ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আর্টিকুলেটেড বাস এখন বিআরটিসির গলার ফাঁস

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ৮ জানুয়ারি ২০১৬

আর্টিকুলেটেড বাস এখন বিআরটিসির গলার ফাঁস

সরকারের কতগুলো অফিস আছে- সংস্থা, দফতর, অধিদফতর আরও কত কী? এসব অফিসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বেচাকেনা। প্রকৃত অর্থে বেচাকেনার চেয়ে কেনাই বেশি। এই কেনার কাজ কী অপচয়ের ‘ডিপো’। না, কেউ হয়ত বলবেন অপচয় নয় অদক্ষতার ‘খাম্বা’। না, যারা একটু ‘লেখাপড়া’ করেছেন তারা বলবেন, না অপচয় বা অদক্ষতা এসব ‘অসভ্য’ শব্দ। প্রকৃতপক্ষে এসব অফিসের বেশিরভাগ অফিসের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন পদের লোককে পুঁজি সংগ্রহে (ক্যাপিটেল এক্যুমুলেশন) সাহায্য করা। এটা অবশ্য ‘টিআইবি’, ‘সুজন’ ইত্যাদি ‘ব্রাদাররা’ মানবেন বলে মনে হয় না। তারা বলবেন লুট, স্রেফ লুট, আত্মসাত- সাদা বাংলায় টাকা মেরে দেয়ার ব্যবস্থা। যদি প্রশ্ন তোলা হয় ‘লুট ছাড়া ‘ক্যাপিটেল’ বাংলাদেশে আসবে কোত্থেকে? আ-ার ইনভয়েসিং, ওভার ইনভয়েসিং, ‘বন্ডেড’ মাল বিক্রি করে দেয়া, সুদ মওকুফ করা, ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে উপরের কোর্টে মামলা রুজু করে দেয়া। হ্যাঁ, এসবও পন্থা। সবই ‘ক্যাপিটেলে’র জন্য। নতুবা অনেক ঘটনার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এই যেমন ঢাকার রাস্তা। ঢাকার রাস্তা কম। রাস্তা অপ্রশস্ত, সরু। রাস্তা হকার, ঠেলাগাড়ি এবং নানা পদের যানবাহন দ্বারা ভর্তি। কাউকে কী এ কথা বোঝানোর দরকার আছে বা আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার প্রয়োজনীয়তা? আমার দৃঢ় বিশ্বাস কোন কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান থেকে ক্রয় বিভাগের সকলকে এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজন আছে। অন্তত বিআরটিসির লোকদেরকে। বিআরটিসি মানে ‘বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন’। একটি খবরে দেখা যাচ্ছে ‘বিআরটিসির বোঝা হয়ে উঠছে আর্টিকুলেটেড বাস’। শিরোনামের উপরে গ্রীন বর্ডারে লাল বাসের ছবি। যতটুকু মনে পড়ে কবে যেন একে ঢাকার রাস্তায় দেখেছিলাম। নাম শুনে ‘কাম’ বোঝা যায় না। আসলে জোড়া বাস। দুটো বাস একসঙ্গে চলবে। ভালই তো। পাকিস্তান আমলের (১৯৪৭-৭১) মাঝামাঝিতে ‘মুড়ির টিনের’ ঢাকায় দোতলা বাস দেখে আমরা শিহরিত হয়েছিলাম। তখন বাচ্চা বয়সের লোক আমরাÑ সদ্য গ্রাম থেকে এসেছি। কিন্তু ‘আর্টিকুলেটেড বাস’ দেখে শিহরিত হইনি। দেখেই দুটো বকা দিয়েছি। কে এই কা-টি করল। এই বাস চলবে কোথায়? রাস্তায় ঘুরবে কিভাবে, এত প্রশস্ত রাস্তা কোথায়? আমাদের মতো ‘ময়মনসিংহের ব্যাক্কলরা’ এটা বুঝতে পারলাম, সঙ্গে সঙ্গে এখন দেখছি ‘বিআরটিসি’র কর্মকর্তা তা বুঝেছে তিন বছর পর। ‘বিআরটিসির’ চেয়ারম্যান মোঃ মিজানুর রহমান বলেছেন, আর্টিকুলেটেড বাসের জন্য পৃথিবীর সব দেশে পৃথক লেন থাকে। সব ধরনের যানবাহনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলা এসব