ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

জন্মদিনে বের হচ্ছে আজ কীর্তিমান এ শিক্ষাবিদের স্মারক গ্রন্থ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

জন্মদিনে বের হচ্ছে আজ কীর্তিমান এ শিক্ষাবিদের স্মারক গ্রন্থ

মোরসালিন মিজান ॥ ৮০ বছরের জীবন। দীর্ঘ বৈকি! তারও বেশি সফল। বিপুলভাবে সমৃদ্ধ। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের এই জীবন জীবন দেখার। অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হওয়ার। শৈশব থেকেই বর্ণাঢ্য জীবন সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। সব শাখায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তাঁর ‘জীবন অনেক লিরিক কবিতার জন্ম দেয়’। গদ্য ছন্দের কবিতায় বলিষ্ঠভাবে প্রকাশিত হন তিনি। অতুলনীয় তাঁর কথাসাহিত্য। শিক্ষাবিদ হিসেবে সুনাম দেশে যতটা, বিদেশেও। প্রগতির পক্ষে মুক্তচিন্তার পক্ষে অহর্নিশ সংগ্রামী। বটবৃক্ষ হয়ে ছায়া দিয়ে চলা কীর্তিমানের আজ শনিবার শুভ জন্মদিন। এদিন তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে বিশেষ সংকলন গ্রন্থ ‘রাষ্ট্র সমাজ সংস্কৃতি’। জন্মের প্রথম শুভক্ষণটিকে স্মরণীয় করে রাখার পাশাপাশি সমৃদ্ধ স্মারক গ্রন্থ হিসেবে এটি পরিগণিত হতে পারে। অনুপম সেন ও মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত গ্রন্থে চমৎকার ফিরে দেখা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ভেতর বাহির। প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী লেখককে বিষয় করে গ্রন্থ প্রকাশের পক্ষে ফ্ল্যাপে প্রাবন্ধিক স্বদেশ রায় যথার্থই উল্লেখ করেছেনÑ ‘বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখকদের সামনের কাতারে সব সময়ই নাম আসে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের। নিজেকে তিনি আড়াল করে রাখলেও তাঁর কাজ তাঁকে সামনে নিয়ে আসে।’ গ্রন্থে সেইসব কাজের কর্মযজ্ঞের চিন্তার কিছুটা তুলে ধরার প্রয়াস। কিন্তু এমন একটি গ্রন্থের শিরোনাম কেন ‘রাষ্ট্র সমাজ সংস্কৃতি’? মুনতাসীর মানুন ভূমিকায় সেটি পরিষ্কার করেছেন। লিখেছেন, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যেহেতু জীবনের একটা বড় সময় ব্যয় করেছেন রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতি চর্চা নিয়ে সে জন্য সংকলনের এমন শিরোনাম। গ্রন্থের প্রথম পর্বে মোট ১৩টি রচনা। এ অংশে সুহৃদদের স্মৃতিচারণ। মূল্যায়ন। আছে সাক্ষাতকার। সব মিলিয়ে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের জীবন ও সৃষ্টিশীল জগতের নাতিদীর্ঘ বয়ান। তিনটি প্রবন্ধে কবি, গল্পকার ও শিল্প সমালোচক হিসেবে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিপুল ঐশ্বর্য যে জীবনের, সে জীবনকে সীমিত পরিসরে হলেও তুলে ধরার আন্তরিক প্রয়াস শান্তনু মজুমদারের রচনায়। ধারাবাহিক বর্ণনায় ফুটে উঠেছে মহাজীবন। একেবারে জন্ম থেকে শুরু। ব্যক্তি মানস, বেড়ে ওঠার বাঁক, এগিয়ে যাওয়ার ছন্দ স্পষ্ট করার চেষ্টা হয়েছে। কর্মময় জীবন সমাজ ও রাজনীতির বোধগুলো এখানে ক্রমশ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে কবীর চৌধুরী, শামসুর রাহমান, ওয়াহিদুল হক, কাইয়ুম চৌধুরী, আনিসুজ্জামানের মতো বিশিষ্টজনদের রচনা। এক আনিসুজ্জামানই অবশ্য জীবিত। বাকিরা এখন স্মৃতি। জীবদ্দশায় তাঁরা যে স্মৃতিচারণ করেছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের, গ্রন্থে সেগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে। স্মৃতি তর্পণ বটে। শুধু স্মৃতিকথা নয়। বন্ধুবর এবং অগ্রজ লেখক কবি ও শিল্পীদের বর্ণনায় তাঁদের সেই সময়টি চমৎকার জানার সুযোগ হয়। খুব ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়া যায় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে। অগ্রজ বুদ্ধিজীবী কবির চৌধুরী তাঁকে উল্লেখ করেছেন এভাবেÑ একটি বিশেষ ক্ষেত্রে বোরহানকে আমি ব্যতিক্রমী বিবেচনা করি। সে সমস্যার গভীরে যেতে চায়। কোন একটা সমস্যার জন্ম হয়, কি তার প্রকৃতি, তার প্রকৃত উৎস কোথায়, তার জল কতদূর বিস্তৃত এসব সে স্থান ও কালের ব্যাপক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে বিচার করে। নিজেকে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের স্বাতন্ত্র্যদীপ্ত কবিতার একজন অনুরক্ত পাঠক হিসেবে বর্ণনা করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, বাংলাদেশের সকল কবির কবিতা থেকে তাঁর (বোরহানউদ্দিন) কবিতা আলাদা। গদ্য সম্পর্কে মূল্যায়নÑ তাঁর গদ্যশৈলীর বৈশিষ্ট্য অমনোযোগী পাঠকের কাছেও