ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় গত ৫০ বছরে গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রী বেড়েছে

এবার শেষ পৌষেও দেখা নেই শীতের, আভাস নেই কনকনে ঠাণ্ডার

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

এবার শেষ পৌষেও দেখা নেই শীতের, আভাস নেই কনকনে ঠাণ্ডার

শাহীন রহমান ॥ বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ছে শীতকাল। ঋতুবৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী প্রতিবছর প্রকৃতিতে শীত এলেও তার ধারাবাহিকতা থাকছে না। কোন বছর কনকনে ঠা-ায় মানুষ জবুথবু, আবার কোন বছর প্রকৃতিতে শীত ঋতু যে চলছে তা বোঝাই মুশকিল হয়ে পড়ছে। আবহাওয়া অফিসের হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত শীতের আধিক্য থাকে। এরপর কমে যেতে থাকে শীত। তবে মাসের হিসাবে পৌষের বাকি আছে মাত্র আর এক সপ্তাহের কম। অথচ এবার শীতের দেখা মেলেনি। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্যান্য বছরের ন্যায় এ বছর এখন পর্যন্ত বড় ধরনের শৈত্যপ্রবাহ আসেনি। এছাড়া নবেম্বর থেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও অনেক কম হয়েছে। ডিসেম্বরের স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৮ ভাগ কম। এছাড়া শীতের অন্যান্য প্যারামিটার অনুপস্থিত থাকায় শীত অনুভূত হচ্ছে না। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক শাহ আলমের মতে, শীতের তীব্রতা মূলত তিনটি প্যারামিটারের ওপর নির্ভর করে। প্রথমত বেশি কুয়াশা থাকলে রাত ও দিনের তাপমাত্রা কাছাকাছি থাকে। দিনে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় বেশি ঠা-া অনুভূত হয়। উপরের ঠা-া বায়ুর (জেড বায়ু) প্রকোপ বাড়লে তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে বৃষ্টি হলেও শীত পড়ে। এবার শীতে এসবের কিছুরই দেখা মিলছে না। ফলে শীতের আমেজও নেই। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে এ বছর দেশে বড় ধরনের শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা নেই। ফলে সামনের দিনগুলোতে খুব বেশি শীতে আশা করছেন না তারা। শুক্রবার পৌষ মাসের ২৪ তারিখ। আর ৬ দিন পর শেষ হবে পৌষ। অথচ গ্রাম বাংলায় কিছুটা থাকলেও এখন পর্যন্ত শীতের কোন বৈশিষ্ট্যই নগরজীবনে ধরা পড়েনি। এক সময় ষড়ঋতুর অন্যতম বৈচিত্র্যময় মাস ছিল পৌষ। শীতের আগমনের অপেক্ষায় থাকত সবাই। গ্রাম বাংলায় পিঠা পুলির অনেক আয়োজন থাকত এ মাসে। এছাড়া শীতের সকালে খেজুর রসের স্বাদ বুঝিয়ে দিত প্রকৃতিতে শীত চলছে। এর প্রভাব এসে লাগত নগর জীবনে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমেই বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ছে শীত। বিশেষজ্ঞদের মতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া বিশেষ কোন নিয়মকানুন অনুযায়ী চলছে না। এ কারণেই শীতও তার রুটিন মতো আচরণ করছে না। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বেই আবহাওয়া তার রুটিন মেনে চলছে না। মেরু অঞ্চলে বরফের স্তর ক্রমেই কমছে। আবহাওয়ার এ পরিবর্তনের জন্য জনসংখ্যার বৃদ্ধি, নগরায়ন, বায়ুদূষণ, কলকারখানার দূষণ, অতিরিক্ত কার্বন নির্গমনসহ আরও বহুবিধ কারণ রয়েছে। ঢাকায় গত ৫০ বছরে গড় তাপমাত্রা প্রায় এক ডিগ্রী বেড়েছে। বহুতল ভবন ও কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি উষ্ণতা বাড়াচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে প্রকৃতিতেও। