ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওরা হারাচ্ছে বাসস্থান

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

ওরা হারাচ্ছে বাসস্থান

সমুদ্র হক ॥ ওরা হারিয়ে ফেলছে বাসের স্থান। টান পড়েছে খাবারের। বিশাল পাথারে ঘুরে বেড়াবার ও থাকার অভ্যাস নেই। সেখানে খাবারও সহসা মেলে না। উল্টো মরণের ভয় আছে। বনের এমন কিছু প্রাণী নিরাপত্তার অভাবে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। কখনও পথ হারিয়ে দিশা না পেয়ে বনের মতো কিছু দেখে প্রবেশ করছে কোন গ্রামে। সেখানেও রক্ষে নেই। কৌতূহলী এবং নির্দয় কিছু মানুষের সামনে পড়ে এরা প্রাণ দিচ্ছে অঘোরে। কেউ মনের সুখে পিটিয়ে হত্যা করছে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষার এসব প্রাণী। কালে-ভদ্রে এরা রক্ষাও পাচ্ছে, তবে সেই সংখ্যা কম। দেশে বন্যপ্রাণী রক্ষা আইনের বিষয়টিকে আমলে নেয় না অনেকে, কারও তেমন জানাও নেই। বন বিভাগ প্রতি মৌসুমে বৃক্ষরোপণের যত আয়োজন করে বন্য প্রাণী রক্ষার আয়োজন ততটা নেই। সুন্দরবনের বাঘ রক্ষার জন্য যত ঢাকঢোল পেটানো হয় সেই ঢাকের সামান্য বাদ্য অন্যান্য প্রাণী রক্ষার জন্য বাজানো হলে জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রাণীকুল রক্ষা পেত। এর মধ্যেই দেশের কিছু সচেতন মানুষের কল্যাণে বনের প্রাণীগুলো রক্ষা পাচ্ছে। তবে যত রক্ষা পাচ্ছে নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। বন্যা পশুপাখি এতটাই নির্মমতার শিকার যে, শীতের মৌসুমে সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে আসা পরিযায়ী পাখি (যা অতিথি পাখি) রক্ষা পায় না। প্রাণ দিচ্ছে শিকারিদের বন্দুকের গুলিতে। শিকারিদের কাছে যা মহা আনন্দের, পরিযায়ী অতিথিদের কাছে তা মহা বেদনার। এমনও দেখা গেছে, জুটি বেঁধে আসা অনেক পাখিকে প্রিয়জনের হত্যার রক্ত দেখে ফিরে যেতে হয়েছে। ওদের কণ্ঠের কিচিরমিচির সুর রুদ্ধ হয়েছে। কিছুদিন হয় দেখা যাচ্ছে, উজাড় হওয়া বন থেকে লোকালয়ে ছুটে আসছে কিছু নিরীহ প্রাণী। এদের মধ্যে আছে বাঘডাসা (অঞ্চল ভেদে নাম বাঘশাইল্যা)। বন বিভাগের বন্য প্রাণীর তালিকায় নাম গন্ধগোকুল। বগুড়ায় কাহালুতে কিছুদিন আগে বাঘডাসা ধরা পড়ার পর কৌতূহলীরা যখন উৎসাহভরে মেরে ফেলার চেষ্টা করে তখন গ্রামের এক প্রবীণ প্রাণীটিকে বাঁচায়। পরে তা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করা হয়। গ্রামে এখনও বাঘডাসাকে নিয়ে ছন্দ প্রচলিত আছেÑ ডিম পারে হাঁসে খায় বাঘডাসে। দিনা কয়েক আগে শীতের রাতে ধুনটের কুঠিবাড়ি গ্রামে এক গৃহস্থ বাড়িতে বেজি ধরার ফাঁদে আটকা পড়ে এক বাঘডাসা। ওই গ্রামে বেজির উৎপাত বেড়ে গেলে ফাঁদ পেতে রাখা হয়। জঙ্গল হারিয়ে এক বাঘডাসা ঢুকে পড়ে গ্রামে। আটকে যায়। সকালে লোকজন বাঘডাসাকে পিটিয়ে মরণের দিকে নিয়ে গেলে কিছু মানুষ রক্ষায় এগিয়ে এসে প্রায় ৪ ফুট লম্বা বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগের বাঘডাসাকে রক্ষা করে। খবর দেয়া হয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে। বাঘডাসাকে পশু হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সাফারি পার্কে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। গেল মাসের শেষের দিকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দেবডাঙ্গা গ্রোয়েনের বাঁধের কাছে একটি অজগর সাপকে দেখতে পেয়ে ওঁৎ পেতে থাকে লোকজন। সাপটি দিশা না পেয়ে যমুনার চরে উঠে এক গ্রামে ঢুকে পড়লে লোকজন ধরে ফেলে। প্রায় ১২ ফুট লম্বা এই অজগরকে মেরে ফেলার সময় বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের সভাপতি এসএম ইকবাল খবর পেয়ে সাপটিকে রক্ষা করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের কর্মকর্তার কাছে পাঠিয়ে দেন। এসএম ইকবাল জানান, সাপটি শুধু দেখতেই বড়। এটা বিষধর নয়। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এই সাপ অনন্য ভূমিকা পালন করে। দেশের অনেক বন্যপ্রাণী ও পাখি আমাদের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে চলেছে। কিছুদিন হয় দেখা যাচ্ছে, এক ধরনের শকুন ও পেঁচা ধরা পড়ছে বিভিন্নœ স্থানে। গেল মাসে নাটোরের গুরুদাসপুরে বিরল প্রজাতির দুইটি শকুন ধরা পড়ে। প্রতিটি শকুনের পাখার দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন ফুট করে। পরে এই শকুনকে উদ্ধার করে বন কর্মকর্তাকে খবর দেয়া হয়। সূত্র জানায়, দেশের বনপ্রাণী কমে যাওয়ায় বন্যপ্রাণীরা ছোটাছুটি শুরু করেছে। পরিবেশ রক্ষায় দেশের মোট আয়তনের এক-চতুর্থাংশ বনাঞ্চল থাকা দরকার। দেশে বর্তমানে বনভূমির পরিমাণ আয়তনের মাত্র ৯ শতাংশ। বন অধিদফতরের হিসাবে দেশের মোট বনভূমির ১৮ শতাংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এর মধ্যে পাহাড়ী বন, সমতল বন, সুন্দরবনের উপকূলে তৈরি বন রয়েছে। সরকারীভাবে বলা হয়, সংরক্ষিত বনভূমি ব্যক্তি পর্যায়ে রোপিত গাছ সামাজিক বনায়ন ও উপকূলীয় বেষ্টনীসহ দেশের মোট বনভূমি ১৮ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে তা ২৫ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে এই হিসাব কাগজে-কলমের। বাস্তবতার সঙ্গে মিল কতটুকু তা খতিয়ে দেখা হয় না। মাঠপর্যায়ের চিত্র বলে দেয়; যে বনে জীববৈচিত্র্য রক্ষার প্রাণিকুলের বাস ছিল তা কার্যত নেই। বর্তমানে বিচ্ছিন্নভাবে যা আছে তা এতই কম যে সেখানে প্রাণিকুলের বাস হয় না। যে কারণে ছোট প্রাণীগুলো ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। কখনও বেঁচে গেলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্দয় ও নিষ্ঠুরতার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। জীবপ্রেমের দিনগুলো বুঝি ফুরিয়েই যাচ্ছে...।
×