে, জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/ তোমাদের কথা কেউ কবে না...। সত্যি কেউ আর বলেন না আবদুল বারেকের কথা। তরুণ মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে ঘর ছেড়েছিলেন। প্রিয় পিতা, মাতা, বোনকে রেখে লড়াইয়ের ময়দানে সিনা টান করে দাঁড়িয়েছিলেন। আর ফেরেননি। কিন্তু দেশটা ঠিকই স্বাধীন হয়েছে। ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন- ভেবেছিলে দেশতো স্বাধীন আছে ওরা বেশ...। কিন্তু না, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পিতা আবদুল গফুর বেশ নেই। ভাল নেই। এই দেশে শহীদ সন্তানের বৃদ্ধ পিতা কেন ভাল থাকবেন না? কেন কেঁদে বুক ভাসাতে হবে? জবাব দেবার কেউ নেই। আর তাই দীর্ঘ ৪২ বছর পর শহীদ সন্তানের শেষ স্মৃতিচিহ্ন বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত চেক ভাঙাতে চান শহীদ সন্তানের পিতা। বিনিময়ে তাঁর নিজের চিকিৎসা হবে। বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত হবে স্ত্রী-সন্তানদের। ইতিহাসটির খোঁজ করতে গিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালে টগবগে তরুণ আবদুল বারেখ। এইচএসসির ছাত্র। ময়মনসিংহের গফরগাঁও কলেজে পড়েন। যথেষ্ট রাজনৈতিক সচেতন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা আরও অনেকের মতো তাঁর রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। কিন্তু বারেক তখন বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। ছোট এক বোন। যুদ্ধে গেলে প্রিয় পরিবারের কী হবে? এমন প্রশ্ন ওঠেছিল। তবে, দেশপ্রেমের কাছে তা আর টেকেনি। ভরসা ছিল দেশ স্বাধীন হবে। স্বাধীন দেশে নিজে না ফিরলেও, বাবা মাকে দেখার লোকের অভাব হবে না। বাবাও দেশের জন্য সন্তানকে সপে দিয়েছিলেন। সহযোদ্ধা রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে জানান, তিনি ও বারেক ছিলেন মুজিব বাহিনীর সদস্য। ভারতের মেঘালয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন তাঁরা। তার পর পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়তে দেশে ফেরেন। ময়মনসিংহ এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ করেন গুরুত্ব দিয়ে। ৫ থানায় মুজিব বাহিনীর কমিটি গঠন করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। ১৫ আগস্ট রেজাউল বারেকসহ মুজিব বাহিনীর ৫ সদস্য ধরা পরেন পাকিস্তান বাহিনীর হাতে। শুরু হয় নির্যাতন। এক পর্যায়ে পাক আর্মি নিশ্চিত হয় বারেক সম্পর্কে। অন্যদের কাছ থেকে তাঁকে আলাদা করে নিয়ে যায়। চলে নির্যাতন। সহযোদ্ধারা কোন রকমে বেঁচে আসতে পারলেও, বারেক আলাদা হয়ে গিয়েছিল চিরতরে। এদিকে, পুত্র যুদ্ধে গেছে এমন খবরে চরমছলন্দ গ্রামে ঢুকে বারেকদের বাড়ি-ঘরে আগুন দেয় পাক আর্মি। বাবা আবদুল গফুর খান স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে অন্য গ্রামে পালিয়ে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার যখন ফিরে আসেন, আর কিছু অবশিষ্ট নেই। শূণ্য ভিটায় দাঁড়িয়ে একটিই চাওয়া ছিল- ছেলে যুদ্ধ থেকে ফিরবে। ছেলে ফিরলে অপূর্ণতা থাকবে না। সব পাওয়া হয়ে যাবে তাঁর। স্বাধীনতার পর সবাই ফিরে আসে। ছেলে আর আসে না। দুঃসংবাদটি নিয়ে আসেন রেজাউল করিম। পুত্র হারানোর খবর জেনে শিশুর মতো কাঁদেন বাবা। কান্নার তখন মূলত শুরু। আজও তাঁর সম্বল চোখের জল। কেউ এই জল দেখেনি। দেখে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতার পর আবারও গফরগাঁওয়ের চরমছলন্দ গ্রামে ফিরে আসেন গফুর খান। পুত্রহারা-সহায়সম্বলহীন অবস্থায় নতুন করে শুরু করেন। নিজের সামান্য জমি। সেখানে চাষবাষের কাজ করেন। কোন রকমে চলে জীবন। এই অবস্থায় ১৯৭৩ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বারেকের ত্যাগের কথা স্বীকার করে শহীদ পিতাকে পত্র লেখেন জাতির জনক। