ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামীণ পথে॥ নসিমন সোনাভান সোনাইবন্ধু

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

গ্রামীণ পথে॥ নসিমন সোনাভান সোনাইবন্ধু

ভটভটি নামে যাত্রা শুরু। তারপর নসিমন, করিমন, জরিমন, টুকটুকি, ভুটভুটি, পাগলমন, আলগামন সোনাভান, সোনাইবন্ধু... নানা নামে আবির্ভূত হয়েছে এক ধরনের যন্ত্রযান। এই যন্ত্রযানকে টেম্পো বলা যায় না, অটোরিক্সা বলা যায় না, স্কুটারও বলা যায় না। অথচ সড়ক মহাসড়কের যানবাহনের মতোই ভটভটির পথচলা। বর্তমানে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি ছোট ট্রাক বা পিকআপভ্যানের মতো পণ্য পরিবহনও শুরু হয়েছে এই যন্ত্রযানে। শহরের পাকা সড়কের পাশাপাশি গ্রামের মাটির কাঁচা পথেও সমান তালে চলে। যেখানে বাস মিনিবাস চলতে পারে না সেখানে এই ভটভটি কোনরকম বিঘœ ছাড়া অনায়াসে পথ চলে। দেশে বর্তমানে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের কল্যাণে প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক সড়ক পাকা হয়েছে। এইসব সড়ক বেশি চওড়া নয়। তারপরও গ্রামীণ জনপদে এই যন্ত্রযান চলাচল করতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে। তবে গ্রামীন জনপদের এইসব সড়কের আয়ু বেশিদিন থাকে না। কিছুদিন পরই ক্ষয় রোগের মতো পিচ-পাথর, ইট-খোয়া উঠতে থাকে। এবড়ো থেবড়ো পাকা পথে সিএনজি চালিত অটোরিক্সা, হালের ট্রাই সাইকেল নামের ব্যাটারি চালিত যান চলতে গেলে যাত্রীদের যে কী অবস্থা হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। মজার বিষয় হলো, ভটভটি, নসিমন, করিমন, সোনাইবন্ধু যাত্রীদের বন্ধু হয়ে অনায়সেই ভাঙা পথে চলতে পারে। ঠিক আগের দিনের গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি যেমন যে কোন রাস্তায় চলতে পারত, সোনাইবন্ধুর কাছে সড়ক কোন ফ্যাক্টর নয়। শ্যালো ইঞ্জিনের শক্তিতে সে পথ চলে মোষের মতোই। ভটভটির আবিষ্কার বেশি দিনের নয়। নৌকায় শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে স্পিড বোটের মতো গতি বাড়িয়ে নদীতে নামার পরই শ্যালো ইঞ্জিনের মেরামতের কারিগরের মাথায় বুদ্ধি আসে তাহলে তো রিক্সা বা ভ্যানের সঙ্গেও এই শ্যালো ইঞ্জিন এঁটে গতি দ্রুত করা যায়। এই ভাবনার বিকাশ হতে দেরি হয়নি। দাবি করা হয় শ্যালো ইঞ্জিনের ভাবনা উদ্ভাবন বগুড়াতেই শুরু, বগুড়াতেই তৈরি। রিক্সা ভ্যানে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে দ্রুতগামী করার ভাবনা ও উদ্ভাবন দুইই দাবি করতে পারে বগুড়া। ১৯৮৬ সাল। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার খেজুরতরার ছেলে রফিকুল শ্যালো ইঞ্জিন মেকানিক্সের কাজ করতেন। লেখাপড়া তেমন নেই। সেচ মৌসুমে গ্রামের শ্যালো ইঞ্জিন মেরামত ও ঠিকঠাক চালানোর দায়িত্ব নিতেন। মৌসুম শেষ হলে বাকি সময় রিক্সা চালিয়ে দিন গুজরান করতেন। এক সময় তার মাথায় ভাবনা চাপে শ্যালো ইঞ্জিনের শক্তিতে যদি পানি উত্তোলন হয়, জমি থেকে বালি উত্তোলন করা যায়, তাহলে এই শক্তিকে দ্রুতগতির যানবাহনে কাজে লাগানো যায়। এরপর তিনি নিজের ভ্যানে শ্যালো ইঞ্জিন বসিয়ে পুরনো ও পরিত্যক্ত মোটর সাইকেলের চাকা স্টিয়ারিং একসিলেটর ব্রেক স্যু