ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইজিবাইক নিচ্ছে প্রতিদিন ॥ ৫শ’ মেগাওয়াট

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

ইজিবাইক নিচ্ছে প্রতিদিন ॥ ৫শ’ মেগাওয়াট

রশিদ মামুন ॥ সারাদেশে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের জন্য দৈনিক ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত প্রয়োজন হচ্ছে। স্বল্প দূরত্বে সহজ যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখায় দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে ইজিবাইক। সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকায় দৈনিক প্রায় এক হাজার টাকা আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় বছরে অন্তত ৫০ হাজার ইজিবাইক রাস্তায় নামছে। গ্রিডের বিদ্যুতের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প হিসেবে সোলার চার্জিং স্টেশন স্থাপনের সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি গত দুই বছরেও। সঙ্গত কারণে প্রতিদিনই গ্রিডের বিদ্যুতের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ইজিবাইক পরিচালনার অনুমোদন দেয়ায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন অধিদফতরের (বিআরটিএ) কাছে ইজিবাইকের কোন পরিসংখ্যান নেই। অন্যদিকে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের ওপর ইজিবাইকের চাপ পর্যালোচনা করতে গিয়ে বিদ্যুত বিভাগ ২০১২-১৩ অর্থবছর পর্যন্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে বলছে, দেশে ইজিবাইকের সংখ্যা ওই সময় পর্যন্ত চার লাখের মতো। ইতোপূর্বে চীন থেকে সরাসারি আমদানি করা হলেও সরকারের কড়াকড়ির কারণে এখন খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানি করে দেশেই ইজিবাইক সংযোজন করা হচ্ছে। সরকারের সকল পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে বলা যায়, বছরে অন্তত ৫০ হাজার ইজিবাইক রাস্তায় নামছে। অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতি সম্প্রতি যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যায়, সারাদেশে ইজিবাইকের সংখ্যা তাদের হিসাবে সাড়ে তিন লাখের বেশি। স্থানীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে এই হিসাব তৈরি করা হয়েছে। কারিগরি দিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ইজিবাইকে সাধারণত ৬০ ভোল্ট, ১০০০ ওয়াটের ডিসি টাইপের মোটর ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ১২০ এম্পিয়ার আওয়ারের লিড এ্যাসিড ব্যাটারি প্রয়োজন হয়। প্রতিসেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট বিদ্যুত চাহিদার প্রয়োজন হয়। ব্যাটারি চার্জিংয়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগায় এতে গড়ে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট বিদ্যুত খরচ হয়। এ হিসাবে পাঁচ লাখ ইজিবাইকের জন্য দৈনিক বিদ্যুতের প্রয়োজন হয় ৫০০ মেগাওয়াট। প্রথমে সরাসরি ইজিবাইক বন্ধের সিদ্ধান্ত হলেও পরে সরকার ওই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিএ বলছে, ইজিবাইক নামের এই পরিবহন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে গ্রামীণ, নসিমন, করিমন আলম সাধুর মতো স্থানীয়ভাবে নির্মিত পরিবহনের সঙ্গে ইজিবাইক মহাসড়কে উঠে পড়ছে। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তবে পরবর্তীতে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের কথা চিন্তা করে ইজিবাইক বন্ধের বদলে নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত হয়। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় মহাসড়কে ইজিবাইক চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ইজিবাইক বন্ধে বিদ্যুত সংযোগ না দেয়ার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময় বিদ্যুত বিভাগকে অনুরোধ করে। তবে সারাদেশে ইজিবাইক চার্জিং পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব বলে বিদ্যুত বিভাগ তাতে সায় দেয়নি। উপরন্তু অনেকে বাণিজ্যিক ইজিবাইকে গৃহস্থালির বিদ্যুত ব্যবহার করায় কোম্পানিগুলো রাজস্ব হারাচ্ছে। এছাড়া একশ্রেণীর গ্যারেজ মালিক বিদ্যুত চুরি করে ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য পাঁচ ইউনিট বিদ্যুত ব্যবহারের জন্য গ্রাহক বাণিজ্যিক বিদ্যুতের দামের হিসেবে নয় টাকা ৮০ পয়সা হারে দৈনিক ৪৯ টাকার বিদ্যুত প্রয়োজন হয়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্থাপিত চার্জিং স্টেশনের মালিকরা প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জ বাবদ ইজিবাইক চালকের নিকট হতে ৭০ থেক ৮০ টাকা নিয়ে থাকে। আবাসিক সংযোগ ব্যবহার করে এ ধরনের ব্যাটারি চার্জ করা হলে প্রতিবার খরচ হয় ত্রিশ টাকার মতো। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রামে আবাসিক সংযোগ থেকে ইজিবাইক চার্জ দেয়া হয়। যেখানে বিতরণকারী সংস্থা প্রতিবার চার্জের সময় ১৯ টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। বিদ্যুত বিভাগের পাওয়ারসেলের এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, ইজিবাইকের একসেট ব্যাটারি চার্জের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুত চাহিদা গড়ে ১০০০ ওয়াট বা এক কিলোওয়াট এবং ব্যাটারি চার্জের জন্য ৫ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন হয়। এতে গড়ে পাঁচ ইউনিট বিদ্যুত প্রয়োজন হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ১২০ সেট ব্যাটারি চার্জ দিতে ১২৫ কিলোওয়াট সোলার সিস্টেম বসাতে হবে। প্রতি কিলোওয়াট সোলার সিস্টেমের বর্তমানে বাজার মূল্য প্রায় এক লাখ টাকা। ওই হিসাবে সোলার সিস্টেম বসাতে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে। অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে আরও সোলার সিস্টেম বসাতে দেড় কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে ইজিবাইক দিনের বেলা রাস্তায় চলাচল করে আর রাতে চার্জ দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে সোলার দিয়ে চার্জ দিতে গেলে দিনের বদলে রাতে চার্জ দিতে হবে। এ জন্য ইজিবাইকে দুই সেট ব্যাটারি প্রয়োজন হবে। ইজিবাইক চার্জিং স্টেশনে এসেই যাতে ব্যাটারি সংগ্রহ করতে পারে এ জন্য ৫০ সেট ব্যাটারি অতিরিক্ত রাখার সুপারিশ করা হয়। এতে আরও ২৫ লাখ টাকা ব্যয় ধরে মোট ব্যয় এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইজিবাইকের গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাটারি চার্জ বাবদ ৫০ টাকা নিলে দৈনিক ছয় হাজার টাকা আয় হবে। এতে আট বছরের মধ্যে বিনিয়োগকারীর প্রকল্পর অর্থ উঠে আসবে। সাধারণত ভাল মানের সোলার প্যানেল থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত বিদ্যুত পাওয়া যায়। বাকি ১৭ বছর টানা মুনাফা করা সম্ভব। প্রাথমিকভাবে বিদ্যুত বিভাগ সাতটি বিভাগীয় শহরে সাতটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়ার উদ্যোগ নেয়। বিতরণ কোম্পানিগুলোকে এসব সোলার চার্জিং স্টেশন স্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত আরইবি ছাড়া অন্য কোন কোম্পানি সোলার চার্জিং স্টেশন স্থাপনে এগিয়ে আসেনি। পাওয়ার সেলের নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিভাগের পরিচালক আব্দুর রউফ এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আরইবির কাজ চলছে। তারা নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শেষ করার পক্ষে। তবে অন্যগুলোর কাজ এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। যদিও সবাই নির্মাণ করবে বলে আমাদের জানিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন শ্রেণীর উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসলে সারাদেশে চার্জিং স্টেশন নির্মাণ করা সম্ভব। বিশেষ করে পেট্রোল পাম্পের উদ্যোক্তারা সহজেই এসব প্রকল্প নির্মাণ করতে পারে। তাদের বাড়তি কোন জমিরও প্রয়োজন হবে না। তবে সরকার এসব প্রকল্পে বিনাসুদ অথবা স্বল্প সুদে ঋণ দিলে সাধারণ উদ্যোক্তার আগ্রহী হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুত উৎপাদনের ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে দুই হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন সরকার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে সোলার প্যানেল বিতরণ করছে। একই সঙ্গে এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করার চিন্তা করলে গ্রিডের ওপর চাপ কমে আসবে।
×