ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৌম্য সালেক

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

রাগী তরুণদল ১৯৫০-এর দশকে ও তার পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডে একদল লেখকের উদ্ভব হয় যাঁরা প্রচলিত আচার-আচরণ, রীতিনীতি, সামাজিক সম্পর্ক, পূর্ব ঐতিহ্য এবং যাকে ‘এস্টাব্লিশমেন্ট’ বলা হয় তার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভপূর্ণ সমালোচনামূলক সাহিত্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেন। রাগী তরুণদল বলতে তাঁদের বুঝায়। এই লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্মের মধ্যে-কিংসলি এমিসের লাকি জিম, জন ব্রেইনের রুম এ্যাট টি টপ, অ্যালন সিলিটোর লোনলিনেস অব দি লং ডিসটান্স রানার উপন্যাস তিনটি এবং জন ওসবোর্নের নাটক, লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার অন্যতম। অ্যাফরিজম বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার অসংখ্য প্রবচনের মধ্যে আমরা এর সাক্ষাত পাই। পাশ্চাত্য সাহিত্যে অ্যারিস্টটল, প্লেটো, লা রশোফুকো, ফ্রান্সিস বেকন, ডক্টর জনসন, বার্নার্ড শ প্রমুখের রচনায় প্রচুর অ্যাফরিজম-এর দৃষ্টান্ত লক্ষণীয়। বাংলা সাহিত্যে খনা, ডাক থেকে আরম্ভ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হুমায়ুন আজাদসহ আরো অনেকেই প্রবচনের চর্চায় চেষ্টাশীল ছিলেন এবং বর্তমানেও কেউ কেউ আছেন। আর্কেডিয়া আদিতে গ্রীসের পিলোপনেশীয় অঞ্চলে একটি পাহাড়ী এলাকার নাম ছিল আর্কেডিয়া। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের রচনায় গ্রামীণ জীবনের প্রশান্তি ও মাধুর্যের প্রতীকরূপে শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কবি ভার্জিল পল্লীর পরিবেশে শান্ত মধুময় আদর্শায়িত চাষীজীবনের ছবি এঁকেছেন তাঁর ‘ঊপষড়মঁবং’-এ। বাংলা সাহিত্যে গ্রামের রূপ-প্রকৃতি যাঁদের রচনায় নিবিড়ভাবে ফুটে উঠেছে তাদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি জসীম উদ্দীন এবং আল মাহমুদ অন্যতম। গ্রামই মানুষের আদর্শ আবাস-এই ধারণাকে সামনে রেখে আজো অনেক লেখক-শিল্পী তাদের শিল্প বা রচনাকে প্রদর্শন করে যাচ্ছেন। আর্কেইজম সাহিত্যে বর্তমানে অব্যবহৃত ও বর্জিত প্রাচীনকালের শব্দের ব্যবহার। স্পেন্সার তাঁর ‘দি ফেয়ারি কুইন’-এ অনেক শব্দ ব্যবহার করেছেন কবি চশারের মধ্যযুগের ইংরেজি থেকে। বিশেষত ধ্বনিমাধুর্যকে অক্ষুণœ রাখতে গিয়ে আধুনিক কবিতায় পুরাতন শব্দগুলো বারবার ফিরে আসে। আমরা মুহম্মদ নুরুল হুদার ‘শুক্লা শকুন্তলা’ থেকে একটু পাঠ নিচ্ছি- ‘তবুও সংশয় জাগে, তবুও কুয়াশা মধ্যদিন হয়ে ওঠে ঘোর অমারাত একি তবে ভাগ্যরজ্জু, এই কি বরাত ক্ষমতাকে গ্রাস করে প্রেম সর্বনাশা?’ বিট জেনারেশন সীমিত অর্থে এই টার্মটি জ্যাক কেরুয়াক প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বলে ধারাণা করা হয়। গতানুগতিক ধারার বাইরে, পরিত্যক্ত, পরাজিত ও বর্জিত অনুষঙ্গগুলো এই টার্মটিতে এসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ঊনিশশো পঞ্চাশের দশকের কতিপয় মার্কিন সাহিত্যিক যথাÑকেনেথ রেক্সরথ, হেনরি মিলার ও উইলিয়ম বারোস এই ধারায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। বিশেষভাবে নাম করা দরকার ‘হাউল ও অন্যান্য কবিতা’-এর লেখক অ্যালেন গিন্সবার্গ এবং অন দি রোড-এর লেখক জ্যাক কেরুয়াকের। বিট