ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইব্রাহিম নোমান

ঘড়ি উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

ঘড়ি উৎসব

আকাশে পাখি ওড়ে, দূর আকাশে মেঘ ওড়ে, মানুষের মনও ওড়ে। মানুষ আকাশে উড়তে পারে না। কিন্তু ঘুড়ি উড়িয়ে আকাশে ওড়ার আনন্দ পায় মানুষ। হট এয়ার বেলুন, জ্যাপলিন, গ্যাস বেলুন, উড়োজাহাজ, গাইরো প্লেন, গ্লাইন্ডার, হেলিকপ্টার, রকেট সবই মানুষ তৈরি করেছে আকাশ জয়ের নেশায়। সেই নেশার, অন্যতম রূপ হচ্ছে ঘুড়ি। সুতা টেনে আকাশে ওড়ানো হয় ঘুড়ি। পাতলা কাগজের সঙ্গে চিকন কঞ্চি লাগিয়ে সাধারণত ঘুড়ি তৈরি করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন উপাদান ও নকশার ঘুড়ি রয়েছে। বিশ্বজুড়েই ঘুড়ি ওড়ানো একটি মজার খেলা। বহু দেশে ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে ঘুড়ি ওড়ানো একটি আনন্দদায়ক অবসর বিনোদন। বাংলাদেশে, বিশেষ করে পৌষ সংক্রান্তির দিন বাঙালিরা দিনব্যাপী ঘুড়ি উড়ায়। এইদিন ঘুড়ি উড়ানোর জন্য তারা আগে থেকেই ঘুড়ি বানিয়ে এবং সুতায় মাঞ্জা দিয়ে প্রস্তুতি নেয়। ঘুড়ি উৎসব বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব। মুঘল আমল থেকে এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এই দিন বাঙালিরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে হরেক রকমের পিঠা তৈরি, ঘুড়ি উড়ানো অন্যতম। সারাদিন ঘুড়ি উড়ানোর পরে সন্ধ্যায় পটকা ফুটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে উৎসবের সমাপ্তি টানা হয়। উৎসবে প্রচুর লোক সমাগম ঘটে। পুরনো ঢাকার অধিবাসীদের কাছে এটি অত্যন্ত উৎসবমুখর দিন যা সাধারণত এই মৌসুমে আয়োজন করা হয়। পুরান ঢাকায় পৌষ সংক্রান্তি সাকরাইন নামে পরিচিত। এসময় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বাউল গানের আসরও বসে। পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি বাঙালি সংস্কৃতিতে একটি বিশেষ উৎসবের দিন। বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিন এই উৎসব পালন করা হয়। নামকরণ বিভিন্ন দেশে ঘুড়ির বিভিন্ন রকম নামকরণ করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ঘুড়ির নিম্নবর্ণিত নামগুলো রয়েছে- চারকোণা আকৃতির বাংলা ঘুড়ি, ড্রাগন, বক্স, মাছরাঙা, ঈগল, ডলফিন, অক্টোপাস, সাপ, ব্যাড়, মৌচাক, কামরাঙা, আগুন পাখি, প্যাঁচা, ফিনিক্স, জেমিনি, চরকি লেজ, পাল তোলা জাহাজ, জাতীয় পতাকা প্রমুখ। উৎসব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় উৎসব। নেপালে এই দিবসটি মাঘী নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান্ত, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান্ত নামে উদযাপিত হয়। অবশ্য দেশ ভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরনে থাকে পার্থক্য। ইতিহাস ধারণা করা হয় যে, প্রায় ২৮০০ বছর পূর্বে চীন দেশে ঘুড়ির সর্বপ্রথম ঘুড়ির উৎপত্তি ঘটেছে। পরবর্তীকালে এটি এশিয়ার অন্যান্য দেশ- ভারত, জাপান এবং কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ইউরোপে ঘুড়ি খেলাটির প্রচলন ঘটে প্রায় ১৬০০ বছর পূর্বে। প্রথমদিকে ঘুড়ি কাগজ অথবা হাল্কা তন্তুজাতীয় সিল্কের কাপড় দিয়ে উড়ানো হতো। ব্যবহৃত নানা উপাদানের অংশ হিসেবে ঘুড়িতে বাঁশের কঞ্চি কিংবা অন্যান্য শক্ত অথচ নমনীয় কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। এছাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সুতা কিংবা পাতলা দড়ি ব্যবহৃত হয়। আধুনিককালের ঘুড়িগুলোয় সিনথেটিক জাতীয় পদার্থের প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত। কোনটি আকারে খুব বড় ও দেখতে নয়ন মনোহর। আবার কোনটি আকারে খুবই ছোট যা দ্রুত উড়তে কিংবা প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঘুড়ির কাগজ ঘুড়ির কাগজ সাধারণত হয় বেশ পাতলা, যাতে ঘুড়ি হয় হালকা এবং বাতাসে ভাসার উপযোগী। অনেক দেশেই ঘুড়ি বানানোর জন্য সাদা কাগজের পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রঙিন কাগজ ব্যবহারের রীতি দেখা যায় এবং এর মূল কারণ মনোরঞ্জন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি। মাঞ্জা অন্য ঘুড়ির সুতা কাটার উদ্দেশ্য কাচের গুঁড়া, আঠা ইত্যাদি মিশ্রিত বিশেষ মসলা যা সুতায় মাখিয়ে রোদে শুকানো হয়। ঘুড়ির লড়াই ঘুড়ি কাটাকাটির লড়াই সারা বছর দেখা গেলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান প্রভৃতি ভারতবর্ষীয় অঞ্চলগুলোতে ঘুড়ি উড়ানোর বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ঘুড়ির লড়াইয়ে সাধারণত একাধিক লড়াকু মাঞ্জা দেয়া সুতা দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে একজন আরেকজনের ঘুড়িকে টানে অথবা ছেড়ে (ঢিল পদ্ধতিতে) কাটার চেষ্টা করেন। বিজয়ী ঘুড়ি আকাশে উড়তে থাকে আর হেরে যাওয়া অর্থাৎ কেটে যাওয়া ঘুড়ি বাতাসে দুলতে দুলতে মাটিতে নেমে আসে। তখন ঘুড়ি কুড়িয়ে নেয়ার আনন্দই আলাদা।
×