স্পষ্ট। শিল্পসমালোচক পরিচয়টি বিশেষভাবে ফুটে ওঠে বন্ধু কাইয়ুম চৌধুরীর লেখায়। বরেণ্য শিল্পী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দারুণ তথ্য দেন। লিখেনÑ বোরহান একটু অতিমাত্রায় উৎসুক। ছবির ব্যাকরণ বোঝার চেষ্টা, বিভিন্ন মিডিয়ামের ব্যবহার পদ্ধতি জানার অদম্য আগ্রহ তাঁকে উৎসাহ যোগাল জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, শফিউদ্দিন আহমেদের সঙ্গ পেতে। তাঁদের সঙ্গে আড্ডা, তুমুল আড্ডা, ছবি নিয়ে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা। কখনও আর্ট স্কুলে, কখনও জয়নুল আবেদিনের শান্তিনগরের বাসায় বিখ্যাত রকে সেখানে আমরা ছাড়াও আসতেন কবি জসীম উদ্দীন, মুহাম্মদ মনসুরউদ্দীন, সাইয়ীদ আতীকুল্লাহ প্রমুখ। কখনও কামরুল ভাইর ভিতরবাড়ি লেনের চিলেকোঠায়, ডালপুরি আর জিলিপি সহযোগে ইম্প্রেশনিস্ট, কিউবিজম, ফবিজমের সারাৎসার থেকে একেবারে ভারতীয় উপমহাদেশ, বেঙ্গল স্কুল, ক্যালকাটা গ্রুপের ছবি নিয়ে সরস আলোচনা। ... এভাবেই জন্ম নিয়েছে চিত্র সমালোচনা ও সমালোচক। ওয়াহিদুল হকের বলা থেকেও দারুণ উপলব্ধি করা যায় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের এই পুরোধার মতে, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর পেশায় শিক্ষক, সমাজতত্ত্ববিদ। নেশায় দায়বদ্ধ সমাজ-সন্ধানী। বন্ধুবর আনিসুজ্জামানের লেখায়ও চমকপ্রদ তথ্য। তিনি গ্রন্থের পাঠককে জানান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রায় অর্ধশতাব্দীর! বন্ধু সম্পর্কে রসবোধ নিয়েই তিনি লিখেনÑ যদি আমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেন, নামের শেষে ডাক নাম লেখার রীতি কে প্রবর্তন করেন, আমি বলব, বোরহান। শৈশবেই বন্ধুর প্রতিভার ঝলকানি দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়ে তাঁর মূল্যায়নÑ ‘মেঘনায়’ নামে তার একটি গল্প পড়ে আমি যে কী ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, তা বর্ণনাতীত। মনে হয়েছিল, আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের বড় হয়ে সে কী করে অমন অভিজ্ঞতা অর্জন করল, জীবনকে এক প্রগাঢ়ভাবে জানল তার সকল জটিলতাসহ- কী করে এমন সম্ভবপর হলো। এভাবে খুব কাছ থেকে দেখা বোরহানউদ্দিন সামনে আসেন। বহুমাত্রিক ও বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনা দেয়া হয় বিশেষ এই প্রকাশনায়। একাধিক সাক্ষাতকার থেকেও খুঁজে নেয়া যায় বোরহান উদ্দিনকে। এখানে অন্যের জিজ্ঞাসার বিপরীতে নিজেকে মূর্ত করেন তিনি। নিজ বয়ানে। একটি সাক্ষাতকারে কবিতা ও কবির স্বাধীনতাকে প্রসঙ্গ করে তিনি বলেন, কবিতা আপনার মনের মধ্যে নতুনত্ব বা স্বতন্ত্র্য একটা পথ তৈরি করতে পেরেছে কি না, আমি মনে করি সেটা অনেক বড় ব্যাপার। যে যার মতো করে লিখবে এবং সংজ্ঞা দাঁড় করাবে। তা করাক। আমি মনে করি এখানেও তাঁর স্বাধীনতা সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা। গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে মুখ্য চরিত্রটিকে সরাসরি পাওয়া যায় না। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও ধ্যানের জায়গাগুলো স্পষ্ট করার প্রয়াস। তিনি যে সব বিষয় নিয়ে ভেবেছেন, মগ্ন থেকেছেন তার কয়েকটি নিয়ে লেখা প্রবন্ধ এই অংশে সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রবন্ধগুলোর কিছু নতুন। পুরনো লেখাগুলোও খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অবশ্য পরিমার্জিত সংস্করণ। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের চিন্তা ও বোধের জায়গাগুলোতে যাদের অভিন্ন অবস্থান, তাঁরা লিখেছেন। নানাবিধ বিষয়। লেখার শিরোনাম ও লেখকদের নামগুলো উল্লেখ করলে বোঝা সহজ হবে। অনুপম সেন লিখেছেন ‘আদিঅন্ত বাঙালি : বাঙালি সত্তার ভূত ভবিষ্যৎ’। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও ইতিহাসের অধিকার’। সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, ‘নজরুল ইসলামকে কোন পরিচয়ে চিনব’। সনৎ কুমার সাহার বিষয় ‘আমাদের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু’। মফিদুল হকের লেখায় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ঐতিহাসিক রায়’। ড. ফিরাজ মাহমুদের লেখায় ‘ইতিহাস চর্চায় ফোকলোরের গুরুত্ব’। এভাবে বেশ কিছু রচনা। হরেক বিষয় ও ভাবনার বিস্তার। এসব ভাবনার উৎসমূলে খুঁজে পাওয়া যায় বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে। ‘রাষ্ট্র সমাজ সংস্কৃতি’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে সুবর্ণ। ৪৮৭ পৃষ্ঠার সমৃদ্ধ বইটির মূল্য ৬০০ টাকা।
×