লেখকরা একটা জনপ্রিয় ফ্যাশনের জন্ম দেন এবং পপ সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেন। মেটাফিজিক্যাল কনসীট কবিতাকে বহুব্যবহারে জীর্ণ অতিপরিচিত উপমার জগৎ থেকে মুক্তি দিতে চেষ্টা করেন একদল কবি। তাঁরা বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যা, সমুদ্রচারী নাবিকের অভিজ্ঞতা, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি বিভিন্ন অঙ্গন থেকে চয়ন করলেন তাঁদের উপমারাশি এবং সেসব তাঁদের কবিতার শরীরে যুক্ত করলেন দুঃসাহসিকতার সঙ্গে। কবিতাকে শুধু আবেগনির্ভর না করে তার ভেতর যুক্তির দৃঢ়তা, বুদ্ধির দীপ্তি ও বৈদগ্ধ সঞ্চারিত করে। ১৯৮০-এর দশকে এই ম্যাটাফিজিক্যাল কবিদের সম্পর্কে নতুন করে উৎসাহের সঞ্চার হবার পর অনেক আধুনিক কবি তাঁদের কাব্যকর্মে ওই জাতীয় কনসীট ব্যবহার শুরু করেন। এক্ষেত্রে টি.এস. এলিয়টের ‘দি লাভ স্ঙ অব আলফ্রেড প্রু ফ্রক’ কবিতার কয়েকটি লাইন পাঠ করা যায়। ‘খবঃ us then go, you and I/When the evening is spread out against the sï/like a patient etheri“ed upon a table. স্বীকারোক্তির কবিতা একধরনের কাহিনীমূলক এবং গীতিকাব্যধর্মী কবিতা। রবার্ট লাওয়েল তাঁর ‘লাইফ স্ট্যাডিজ’-এর মাধ্যমে এই ধারাকে বেগবান করেন। অ্যালেন গিন্সবার্গ, থিওডোর রোয়েথকে, সিলভিয়া প্লাথ, পাবলো নেরুদা প্রমুখ কবি স্বীকারোক্তির কবিতা রচনা করেন। কাজী নজরুল ইসলামের ‘আমার কৈফিয়াৎ’ এই শ্রেণীভুক্ত একটি বিখ্যাত কবিতা। নীল অশ্বারোহী তীব্র রং-এর প্রলেপনে আবেগের তীব্রতায় একটি প্রথা-বিরুদ্ধ শিল্পকর্মের উদ্ভব ঘটলো মিউনিখে ১৯১২ সালে। যেসব জার্মান শিল্পী এ আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন তাঁরা হলেন-পল ক্লী, কন্দিনস্কি, মার্ক, ম্যাক এবং ম্যুনটার। শিল্প সৃষ্টির ইতিহাসের গতিধারায় একটি বিক্ষুব্ধ যুগ-লক্ষণ হিসেবে এ আন্দোলনকে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যে অনুভূতিগুলো চাপা থাকতে পারতো অথবা শব্দহীনতায় হারিয়ে যেতো, সেগুলোকেই নীল অশ্বারোহী দল রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিউবিজম সকল বস্তুকে জ্যামিতিক কয়েকটি আকৃতিতে পর্যবসিত করা, বস্তুর বিভিন্ন অবস্থানকে একক আলগ্নতায় রূপান্তরিত করা, একটি স্বচ্ছতায় বা ট্রান্সপ্যারেন্সিতে পশ্চাতের বস্তুকে সম্মুখের বস্তু ভেদ করে দৃশ্যমানতায় উপস্থিত করা কিউবিজম-এর মূল শিল্পপ্রক্রিয়া। ১৯০৭ সালে পিকাসো এর উদ্ভাবন করেন, পরে ব্রাক একে একটি চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে দেন। বর্তমানে কিউবিজম পৃথিবীর শিল্পধারাকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে- অন্য কোনো শিল্প-আন্দোলন ততটা পারেনি। পিকাসো একে ‘কনসেপচুয়াল’ আখ্যায়িত করেছেন। দাদাইজম চিত্রকর্মে এবং সাহিত্যে প্রতিবাদ হিসেবে একটি প্রচণ্ড বিক্ষুব্ধতায় দাদাবাদের জন্ম হয় জুরিখে ১৯১৬ সালে। দৃশ্যগত স্বাভাবিকতাকে রূপ দেবার চেষ্টা না করে এককালীনতায় সকল সময় এবং বস্তুকে উপস্থিত করার একটি প্রক্রিয়াকে ‘দাদাবাদ’ বা দাদাইজম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ মতবাদের প্রবক্তাদের বক্তব্য ছিলো শিল্প রিয়ালিস্টিক নয়, আইডিয়ালিস্টিকও নয়, শিল্প হচ্ছে সত্য। তাঁদের বিচারে পরিচিত জীবনের অণুস্মৃতি ছিলো মিথ্যাচার। আবেগের একটি বিমূর্ততাকে তাঁরা স্বাক্ষরিত করার চেষ্টা করেছিলেন।
×