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়। আবহাওয়ার এ হেঁয়ালি আচরণে বাংলাদেশে দিনে দিনে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্র। প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। গত ২ বছরের পরিসংখ্যান হিসাব করলে দেখা যাবে ২০১৩ সালে দু-দুবার শীতে রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা নেমে যায়। কিন্তু দুই বছরের মাথায় এসেই তার ধরন বদলে গেছে। দিনের বেলার চেহারা দেখলে বোঝা যাবে না প্রকৃতিতে শীত ঋতু চলছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন গত কয়েক বছর ধরে শীতের কোন ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না। মূলত জলবায়ু পরির্বনের কারণে এমনটা হচ্ছে। কোন বছর বেশি শীত পড়ছে। আর কোন বছর শীতের দেখাই মিলছে না। শীতের কোন ধারাবাহিকতা না থাকায় শৈত্যপ্রবাহ নির্ভর হয়ে পড়ছে শীত। যখনই বেশি হচ্ছে শৈত্যপ্রবাহ তখনই বেশি শীত পড়ছে। শৈত্যপ্রবাহ কমলে শীতও কমছে। শৈত্যপ্রবাহ না থাকলে শীতও থাকছে না। শীতের এই কম বেশি হওয়ার খেলা এবারের শীত ঋতুতে ভালোভাবেই ধরা পড়েছে। তাদের মতে শীত ঋতুতে শৈত্যপ্রবাহ থাকবে শীত নামবে, তাপমাত্রা কমবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ সুদূর সাইবেরিয়া থেকে যে ঠা-া বাতাস আসে তার কারণেই মূলত শীত আসে। কিন্তু অন্য কারণে শীত অনুভূত হতে পারে। ঋতুবৈচিত্র্যের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ঋতু প্রকৃতিতে হাজির হওয়ার আগে তার আগমনী বার্তা দিয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার কথা। বিগত ১০ বছরের জলবায়ুর ধরন বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে শীত তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারছে না। মানছে না শীতে কোন প্যারামিটার। অথচ আবহাওয়াবিদদের মতে, শৈত্যপ্রবাহ শীতের একমাত্র কারণ নয়। অন্য আরও কয়েকটি কারণে শীত নেমে থাকে। যার দেখা এবার শীতে মিলছে না। আবহাওয়া অফিসের এক কর্মকর্তার বলেন, সূর্য দক্ষিণায়ন হওয়ার সঙ্গে দিনের পরিধি যেমন কমে আসে তেমনি তাপমাত্রাও আস্তে আস্তে কমতে থাকে। একপর্যায়ে তা বেশিমাত্রায় কমে গেলে প্রকৃতিতে শীত নামে। উপমহাদেশের উষ্ণম-লীয় অঞ্চলে উচ্চচাপ বলয়ের সৃষ্টি হয়। এ চাপ বলয়ের কারণে ভারি বাতাস ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। এর সঙ্গে ‘জেড’ বায়ু (উর্ধাকাশের ঠা-া বায়ু) যুক্ত হয়ে নিচের বায়ু শুষ্ক ও ঠা-া করে দেয়। এছাড়া ঘন কুয়াশা ও পশ্চিমা লঘুচাপের ফলেও শীত অনুভূত হয়। ফলে বেশি কুয়াশা থাকলে রাত ও দিনের তাপমাত্রা কাছাকাছি থাকে। দিনে পর্যাপ্ত আলো না থাকায় বেশি ঠা-া অনুভূত হয়। ওপরের ঠা-া বায়ুর (জেড বায়ু) প্রকোপ বাড়লে তাপমাত্রা কমে গিয়ে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া পশ্চিমা লঘুচাপের কারণে বৃষ্টিপাত হলেও শীত পড়ে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে শীতকাল প্রায় বৃষ্টিহীন থাকছে। এবার গত নবেম্বর থেকেই প্রকৃতিতে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের দেখা নেই। ডিসেম্বরে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৮ ভাগ কম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আগামীতে শীত মৌসুম শুষ্কতায় পরিণত হবে। ফলে আগামীতে শীত ঋতুও আলাদাভাবে চেনা দায় হয়ে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ষড়ঋতুর এই দেশে তিনটি ঋতুর রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যেগুলোর কারণে ঋতু তিনটি অন্য ঋতু থেকে আলাদা। এর মধ্যে রয়েছে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত। অন্য তিনটি ঋতু শরত, হেমন্ত ও বসন্তের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত থেকে এ ঋতু তিনটি প্রভাবমুক্ত নয়। অনেকের মতে, এ তিনটি ঋতুর যেটুকু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল তাও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতে প্রভাব পড়ছে। গ্রীষ্মকালে অতিমাত্রায় তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বর্ষা ঋতুতে কখনও অধিক বৃষ্টিপাত আবার কখনও বৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে। শীতও তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে পারছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে ঋতু বৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী এখন আর ষড়ঋতুর দেখা পাওয়া যায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ইতোমধ্যে ঋতুর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
×