ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ নিমরের মৃত্যুদণ্ড গভীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ

উপসাগরে বিপজ্জনক বিভাজন

প্রকাশিত: ০৬:০৮, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

উপসাগরে বিপজ্জনক বিভাজন

সৌদি আরবে শিয়া ধর্মীয় নেতা শেখ নিমর আল নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার ঘটনা ঐ রাজতান্ত্রিক দেশটিতে এবং পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে বিদ্যমান বিপজ্জনক রাজনৈতিক ধর্মীয় ও আর্থ সামাজিক বিভাজনকেই স্পষ্ট করে তুলেছে। ঐ মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার খবর প্রচারিত হলে সৌদি আরবের তেল সমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ এবং প্রতিবেশী বাহরাইন ও দক্ষিণ ইরাকের শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি কার্যত সৌদি রাজতন্ত্রকে উৎখাত করার আহ্বান জানান। এতে সৌদি সরকার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার দায়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে অভিযুক্ত করে। ইরানী প্রতিবাদীরা তেহরানস্থ সৌদি দূতাবাসে হামলা চালায়। এর জবাবে সৌদি আরব ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং একই পদক্ষেপ নিতে মিত্র সুন্নি সরকারগুলোকে উৎসাহিত করে। উপসাগরীয় অঞ্চলের দুটি বড় শক্তি ইরান ও সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সুন্নি শিয়া সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও আর্থ সামাজিক অসন্তোষের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ। বিশ্বের তেলের সবচেয়ে বড় মজুদও রয়েছে এ প্রদেশে। ইরান, দক্ষিণ ইরাক, সৌদি আরবের পূর্ব উপকূল এবং বাহরাইনজুড়ে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো বিস্তৃত। ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ী এলাকাতেও শিয়াদের বাস। ইরান ঐসব দেশের শিয়া সম্প্রদায়গুলোর বিষয়ে বিশেষভাবে উৎসাহী রয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তেহরান সরকার বিশেষত বিপ্লবীরক্ষীরা ও অন্যান্য দল শিয়া এলাকাগুলোতে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এসব শিয়া সম্প্রদায়ের অনেকগুলোর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিদ্যমান এবং এ অসন্তোষের অনেকাংশের জন্য ইরানের উস্কানির চেয়ে বরং স্থানীয় কারণগুলোই দায়ী। ইরাক, বাহরাইন ও সৌদি আরবের শিয়া সম্প্রদায়গুলো সবাই গত শতক ধরে সুন্নি নিয়ন্ত্রিত সরকার ও সমাজের হাতে বৈষম্যের শিকার এবং ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েছে। সম্ভাব্য অস্থিরতার আরও একটি কারণ রয়েছে : যেসব এলাকায় অনেক শিয়া সম্প্রদায়ের বাস, সেখানেই ঐ অঞ্চলের অধিকাংশ তেল ও গ্যাসের মজুত রয়েছে। ইরাকের শিয়া অধ্যুষিত দক্ষিণাঞ্চলে দেশের মধ্যাঞ্চলের সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি তেল ও গ্যাস রয়েছে। আর সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশেই দেশের তেল ও গ্যাসের প্রায় সব মজুত অবস্থিত। পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত অজানাই রয়েছে, কারণ সেখানে কোন সাংবাদিকের প্রবেশ ও খবর সংগ্রহ সৌদি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। এ সরকার দেশটির রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের আলোচনা নিরুৎসাহিত করে থাকে। তবে সেখানকার ঝুঁকিকে সৌদি সরকার এক গুরুতর বিপদ বলেই মনে করে থাকে। সরকার সেই অঞ্চলে বড় ধরনের নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন রেখেছে। এ থেকে বোঝা যায়, রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যকার সংঘাত কেন এত তিক্ত। সৌদি আরব রক্ষণশীল মধ্যাঞ্চলের (নেজদ) সঙ্গে পশ্চিম উপকূল (হেজাজ) ও উপসাগরীয় উপকূলের (আল-হাসা) পূর্বাঞ্চলীয় মরুদ্যানগুলোকে যুক্ত করে গঠিত। এসব অঞ্চল অপেক্ষাকৃত সম্প্রতিকালের আগে পৃথক পৃথকভাবে শাসিত হতো। নেজদের শাসক বাদশাহ আব্দুল আজিজ অটোমান সমাজ্যের ভগ্নাবস্তা থেকে ১৯১তম সালে আল হাসা দখল করেন। তিনি ১৯২৪/২৫ সালে হেজাজকে সৌদি ভূখ-ভুক্ত করে শেষ পর্যন্ত ১৯৩২ সালে দেশকে একীভূত করেন। কিন্তু এরপরও অঞ্চলে অঞ্চলে এবং এমনকি নিজেদের মধ্যেও কৃষ্টিগত ও ধর্মীয় দিক দিয়ে বড় ধরনের পার্থক্য থেকে যায়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতাদের বেশিরভাগই নেজদ অঞ্চলের মানুষ। এ অঞ্চল ইসলামের কঠোর ওয়াহাবী মতবাদের অনুসারী। হেজাজ ইসলামের আরও উদার ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী এমন ব্যক্তিদের আবাস। আর আল হাসার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলামের শিয়া মত অনুসরণ করে। জাতি গঠনের চেষ্টায় নেজদের রক্ষণশীল ধর্মীয় মত দেশের অন্যান্য অংশের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে সুন্নিদের সঙ্গে বিশেষত ওয়াহাবী মতের অনুসারীদের সঙ্গে আল হাসার শিয়া সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনা চলছে। আল হাসানেই এখন পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ বলা হয়। নিমরের মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার পর শত শত প্রতিবাদী ঐ প্রদেশের কাতিফ শহরে শনিবার মিছিল বের করে। -ইয়াহুনিউজ
×