ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের পদচারণায় মুখর সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র

পাহাড় টিলা নদী হাওড়- সবুজের সমারোহ

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

পাহাড় টিলা নদী হাওড়- সবুজের সমারোহ

সালাম মশরুর দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সিলেট। প্রকৃতির রূপ ছড়িয়ে রয়েছে এখানে ওখানে সবখানে। অবিরাম হাতছানি দিয়ে ডাকছে সেরূপ প্রকৃতি প্রেমিকদের। শীত মৌসুমের এমন সময়ে প্রকৃতি প্রেমীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো। টিলা, পাহাড়, নদী, হাওড়, সবুজের সমারোহ। চা-বাগান বেষ্টিত মনোমুগ্ধকর রূপ উপভোগ করতে সারা বছর ভিড় লেগেই থাকে পর্যটকদের। এই শীতেও সিলেটে দলবেঁধে ছুটে আসছেন হাজার হাজার পর্যটক। সিলেটের হোটেল মোটেল-গেস্ট হাউসে এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। শহরেই রয়েছে ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (র.)-এ মাজার শরীফ। এখান থেকে ৭কিলোমিটার দূরত্বে হযরত শাহপরাণ (র.)-এর মাজার। সবাই সিলেট বেড়াতে এসে মাজার ঘুরে দেখাটাও রাখেন তালিকার মধ্যে। জাফলং-তামাবিল জৈন্তা, রাজবাড়ী, পান্তুমাই, লালাখাল, মাধবকু-, হাকালুকি, টাঙ্গুয়ার হাওড়, বারাক্কি টিলাসহ নানা স্থানে ছুটে বেড়ানো আর চা বাগান দেখার স্বাদ মেটাতে ব্যস্ত হয়ে ছোটেন পর্যটকরা। সিলেট শহরে প্রবেশের মুখে আগতদের স্বাগত জানায় সুরমা নদীর উপর স্থাপিত ঐতিহ্যবাহী ক্বিনব্রিজ ও আলী আমজাদের ঘড়ি। সিলেটের অন্যতম আকর্ষণ ক্বিনব্রিজ ও আলী আমজাদের ঘড়িঘর। ক্বিনব্রিজটি ১৯৩৬ সালে সুরমা নদীর উপর নির্মাণ করেন তৎকালীন ইংরেজ গবর্নর মাইকেল ক্বিন। ১১৫০ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট প্রশস্ত ক্বিন ব্রিজটি লোহা দিয়ে তৈরি। ক্বিন ব্রিজের পাশেই আলী আমজাদের ঐতিহ্যবাহী ঘড়িঘর অবস্থিত। চমৎকার এ ঘড়িটি নির্মাণ করেন পৃথিমপাশার বিখ্যাত জমিদার আলী আমজাদ। দৃষ্টিনন্দন এ ঘড়িঘরটি দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। সিলেট শহরের পূর্ব প্রান্তে একটি ছোট টিলার উপরে সিলেটের শাহী ঈদগাহ অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের প্রাচীনতম শাহী ঈদগাহের একটি। দৃষ্টিনন্দন, মনোমুগ্ধকর, কারুকার্যময় এই শাহী ঈদগাহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে এখানে সৈয়দ মুহাম্মদ হাদী ও সৈয়দ মুহাম্মদ মেহেদী ভ্রাতৃদ্বয়ের নেতৃত্বে ইংরেজবিরোধী অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং ইংরেজদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় শহীদ হন। এছাড়া বিভিন্ন সময় এই শাহী ঈদগাহ ময়দানে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রেখে গেছেন কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মহাত্মা গান্ধী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলাসহ উপমহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিকরা। পর্যটন নগরী সিলেট হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও অন্যতম তীর্থভূমি। শহরের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ মন্দির রয়েছে। এরমধ্যে তিন মন্দির বাড়ি, লামাবাজার রোডের দশনামী আখড়া, মহাপ্রভু জিউর আখড়া, বন্দরবাজারের ব্রহ্মমন্দির উল্লেখযোগ্য। এছাড়া গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকা দক্ষিণে মহাসাধক শ্রীচৈতন্য দেবের বাড়ি অবস্থিত। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি এখানে এসেছিলেন। তার স্মৃতি রক্ষার্থে উঁচু টিলার উপর একটি দৃষ্টিনন্দন মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবছর শত শত পর্যটক এখানে ভ্রমণে এসে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। ভোলাগঞ্জ ও বিছানাকান্দির পাশাপাশি রয়েছে রাতারগুল। সিলেট শহর থেকে ৪০/৫০ কিলোটিারের দূরত্বে রয়েছে পান্তুমাই ও নকশিয়া পুঞ্জি। ভারতের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত নকশিয়া পুঞ্জি এলাকায় মূলত খাসিয়া সম্প্রদায়ের বসবাস। গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর হয়ে জাফলং চা বাগানের ভেতর দিয়ে নকশিয়া পুঞ্জি এলাকায় যেতে হয়। মেঘালয়ের পাদদেশে পাহাড়ী নদীর তীরে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ৫টি পুঞ্জির অবস্থান। পানের বরজ আর সারি সারি সুপারী গাছের বাগানে বেষ্টিত বিশাল পুঞ্জি এলাকা। এখানে খাসিয়াদের জীবন ব্যবস্থা, বাসস্থান, আচার অনুষ্ঠান উপভোগ করার মতো। কিন্তু এই এলাকায় যাতায়াতের এখনও ভাল কোন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। গোয়াইনঘাট উপজেলা সদর থেকে সীমান্তের ঐ এলাকায় পৌঁছাতে নিজস্ব বাহন ছাড়া যাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পান্তুমাই। পাহাড়ের খুব কাছাকাছি নদীর ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের অপুর্ব ঝর্ণাধারা। পান্তুমাই যাবার পথটিও কণ্টকাকীর্ণ। ভাঙ্গাচোরা ছোট রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে অসুবিধা পোহাতে হয়। একই সমস্যা রয়েছে বিছানাকান্দি ও ভোলাগঞ্জ যাতায়াতের ক্ষেত্রে। সীমানা ঘেঁষে প্রকৃতির রূপ যেন দেখে শেষ হওয়ার নয়। শহরতলীর খাদিমনগর জাতীয় উদ্যান ও বিভিন্ন হাওড়ের পরিযায়ী পাখির কলতানে রয়েছে বাড়তি আনন্দ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে সিলেটের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। তবে সিলেটকে পর্যটন নগরী ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিন থেকেই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যথাযথ সংস্কার, তথ্য সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাবে সিলেটের পর্যটনখাত আজও অবহেলার শিকার বলে বলছেন পর্যটকরা। জাফলং পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ বিনষ্টকারী পাথর ক্রাশার মেশিন অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে সিলেট-জাফলং সড়কটিও লেনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গৃহীত এ প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হলে জাফলং এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণের সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। সীমান্তবর্তী অঞ্চল সিলেটের জকিগঞ্জে উজান থেকে নেমে আসা তিন নদী সুরমা-কুশিয়ারা-বরাক মোহনার নয়নাভিরাম দৃশ্য। বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও ঘুরপাক খাচ্ছে তাহিরপুরের পর্যটন শিল্প। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ৬ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের কোন পদক্ষেপ নেই। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওড়, বারেকটিলায় দেশের বিভিন স্থানের পর্যটক সারা বছরই ভিড় করে থাকেন। এখানে পর্যটন কেন্দ্র বাস্তবায়ন হলে সরকার যেমন লাভবান হবে সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
×