ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বঙ্গোপসাগরে ফের ভাগ বসাতে চায় মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১০ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গোপসাগরে ফের ভাগ বসাতে চায় মিয়ানমার

তৌহিদুর রহমান ॥ বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরও সেটা মানতে চাইছে না মিয়ানমার। দেশটি আবারও সমুদ্রসীমানায় বাংলাদেশ ও ভারতের একটি অংশ দাবি করেছে। তবে মিয়ানমারের দাবিকে অযৌক্তিক বলেছে বাংলাদেশ। কেননা আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পরে তারা কোনভাবেই এই অংশ দাবি করতে পারে না। মিয়ানমারের দাবির বিপক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানায়। জাতিসংঘের মহীসোপানের সীমানা নির্ধারণ বিষয়ক কমিশনের (সিএলসিএস) কাছে মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপানের অংশ দাবি করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সিএলসিএস’র কাছে চিঠি দিয়ে মিয়ানমার মহীসোপানের অংশ দাবি করে। তবে মিয়ানমারের দাবি প্রত্যাখ্যানের জন্য ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের কাছে পাল্টা চিঠি দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম এ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার এ্যাডমিরাল (অব) খুরশিদ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে মহীসোপানের অংশ দাবি করছে। তবে মিয়ানমারের এই দাবি পুরোপুরি অযৌক্তিক। সবারই আদালতের রায় মেনে চলা উচিত। সেটাই নিয়ম। মিয়ানমারের দাবির বিপক্ষে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরে জাতিসংঘের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। জাতিসংঘের সিএলসিএস’র ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা আইনবিষয়ক সনদের অষ্টম অনুচ্ছেদের ৭৬তম ধারা অনুসরণ করে বঙ্গোপসাগরে মহীসোপানের অংশ দাবি করে মিয়ানমার। এ বিষয়ে সিএলসিএস’র কাছে নানা তথ্য উপাত্তও জমা দেয় মিয়ানমার। এরই মধ্যে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে যায়। এই সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির পরে বাংলাদেশ প্রত্যাশা করেছিল, সমুদ্রসীমানা সংক্রান্ত সমস্যাটি মিটে গেছে। এখন আর এটি নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। তবে মিয়ানমার গত নবেম্বর মাসে সিএলসিএস’র কাছে একটি সংশোধিত প্রস্তাব জমা দেয়। এই সংশোধিত প্রস্তাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপানের অংশ দাবি করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে মিয়ানমার যখন প্রথমে সিএলসিএস’র কাছে মহীসোপান দাবি করে, তখনই প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। এরপর বাংলাদেশ ২০১১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তথ্য উপাত্ত সহকারে মহীসোপানের অংশ দাবি করে বাংলাদেশ। সিএলসিএস’র তালিকায় ১৬ নম্বরে রয়েছে মিয়ানমারের আবেদন। বাংলাদেশের আবেদন রয়েছে তালিকার ৫৫ নম্বরে। সিএলসিএস’র কাছে বর্তমানে ৭৭টি দেশের সমুদ্রসীমানায় মহীসোপানের বিরোধ নিষ্পত্তির আবেদন রয়েছে। এসব আবেদন পর্যায়ক্রমে নিষ্পত্তি হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের কাছে এখন যে পাল্টা চিঠি দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধ একটি মীমাংসিত বিষয়। জার্মানির ইটলস ও নেদারল্যান্ডসের সালিশী আদালত যে রায় দিয়েছে সেখানেই উল্লেখ করা হয়েছে, কোন দেশের মহীসোপান কতটুকু হবে। এছাড়া ওই দুই আদালতে আপীলেরও কোন সুযোগ নেই। এখন মিয়ানমার সংশোধিত প্রস্তাব দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় উপেক্ষা করতে চাইছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। সে কারণে আন্তর্জাতিক আদালতের দুইটি রায় বিবেচনা করবে জাতিসংঘের সিএলসিএস। আর ওই দুই রায় বিবেচনা করলেই বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপানের পক্ষেই মতামত আসবে বলে আশা করছে এই দুই দেশ। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সিএলসিএসর কাছে যখন মিয়ানমার আবেদন করে, সেই সময়ের মধ্যেই বাংলাদেশ জার্মানির হামবুর্গে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) মামলা করে। ২০০৯ সালে মামলার পরে তিন বছর সেখানে মামলা চলে। এরপর ২০১২ সালে ইটলস রায় প্রকাশ করে। সে মামলার রায়ের পর সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়ে যায়। তবে আন্তর্জাতিক আদালতের সেই রায় উপেক্ষা করে মিয়ানমার এখন আবারও মহীসোপানের অংশ দাবি করছে। এদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে ইটলসে যখন মামলা করা হয়, ঠিক একই সময়ে নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক সালিশী আদালতে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির জন্য মামলা করে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশী আদালত ওই মামলার রায় প্রকাশ করে। ফলে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়ে যায়। সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল পেয়েছে। এছাড়া সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকারও পেয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার এখন যে মহীসোপান দাবি করছে, সেটা অবশ্য বাংলাদেশের ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে। তবে দেশটির সংশোধিত দাবিকৃত মহীসোপানের একটি অংশ বাংলাদেশের। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের দাবি করা মহীসোপানের মধ্যে ভারতের অংশও রয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মহীসোপানের সীমানায় মিয়ানমার তাদের অংশ দাবি করছে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের আমলে সর্ব প্রথম দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধনিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। তখন দ্বিপক্ষীয়ভিত্তিতে আলোচনাও হয়। পরে এ বিষয়ে আর কোন অগ্রগতি না হওয়ায় বিরোধ থেকেই যায়। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হয়। তখন প্রতিবেশী দুই দেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০৯ সালে অত্যাধুনিক সিসমিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালের ১০ মার্চের মধ্যেই সমুদ্র নিয়ে প্রয়োজনীয় সিসমিক ও ব্যথম্যাট্রিক জরিপের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের জরিপ ছিল সেটাই প্রথম। অবশেষে ওই জরিপের তথ্যের ভিত্তিতেই জার্মানির ইটলসে ও নেদারল্যান্ডসের আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয় বাংলাদেশ। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলায় জয়লাভ করে। আর ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ভারতের সঙ্গে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। প্রতিবেশী তিন দেশের সঙ্গে সীমানা নিষ্পত্তির পরেও এখন নতুন করে সমুদ্রের অংশ দাবি করছে মিয়ানমার।
×