চেইন সাইলেন্সার ইত্যাদি যন্ত্রাংশ বসিয়ে মোটামুটি একটা যন্ত্রযানের সাইজে এনে মাঠে নামালেন। দেখা গেল দ্রুতই চলে। তারপর লেদ মেশিনের সাহায্য নিয়ে টুকিটাকি পার্টস বানিয়ে সেট করে আরও উন্নত করলেন এই যন্ত্রযান। পথে নামার পর লোকমুখেই এর নাম হলো ভটভটি। এই নামের কারণ ছিল; পরিত্যক্ত সাইলেন্সার ইঞ্জিনের শব্দ কমাতে পারেনি। রাস্তায় ভটভট শব্দে চলায় লোকমুখেই ফেরে ভটভটি। এর মধ্যেই রফিক নিজের বাড়িতে গড়ে তোলেন ছোট কারখানা। নাম দেন রফিক অটোভ্যান ম্যানুফ্যাকচারার। তারপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরমধ্যেই গ্রামীণ ব্যাংক তার এই উদ্ভাবনে ঋণ দিয়ে অংশীদারিত্ব নেয়। আরেকদিকে রফিকের কোন পেটেন্ট না থাকায় দিনে দিনে অন্যেরা এই যানবাহন বানানো শুরু করে। দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে এই যানের সংখ্যা। বগুড়া থেকে গোটা উত্তরাঞ্চল ছাড়িয়ে দেশ জুড়ে এখন এই যান নানা নামে পরিচিতি পেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের পথে চলছে। এই যান প্রত্যন্ত গ্রামে শুধু যাত্রী পরিবহন করে না, কৃষি পণ্য সরকারী ও বেসরকারী কাজের সামগ্রী পরিবহন করে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনে প্রত্যন্ত গ্রামের ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটের সামগ্রী পৌঁছে দেয়। ৮০ দশকের মধ্যভাগে এই যন্ত্রযান মাঠে নামার পর হতে আজ পর্যন্ত মোটর যান আইনের আওতায় আসেনি। এই ভটভটির কোন কাগজপত্র নেই। কোন নম্বর প্লেট নেই। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথিরিটির (বিআরটিএ) কাছে নিবন্ধন নেই। শুধুমাত্র এই যান যে পরিবেশ বান্ধব তার সার্টিফিকেট আছে। এই যানের নির্দিষ্ট কোন পরিমাপ নেই। যে যেভাবে পারে ছোট বড় মাঝারি মাপে বানায়। নির্দিষ্ট পরিমাপের কোন বালাই নেই। ডিজাইন করে সেভাবেই। দাম নির্ধারিত হয় সাইজ ও মান ভেদে। সাধারণত ৫০ থেকে ৮০ হাজার টাকার মধ্যেই মেলে। খোঁজ করে জানা যায় এইসব যানের বেশিরভাগই কোন বেসরকারী সংস্থার ঋণের অর্থে কেনা। তবে কেউ কেউ নিজের অর্থেও কেনে। ভটভটির ক’জন মালিক জানালেন, এই যান ভাল চললে ঋণ পরিশোধে সময় লাগে না। এই যন্ত্রযান পথে নামায় গ্রামের মানুষ তাদের দৈনন্দিন কাজে গতি আনতে পেরেছে। বিশেষ করে নি¤œ ও স্বল্প আয়ের মানুষ কম ভাড়ায় আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনের কাছে দূরের পথে যাতায়াত করতে পারে। গ্রামীণ পথে ও হাটবাজারে কৃষি পণ্য পরিবহন করতে পারে। সড়ক যোগাযোগে নীরবে নিভৃতে এমন বিপ্লব ঘটেছে তবে এই যান এখনও অননুমোদিত। মাঝে মধ্যেই এই যান বন্ধ করার দাবি ওঠে। বর্তমানে মহাসড়কে সিএনজি চালিত অটোরিক্সাসহ তিন চাকার (থ্রি হুইলার) যানবাহন চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেয়ায় ভটভটি মহাসড়কে দেখা যায় না। অবশ্য গ্রামের পথে এই যান মানুষের জীবন মানে উন্নয়ন ঘটিয়েছে। গ্রামের পথে আজ আর গরু ও মোষের গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি সহসা চোখে পড়ে না। গ্রামীণ জনপদে ভটভটি নসিমন করিমন সোনাইবন্ধু ইত্যাদি নামের এই যন্ত্রযান বড় বাহন হয়েছে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×