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, শহীদের এই পিতার নামে ২০০০ টাকার একটি চেক পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যান তহবিল থেকে ইস্যু করা চেক সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের কাছ থেকে গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে। তখন এই টাকার অনেক মূল্য। প্রয়োজনও খুব। কিন্তু আবদুল গফুর চেক গ্রহণ করেন না। নগদ অর্থ গ্রহণের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠিটিকে পুত্রের স্মৃতি হিসেবে রেখে দেন। এভাবে দীর্ঘ ৪২ বছর। বহু অর্থ কষ্টের মধ্য দিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সিলমোহর দেয়া চিঠি তিনি নষ্ট হতে দেননি। অথচ এখন এতকাল পর সেই চিঠি তিনি আর সংরক্ষণ করতে পারছেন না। সেই ক্ষমতা তাঁর নেই। তিনি ছেলের স্মৃতিচিহ্ন বিসর্জন দিয়ে চেকের বিপরীতে ২০০০ টাকা গ্রহণে আগ্রহী। কেন? জানতে ফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বয়স এখন প্রায় ৯০ বছর। শ্রবণ শক্তি হারিয়েছেন প্রায়। এর পরও কোন রকমে কথা বলা। কিন্তু কথা তিনি বলতে পারেন না। একটি দুটি কথা মুখ থেকে বের হয় বটে। কান্নার শব্দে তা তলিয়ে যায়। এর পরও যেটুকু শোনা তার অনুবাদ- আমার ঘর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। আমার কাছে আমার জাদুধনের কোন স্মৃতি নেই। কবরের খোঁজও কেউ দিতে পারেনি। আমি বঙ্গবন্ধুর চিঠিটিকে তাঁর একমাত্র স্মৃতি করে রেখেছিলাম। আমার যতক্ষণ সাধ্য ছিল, চেক ভাঙাতে যাইনি। আজ আমি অপরাগ...। বহু দূরের রাজধানী শহরে বসেও এই বেদনা অনুভব করা যায়। শহীদ সন্তানের বৃদ্ধ পিতা কাঁদছেন। কেমন অপরাধী মনে হয় নিজেকে। আবদুল গফুরের বাকি কথাগুলো পরে এই প্রতিবেদককে জানান স্বাধীনতার পর জন্ম নেয়া তাঁর দ্বিতীয় ছেলে। তিনি ছাড়াও এখন তাঁর আরও ৫ বোন। মা-ও জীবিত। বড় পরিবারের বোঝা যতদিন সম্ভব, আবদুল বারেক বহন করেছেন। এখন তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ। বেশ কয়েক বছর ধরে হুইল চেয়ারে। বৃদ্ধা মা-ও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। এ অবস্থায় সংসার দেখার দ্বায়িত্ব পরেছে ছেলের উপর। ছেলে বাবার কৃষি কাজ দেখেন। সাধারণ এই কৃষকের যা আয়, তাতে নিজের সংসারও চলে না। এর পরও বাবা মাকে দেখেছেন। এখন আর পেরে ওঠছেন না। ছেলেও ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ছেলের অসহায়ত্ব অনুমান করতে পেরে একটি উপায় খুঁজছিলেন বাবা। সেই উপায়টি- শেষ সম্বল ব্যাংকের চেক ভাঙানো! কিন্তু এতকাল পরে তো এই চেক কোন কাজে আসবে না। তাছাড়া মাত্র ২০০০ টাকার চেক। কী হবে ও দিয়ে? জানতে চাইলে বারেকের অসহায় বাবা কোন উত্তর করতে পারেন না। আবারও শোনা যায় কান্নার শব্দ। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া একজন বাবা, ৯০ বছররের বৃদ্ধ কাঁদছেন। অঝোর ধারায় কাঁদছেন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, তুমি শুনছ কি?
×