ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ব এজতেমা শুরু কঠোর নিরাপত্তা

লাখো মুসল্লির পদভারে মুখর টঙ্গীর তুরাগ প্রান্তর

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৯ জানুয়ারি ২০১৬

লাখো মুসল্লির পদভারে মুখর টঙ্গীর তুরাগ প্রান্তর

ফিরোজ মান্না/মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গীর এজতেমা মাঠ থেকে ॥ টঙ্গীর তুরাগতীরে ধর্মপ্রাণ মানুষের স্রোত যেন থামছেই না। শুক্রবার সকাল থেকে তুরাগতীরের দিকে এই ছুটে চলার উদ্দেশ্য ছিল তাবলীগ জামাতে আসা মুসল্লিদের সঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করা। আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুক্রবার বিশ্ব এজতেমা শুরু হয়। এবার বিশ্ব এজতেমায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ বছর ৩২ জেলার মানুষ বিশ্ব এজতেমায় অংশ নিতে পারবেন। এই ৩২ জেলার মধ্যে প্রথম দফায় ১৭ জেলা এবং তিন দিন বিরতি দিয়ে ১৫ জেলার মানুষ বিশ্ব এজতেমায় অংশ নিতে পারবেন। বাকি ৩২ জেলার মানুষ আগামী এজতেমায় দুই পর্বে অংশ নেবেন। এজতেমাস্থলে জায়গার অভাবে এভাবেই ভাগ করা হয়েছে। এদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গী হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে বিশ্ব এজতেমাস্থলে নজিরবিহীন পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয় স্থাপন করেছে। বসানো হয়েছে আর্চওয়ে, যাতে কোন জঙ্গী মুসল্লিদের বেশে এজতেমাস্থলে ঢুকে কোন অঘটন ঘটাতে না পারে। সেজন্য সাদা পোশাকে মুসল্লিদের সঙ্গে মিশে আছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। আর আকাশে রয়েছে র‌্যাবের হেলিকপ্টার টহল। নজিরবিহীন নিরাপত্তায় মুসল্লিরাও খুশি। রবিবার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথমপর্বের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব এজতেমা শেষ হবে। পথে নানা বিড়ম্বনাকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ব এজতেমায় যোগ দিতে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসল্লি শুক্রবারও এজতেমা ময়দানে ছুটে আসছেন। এজতেমার শুরুর দিন শুক্রবার হওয়ায় জুমার নামাজে অংশ নিতে এজতেমাস্থলে মুসল্লিদের ঢল নামে। প্যান্ডেল কানায় কানায় ভরে যায়। প্যান্ডেলের নিচে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা অংশ নেন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপরে। এবারের বিশ^ এজতেমার প্রথম পর্বে লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে বিশ্বের ১০০টি দেশের প্রায় সাত হাজার মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। শুক্রবার বাদ ফজর ভারতের আব্দুর রহমান আম বয়ানের মাধ্যমে এবারকার বিশ্ব এজতেমার মূল কজ শুরু করেন। এ বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মুরুব্বি মাওলানা মোঃ আব্দুল মতিন। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লি¬র উদ্দেশে ইমান, আমল, আখলাক ইত্যাদি বিষয়ে বয়ান করা হয়। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারও সমবেত লাখ লাখ মুসল্লির উদ্দেশে তাবলীগের ৬ উসুল অর্থাৎ কালেমা, নামাজ, এলেম ও জিকির, একরামুল মুসলিমিন, সহীহ নিয়ত ও তাবলীগ ইত্যাদি বিষয়ে আম বয়ানের মাধ্যমে এজতেমার প্রথমপর্বের তিন দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। আজ শনিবার বাদ আছর প্রতি বছরের ন্যায় যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা রযেছে। এসব বিয়ে বর ও উভয়পক্ষের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে বর ও কনের নাম তালিকাভুক্তি করা শুরু হয়েছে। আগামী ১০ জানুয়ারি প্রথমপর্ব আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। ১৫ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হবে দ্বিতীয়পর্বের তিন দিনব্যাপী বিশ্ব এজতেমা। এজতেমা ময়দান এলাকায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মাঠজুড়ে ৬০টির অধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে লাখো মুসল্লি সেখানে সমবেত হয়েছেন। বিভিন্ন জেলার যুবক, কিশোর, বায়োজ্যেষ্ঠ সব শ্রেণীর মানুষ এজতেমায় এসেছেন। অনেকে ৪০ দিন (এক চিল্লা) বা ১২০ দিন (তিন চিল্লা) ইসলামের দাওয়াত শেষ করে এজতেমায় শরিক হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ এজতেমা শেষে ইসলামের দাওয়াত দিতে ৪০ দিন (এক চিল্লা) বা ১২০ দিনের জন্য (তিন চিল্লা) বেরিয়ে পড়বেন। ধনী, দরিদ্র সবাই এখানে এক শামিয়ানার নিচে একসঙ্গে অবস্থান করছেন। মুসল্লিরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ব্যবহার্য দ্রব্যাদি কাঁধে বহন করে এজতেমায় এসেছেন। শুক্রবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে জুমার জামাত শুরু হয়। ওই নামাজের ইমামতি করেন বাংলাদেশের কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ জোবায়ের। এজতেমায় যোগদানকারী মুসল্লি ছাড়াও জুমার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা-গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকার লাখ লাখ মুসল্লি হাজির হন। ভোর থেকেই রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা থেকে এজতেমা মাঠের দিকে মানুষের ঢল নামে। দুপুর ১২টার দিকে এজতেমা মাঠ উপচে আশপাশের খোলা জায়গাসহ সব স্থান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুক্রবার ফজরের নামাজের পর থেকে ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান আম বয়ান শুরু করেন। এই বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মুরুব্বি