বাসের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ঢাকার সড়কগুলোও এ বাসের জন্য উপযুক্ত নয়। টার্ন নেয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই অধিকাংশ সড়কে। ফলে আর্টিকুলেটেড বাস থেকে আয় কম হয়। আয় কম মানে, লোকসান। তার মানে তার মেরামতি খরচা যোগাড় করা সমস্যা। দেখা যাচ্ছে, এই সমস্যায় পড়ে ২০১২ সালে ক্রীত এ ধরনের ৫০টি বাসের মধ্যে ১৪টিই এখন বিকল। বিশ কোটি টাকা লাগে মেরামতের জন্য। অর্থ মন্ত্রণালয় এই টাকা দিতে নাকি অপারগতা প্রকাশ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে এখন ‘আর্টিকুলেটেড বাস’ সম্পর্কে নানা আলোচনা হচ্ছে ‘বিআরটিসিতে’। আলোচনা চলতে থাকুক অনন্তকাল। কিন্তু প্রতিটি বাস কিনতে যে এক কোটি ১১ লাখ টাকা লাগল এর খবর কী? ওই টাকার কী হবে? কারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এ ক্রয়ের? নিশ্চয়ই বর্তমান চেয়ারম্যানের জায়গায় এমন একজন চেয়ারম্যান ছিলেন যিনি বলতেন, ফাটাফাটি ব্যবস্থা হবে ঢাকায়। দুটা বাস একসঙ্গে চলবে। সবাই তাকিয়ে থাকবে। তাছাড়া এমন কাজ কে করে যখন বর্তমান চেয়ারম্যান বলেন, ঢাকার রাস্তা ‘আর্টিকুলেটেড বাসের’ উপযুক্ত নয়। ‘সহি বাত’। এখন ‘ক্যাপিটেল ফরমেশন’-এর কাজটি তো হয়ে গেল- বোঝা বইতে হচ্ছে দেশবাসীকে। ধরা যাক, ‘ওয়াটার বাস’। যখন এর নাম শুনলাম তখন আমার মাথায় ধরে না ‘ওয়াটারে’ কিভাবে ‘বাস’ চলবে? তাই আমি পুরান ঢাকাইয়া ভাবলাম যাই সদরঘাট দেখি আসি ‘ওয়াটার বাস’ যা চলবে নাকি সদরঘাট থেকে মিরপুর পর্যন্ত। ‘ওয়াটার বাস’ আসলে বুঝলাম ছোট ছোট লঞ্চ। সুন্দর ‘আইডিয়া’। মিরপুরবাসীরা যদি শহরের মধ্য দিয়ে না এসে শুকনো-মজা বুড়িগঙ্গা দিয়ে সদরঘাট আসতে পারে তাহলে তো ভালই হয়। দরকার বোধে ‘পিকনিক’ও করা যাবে। প্রভাবশালী মন্ত্রীর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ভাষণ শুনলাম- দেশের ও দশের ভবিষ্যতের কথাও শুনলাম। দুদিন পর শুনি ‘ওয়াটার বাসে’র নানা সমস্যার কথা। প্যাসেঞ্জাররা উঠতে চায় না। এগুলো অনিয়মিত, সময় লাগে বেশি। ভাড়া বেশি। আরও কত সমস্যা। কত বড় উদ্যোগ। এখন আর এর কথা শুনি না। এই মহান ‘সেবাটি’ কী ধরে রাখা গেছে? না, ক্যাপিটেল ফরমেশনের কাজ শেষে প্রকল্পটি ধ্যানস্থ হয়েছে? অজ্ঞতা মার্জনীয়! আসি ডেমু ট্রেনের কথায়। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ চলবে ডেমু ট্রেন। উত্তেজনা চারদিকে। ঘন ঘন ডেমু ট্রেন চলবে ময়মনসিংহ, জয়দেবপুর ও নারায়ণগঞ্জের লোকেরা উপকৃত হবে। এমনকী এর আওতা বাড়াতে পারলে লোক আরও উপকৃত হবে। যেমন নরসিংদী ও ভৈরব এমনকী কুমিল্লা পর্যন্ত ডেমু ট্রেন চললে লোক দৈনিক যাতায়াত করতে পারবে ঢাকার সঙ্গে। এ ধরনের ব্যবস্থা কলকাতায়, মুম্বাই ইত্যাদি শহরে বহু আগে থেকেই আছে। তার সুফলও তারা পাচ্ছে। এবংবিধ চিন্তায় আমরা ডেমুর প্রশংসা করলাম। চীন থেকে আগত ডেমু ট্রেন প্রথমেই পড়ল বিপদে। ভেতরে না কি ‘সাফোকেশন’ হয়। বিশাল সমস্যা। উঠা-নামার সমস্যা। উদ্যোগটির বর্তমান অবস্থা সে সম্পর্কে আমি অজ্ঞ- এর জন্য ক্ষমা প্রার্থী। এটা চালু আছে কী? না কি অনেক প্রকল্পের মতো এটাও ‘ক্যাপিটেল ফরমেশন’ খাতে খরচ হয়ে গেছে? এসব চিন্তা-দুশ্চিন্তার মধ্যে খবরে দেখি আবার সরকারী ব্যাংক। তাদের ‘অপারেটিং প্রফিট’ কমেছে, নন-পারফরমিং লোন বেড়েছে। তাদের ক্রেডিট গ্রোথও কম। এদিকে সুখবর এখন শুধু সরকারী ব্যাংকের খবর ছাপা হয় না, দুঃসংবাদ বেসরকারী ব্যাংকেরও আছে। আশার কথা এসব এখন সামনে আসছে। তবে সরকারী ব্যাংকের ক্ষেত্রে একটা কথা বলা দরকার। খবরের কাগজে দেখতে পাচ্ছি তাদের ঋণ সম্প্রসারণ করতে দেয়া হচ্ছে না। যেটুকু করতে দেয়া হচ্ছে তাতে ‘মূল্যস্ফীতি’টুকু মাত্র কভার হয়। এখন তাদের অসুবিধা হচ্ছে, তারা মানুষের কাছ থেকে আমানত নিতে অস্বীকৃত হতে পারে না। কারণ তারা সরকারী ব্যাংক। অন্য ব্যাংক হলে তারা ক্রেডিট প্ল্যানিংটা আগে করতে পারত, আমানতেরটা পরে। কিন্তু সরকারী ব্যাংকের আমানত নিতেই হয়, আর বিপরীতে ঋণ দিতে অপারগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘বারণ’ আছে। এখন বুঝুন তাদের গাল খেতে হচ্ছে ‘অপারেটিং প্রফিট’ কম বলে, আবার নন-পারফরমিং লোন বেশি বলে। বড় গাল। মিডিয়া এর সমালোচনা করছে। ব্যবসায়ীরা সমালোচনা করছেন। অথচ কোন্্ ‘বোকা’ না জানে যে, ব্যাংক যদি ঋণের পরিমাণ তার হিসাব মতো বাড়াতে পারত, তাহলে দুটো সমস্যা এক সঙ্গে শেষ হতো। ঋণ বাড়লে তার আয় বাড়ত এবং সঙ্গে সঙ্গে অপারেটিং প্রফিট বাড়ত। কমত ‘নন-পারফরমিং’ লোন শতকরা হিসাবে। এতে মূলধনের ঘাটতি থাকত কম। সরকারকে এর জন্য মাথা ঘামাতে হতো না। মজার বিষয় এসব কথা ‘মিডিয়া’ বলে না। মজার বিষয় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরাও এসব বলেন না। তাদের এই মুহূর্তের যুদ্ধ সুদের হার নিয়ে। এক ডিজিটে তা আনতে হবে- আমানতকারীরা মরুক আর বাঁচুক তাতে কিছু যায় আসে না। সঙ্গে বর্তমান ‘এফবিসিসিআই’-এর প্রেসিডেন্ট যোগ করেছেন আরেক দাবি। সেটি হচ্ছে জমি দিতে হবে তাদের। বর্তমান প্রেসিডেন্টকে কী কেউ চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন একটা কথা- তিনি জমি দিয়ে কী করবেন? কয়টা ইন্ডাস্ট্রি তিনি এখন পর্যন্ত করেছেন? তার শিল্পের রফতানি আয় কত? যে জমি তার সারা বাংলাদেশে পড়ে আছে বাউন্ডারিওয়ালের ভেতরে সেই জমির কী হবে? বাদ দিই এই ইস্যু। এবার দাবি ব্যবসায়ীর আরও একটি। তারা বলছেন রফতানির সমস্ত টাকা ‘রিটেনশন কোটায়’ রাখতে দিতে হবে। এই টাকা ব্যাংকগুলো ব্যবহার করবে দেশে বিনিয়োগের জন্য। বুঝলাম ‘রিটেনশন কোটার’ টাকা ডলার। এই ডলার তো ব্যাংকারদের যথেষ্ট পরিমাণেই আছে। তাদের রিটেনশন কোটার ডলারের প্রয়োজন ব্যাংকারদের কোথায়? যতদূর জানি রফতানিকারকরা তাদের রফতানির ডলার ২০ শতাংশ বিদেশে বর্তমানে রাখতে পারে, তাদের মার্কেটিং খরচ মেটানোর জন্য। এখন তারা চান ১০০ ভাগই বিদেশে রাখতে। আসল উদ্দেশ্যটা কী সরকারকে তা ভাবতে বলব। রফতানিকারকদের ‘বাড়বাড়ন্তের’ কতটুকু তাদের ‘পারফরম্যান্স’ আর কতটুকু রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য? এই হিসাব জাতির সামনে উপস্থিত করা দরকার। রফতানি আয়ে গরিবের ‘হক’ কতটুকু, আর তাদের ‘হক’ কতটুকু এই হিসাব দরকার। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×