মাওলানা মোঃ আব্দুল মতিন। জুমার নামাজের পর বাদ আছর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা জোয়াহের ও বাদ মাগরিব দিল্লীর মাওলানা সা’দ বয়ান করেন। বিশ্ব এজতেমার আয়োজক কমিটির মুরুব্বি প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বয়ানে বলা হয়, দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান স্থান হলো মসজিদ আর সবচেয়ে কম দামি জায়গা হলো বাজার। যারা মসজিদে নামাজ আদায় করেন, তাদের জন্য বেহেশতে মহল তৈরি হয়। যে মসজিদকে ভালবাসে স্বয়ং আল্লাহতা’য়ালা তাকে ভালবাসেন। এ দুনিয়ায় যিনি একটি মসজিদ বানান, আল্লাহ তার জন্য পরপারে একটি মহল বানাবেন। জুমার দিন একটি পবিত্র দিন। সবচেয়ে উত্তম দিন হলো জুমার দিন। এটি হলো সবচেয়ে বড় ও সম্মানী দিন। এটি দুই ঈদের চেয়েও ফজিলতপূর্ণ। প্রথমপর্বে বিশ্ব এজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলীগ মারকাজের ১৫-২০ জন শূরা সদস্য ও বুজর্গ বয়ান পেশ করেন। মূল বয়ান উর্দুতে হলেও বাংলা, ইংরেজী, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসী ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শোনানো হচ্ছে। এজতেমার প্রথম দিনে জুম্মার নামাজে অংশ নেনÑ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আলী, গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ, গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ। এদিকে, টঙ্গী হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে চারটি মেডিক্যাল ক্যাম্পে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় দুই হাজার মুসল্লি চিকিৎসা নিয়েছেন। এরমধ্যে দু’জনকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়েছে। বর্তমানে ৫০ জনের ওপরে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। অসুস্থদের বেশিরভাগই ঠা-া, সর্দি, কাশি, আমাশয়, শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগের রোগী বলে সিভিল সার্জন ডাঃ আলী হায়দার খান জানিয়েছেন। তবে প্রথমপর্বে অংশ নেয়া তিন মুসল্লি শুক্রবার মারা গেছেন। তারা হলেনÑ সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার রনকলি এলাকার জয়নাল আবেদীন (৫৫), কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার চকলাপাড় গ্রামের নূরুল ইসলাম (৭২) ও নাটোরের সিংড়া উপজেলার বটিয়া গ্রামের ফরিদ উদ্দিন (৬৫)। বিদেশী মেহমান তাঁবুতে রান্নার জামাতের জিম্মাদার মোঃ নুরুল ইসলাম জানান, শুক্রবার সকাল থেকে তাদের গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় রান্নায় সমস্যা হচ্ছে। গত দু’দিন তেমন সমস্যা না হলেও শুক্রবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে হঠাৎ গ্যাসের চাপ কমে যায়। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাসের টঙ্গী (বিক্রয়) কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, তারা বিষয়টি জানতে পেরে দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। এজতেমাস্থলে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্ব সম্প্রতি জঙ্গী হামলা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। সবাই জঙ্গী হামলার আশঙ্কা করছে। অর্থাৎ জঙ্গী হামলার বিষয়টি কেউ উড়িয়ে দিচ্ছে না। আমরা সে রকম প্রস্ততি নিয়ে এখানে কাজ করছি। জঙ্গী হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখেই আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছি। এদিকে টঙ্গী থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার জানান, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত এজতেমাস্থল ও আশপাশে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৫০ হকার ও পকেটমারকে আটক করা হয়েছে। পকেটমার-ছিনতাইকারী গ্রেফতারে এবং হকার উচ্ছেদে এজতেমা এলাকায় পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম কাজ করছে। পুলিশের তৎপরতার কারণে অন্যবারের তুলনায় এবারের এজতেমা এলাকায় পকেটমার ও ছিনতাইয়ের ঘটনা তুলনামূলক হ্রাস পেয়েছে। এজতেমা মাঠের আশপাশ এলাকায় হোটেল-রেস্তরাঁয় দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ভেজাল ও ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য রাখা ও বিক্রির অভিযোগে ভোক্তা অধিকার আইনে মোট ১৩টি মামলা দয়ের করেছে। এই মামলাগুলো থেকে ২৯ হাজার ৫শ’ টাকা জরিমানা ও আদায় করা হয়েছে। টঙ্গীর বিশ্ব এজতেমা মাঠের আশপাশ এলাকায় দুই শিফটে মোট ১০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করছে। গাজীপুরের ১৪ জনসহ বিভিন্ন জেলার ২৪ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই সব আদালত পরিচালনা করছেন। অন্যদিকে, ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী আজ শনিবার বাদ আছর যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হবে। সকাল থেকে ওই সব বিয়ের জন্য বয়ান মঞ্চের কক্ষেই বর-কনের নাম তালিকাভুক্ত করা হবে। উল্লেখ্য, এজতেমার মুরুব্বিদের দেয়া তথ্যমতে ১৯৪৬ সালে প্রথম কাকরাইল মসজিদে এজতেমার আয়োজন শুরু করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজী ক্যাম্পে ও ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর লোকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৬৬ সালে গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বর্তমান স্থলে স্থানান্তর করা হয়েছে। পরে সরকারীভাবে তুরাগতীরের ১৬০ একর জমি স্থায়ীভাবে এজতেমার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
×